সানেমের অর্থনীতিবিদ সম্মেলনে রেহমান সোবহান

ঋণের পুনঃতফসিল ও খেলাপ একটি শ্রেণীর ভাগ্য গড়ে তুলেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর ব্র্যাক-ইন সেন্টারে গতকাল সানেম আয়োজিত সপ্তম বার্ষিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

একশ্রেণীর রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ঋণ পুনঃতফসিল ও খেলাপের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য গড়ে তুলেছে বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। রাজধানীর ব্র্যাক-ইন সেন্টারে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত সপ্তম বার্ষিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলন-২০২৪-এর দ্বিতীয় দিনে গতকাল তিনি বলেন, ‘‌শুধু ঋণ খেলাপি করে বড় অংকের পুঁজি একীভূত করা যায় না। এর জন্য ঋণের পুনঃতফসিলীকরণও প্রয়োজন হয়। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ঋণের খেলাপ এখন ব্যবসার অংশ হয়ে গেছে। এর ফলে ভালো ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ঋণখেলাপি হওয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। কেননা, একজন সুদ ছাড়া আর অন্যজন সুদসহ ঋণ নেয়ায় প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রটি সমান থাকে না।’

সানেমের এবারের সম্মেলনের বিষয়বস্তু ‘‌নিউ ফ্রন্টিয়ার্স ইন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইমার্জিং ডায়নামিকস’। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনে থাকছে ১৬টি অধিবেশন। সম্মেলনে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন, আঞ্চলিক সহযোগিতা, কর্মসংস্থান, টেকসই জলবায়ু সমাধান, দারিদ্র্য ও অসমতা, লিঙ্গ সমতা, খাদ্যনিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা ও জ্বালানি নিরাপত্তা সম্পর্কিত ৬৪টি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হচ্ছে। বিশ্বের ১১টি দেশের অর্থনীতিবিদ, গবেষক, উন্নয়নকর্মী ও শিক্ষার্থীরা এ গবেষণাপত্রগুলো উপস্থাপন করছেন।

দ্বিতীয় দিনের ‘‌দি ইমার্জেন্স, অ্যান্ড দ্য রাইজ অ্যান্ড রাইজ অব ডোমিন্যান্ট পার্টি স্টেট ইন বাংলাদেশ: হোয়াট কনসিকোয়েন্স ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট?’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় রেহমান সোবহান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান।

অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, ‘‌এখানে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম ও কম্পিটিটিভ ক্যাপিটালিজমের উত্থান হয়েছে। এর ফলে একশ্রেণীর লোক তাদের ব্যবসা এগিয়ে নিতে রাষ্ট্রক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। ব্যবসায় অংশ নেয়ার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে রাজনীতি। এ প্রবণতা ইউনিয়ন পর্যন্ত চলে গেছে। এখানে নানা রকম প্রকল্পের জন্য টেন্ডারের ওপর নির্ভর না করলে তখন প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক অধিগম্যতার।’

তিনি আরো বলেন, ‘‌এসব কিছুর পাশাপাশি দেশে ডিইনস্টিটিউশনালাইজড হয়েছে। ফলে এখানে আইনের শাসন আছে কিনা কেউ জানে না। যদি কেউ ট্যাক্স কমাতে চায় কিংবা ঋণ কমাতে চায়, তা নির্ভর করে আপনি কে এবং আপনার রাজনৈতিক সংযোগটা কোথায়। কিন্তু উন্নত রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ ফাংশন। যদি সবকিছু বিবেচনামূলক এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে হয় তাহলে রাষ্ট্র ক্রমাগত হবসিয়ান রাষ্ট্রের দিকে এগোয়। রাজনৈতিক দল নিজেই ডিইনস্টিটিউশনালাইজড হয়ে গেছে, যা অধিকতর ভালো সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার জন্য খুব ভয়ানক পরিস্থিতি।’

ড. রওনক জাহান বলেন, ‘‌দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক অবস্থা বুঝতে হলে আমাদের রাষ্ট্র ও দলের সম্পর্ক বুঝতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্তঃকোন্দল বেড়েছে। সবক’টি দলই ভেঙে যাচ্ছে। এখানে পলিটিক্যাল ম্যানেজমেন্ট হচ্ছে। সামনের দিনে এটি অর্ডারলি হবে না বলেই আমার মনে হয়।’

এমএম আকাশ বলেন, ‘‌১৯৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দ্বিদলীয় ব্যবস্থা বিরাজমান ছিল। এ দুটি দলের মধ্যে আদর্শগত কোনো পার্থক্য নেই। দেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থা টেকসই হবে কিনা সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। আমার ধারণা এটি টেকসই হবে না। ভারত ও শ্রীলংকায় একই রকম ডাইন্যাস্টিক ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু সেটি টিকতে পারেনি। এর কারণ হলো যিনি ডাইন্যাস্টিক ব্যবস্থার প্রধান তিনি তো চিরকাল বেঁচে থাকেন না।’

মির্জা এম হাসান বলেন, ‘‌চলতি বছরে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে একটি ওয়ান পার্টি স্টেট বলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু একদলীয় রাষ্ট্র হওয়ার জন্য যা যা দরকার তা বাংলাদেশে নেই। এখানে সরকারি দলের বিরোধী হিসেবে এখনো জাতীয় পার্টি রয়েছে। এছাড়া আরো অনেক রাজনৈতিক দল বিরোধিতা করছে, যেখানে বিএনপিকে নানাভাবে ভেঙে ফেলতে চেষ্টা করছে। যদিও এখনো পারেনি। তবে এটি করতে পারলে বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা সিঙ্গাপুরের মতো হওয়ার আশঙ্কা আছে।’

আশিকুর রহমান বলেন, ‘‌দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের অবস্থা অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। আমাদের এখানে ১৯৯০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চারটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। কিন্তু এর পরও কেন এখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি? এর পেছনে কারণ হলো এখানে একটি আন্ডারলাইন ফল্ট রয়েছে। সেটিই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন