আলোকপাত

নানা নিরীক্ষায় লক্ষ্যহীন শিশুশিক্ষা

এ কে এম শাহনাওয়াজ

মনে পড়ে ২০১৬ সালের কথা। একটি পিএইচডি গবেষকের জুরিবোর্ডে কাজ করার জন্য গিয়েছিলাম পর্তুগালের ঐতিহ্যবাহী ইভোরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একদিন ‘বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ নিয়ে আমার একক বক্তৃতার আয়োজন করেছিল। বক্তৃতায় কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম ইউরোপের ইতিহাস গ্রন্থগুলোয় গর্বের সঙ্গে লিখে থাকে বিশ্ব ইতিহাসে ইউরোপই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছিল। আমি প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক সূত্র দিয়ে দেখিয়েছিলাম তথ্যটি সঠিক নয়। অন্ধকারে আচ্ছন্ন পশ্চিম ইউরোপে প্রাথমিক শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়েছিল নয় শতকে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাঁটি হাঁটি পা পা যাত্রা শুরু হয় ১০ শতকের শেষ পর্যায় থেকে। অন্যদিকে আমার দেশে প্রাথমিক শিক্ষা তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধারায় সাড়ম্বরে যাত্রা শুরু করেছিল এরও সহস্র বছর আগে। 

সে যুগে তিন ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। রাজা-মন্ত্রী-অভিজাতরা গুরুগৃহে অর্থাৎ ধর্মগুরুর বাড়িতে থেকে জ্ঞানার্জনে পুত্রদের পাঠাত। ব্রাহ্মণের ছেলেরা চতুষ্পাঠীতে প্রাথমিক সংস্কৃত শিক্ষা গ্রহণ করত আর সাধারণ পরিবারের সন্তানরা পড়ত পাঠশালায়। বৌদ্ধ পাল শাসনামলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিহারে যাওয়ার আগে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করত সংঘারামে। ১৩ শতকের পর থেকে সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলমান পরিবারের সন্তান মসজিদকেন্দ্রিক মক্তবে প্রাথমিক পাঠ শুরু করে। শাসক ও সুফিদের অনুপ্রেরণায় মুসলিম পরিবারগুলোকে বাধ্য করা হতো সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষা দেয়ার জন্য। উৎসবের মতো করে বিদ্যা শিক্ষার এই প্রারম্ভিক অনুষ্ঠানকে বলা হতো ‘বিসমিল্লাখানি’। আগে অস্তিত্ব থাকলেও নতুন করে বাংলার সমাজে আরো পরে বিসমিল্লাহখানির অনুসরণে হিন্দু সমাজে চালু হয় ‘হাতেখড়ি’। হিন্দু শিক্ষার ক্ষেত্র অনেকটা উন্মুক্ত হয়েছিল মুসলিম শাসন যুগে।

দুর্ভাগ্য, ইতিহাসচর্চার অভাবে এসব ঐতিহ্য আমাদের কাছে অনেকটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। এখন তো আমাদের প্রাথমিক, নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা চলছে নানা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে। কারিকুলাম কিছুকাল পর পর সংস্কারের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন হবে এটিই বাস্তবতা। কিন্তু সংকট হয় তখন যখন সংস্কার বারবার পরীক্ষামূলক হয়ে যায়। শিক্ষা কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। এক বছরের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যায় পরের বছরের শিক্ষা। 

কিছুটা ইতিবাচক দিক বলা যায়, দেশে স্বাক্ষরতার হার বেড়েছে। নারী শিক্ষার অগ্রগতি হয়েছে। এছাড়া বছরের প্রথম দিন স্কুল পর্যায়ে টেকস্ট বুক বোর্ডের বই পৌঁছানোর কৃতিত্ব রয়েছে সরকারের। এর বাইরে সরকারি কৃতিত্ব বড় মুখ করে বলার মতো নেই। সব যুগেই সরকার পক্ষ বড় মুখ করেই বলে থাকে অনেক কিছু।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নজরদারি, টেক্সট বুক বোর্ডের কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট লেখকদের ঐকান্তিকতা এবং শ্রমে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। তবে বইয়ের মানগত দিক এবং প্রকাশনা মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় প্রতিবারই। বই লেখার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত ত্রুটি, লেখক-সম্পাদক নির্বাচনে পক্ষপাত এবং রাজনৈতিক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রে বই রচনাকে মানসম্মত রাখতে দেয়নি। আর দুর্নীতি এবং বাজেট সংকট বইয়ের উৎপাদন মানকে দুর্বল করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।

২০১৫ সালের কথা মনে করতে পারি। বছরের শুরুর পর্বেই আন্দোলনরত স্কুলের নিম্ন বেতনভুক শিক্ষকরা পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের সেল ও লাঠিপেটার শিকার হন। প্রাথমিক ও জুনিয়র পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা পিইসি আর জেএসসি নামের পাবলিক পরীক্ষার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার চাপে গলদঘর্ম হতে থাকে। এই প্রতিযোগিতামূলক সমাজে এসব পদ্ধতি অভিভাবকের পকেট কেটেছে আর রমরমা করেছে গাইড ব্যবসায়ী ও কোচিং ব্যবসায়ীদের পকেট। এর সঙ্গে নতুন ও ভয়ানক উপদ্রব হিসেবে লাগাতার প্রশ্ন ফাঁসের মধ্য দিয়ে কোমলমতি শিশুদের অনৈকিতার হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা অথবা পৃষ্ঠপোষকতায়। ‘পৃষ্ঠপোষকতা’ শব্দে সংশ্লিষ্টজনের মধ্যে আপত্তি থাকতে পারে কিন্তু অমন ‘আপত্তিকর’ শব্দ ব্যবহার করতে হচ্ছে কার্যকারণ সূত্রেই। সে সময় প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি যখন দেশবাসী এবং ভুক্তভোগীদের কাছে স্পষ্ট তখনো ক্রমাগত অস্বীকার করে চলেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই অস্বীকারের অর্থই হচ্ছে ফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার পথ তৈরি করে দেয়া। একই সঙ্গে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শতভাগ পাস আর উজ্জ্বল ফলের বিস্ফোরণ দেখিয়ে সরকারের কৃতিত্ব জাহির করার প্রবণতা কলুষিত করেছে মেধাচর্চার জায়গাটিকে। সরকার পক্ষ অস্বীকার করলেও দেশের সহস্র সহস্র স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা জানেন কোনো এক অলৌকিক নির্দেশনায় তাদের হাত খুলে নম্বর দিয়ে জিপিএ ৫-৪-এর জোয়ার বইয়ে দিতে হয়েছে। এসব কার্যক্রমই শিক্ষার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে। নিম্ন বেতন কাঠামোয় আটকে রেখে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার জন্য মেধাবী শিক্ষকের আকৃষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই। 

লাখ লাখ কিশোর তরুণ কওমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে। অথচ এসব মাদ্রাসার কারিকুলামে তেমন কোনো সংস্কার আনতে পারেনি মাদ্রাসা বোর্ড আর সরকারের মন্ত্রণালয়। আধুনিকায়নের তেমন কোনো পদক্ষেপক গ্রহণ করেনি, বরং রাজনৈতিক কারণে সরকারকে আপস করতে হয়েছে। এসবের ফল হিসেবে মাদ্রাসা শিক্ষা অনেকটা ধুঁকে ধুঁকে চলছে। 

ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও মূলধারার কারিকুলামে তেমন কোনো সমন্বয় সাধিত হয়নি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশ। আমাদের দেশের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর কারিকুলাম লক্ষ করি। এখানে পাশ্চাত্য শিক্ষার কারিকুলামের প্রভাব থাকলেও দেশের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য জানার সুযোগ নেই বললেই চলে। 

গণস্বাক্ষরতা অভিযান নামে একটি শিক্ষা গবেষণা সংশ্লিষ্ট সংস্থা ‘এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্ট -২০১৪’ প্রকাশ করেছিল। এই রিপোর্টে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার দুরবস্থার চালচিত্র প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন কাগজে নানা রিপোর্ট-নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল। এমন ভয়াবহ চিত্র দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। এই রিপোর্ট পড়ে আমার আতঙ্ক হয়তো বেড়েছিল তবে খুব একটা বিস্মিত হইনি। বিস্মিত হবেন না প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভিভাবক ও শিক্ষকগণ এবং অবশ্যই শিক্ষার্থী। এর বড় কারণ অনেক খাটাখাটনি করে গবেষকরা যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তা  জীবন থেকেই নেয়া। আর এ কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে যে অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বসবাস তারা তো প্রতিদিন রিপোর্টে প্রকাশ করা সব সংকটেরই মুখোমুখি হচ্ছেন। 

আমাদের সরকারে থাকা বিধায়করা অহেতুক কিছু হীনম্মন্যতায়   ভোগেন। এর ভেতরে সম্ভবত রাজনীতির অসুস্থ প্রতিযোগিতার চাপও কাজ করে। সরকারের বিধায়করা কেবল প্রশংসা শুনতে চান। সমালোচক তাদের চক্ষুশূল। কিন্তু একবারও বিবেচনা করেন না বহু অর্থ পারিতোষিক নিয়ে যে বিধায়ক আর উপদেষ্টারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের কাজ অনেক সহজ করে দেন বিনে পয়সার গবেষকরা। একটি পরিচ্ছন্ন যুগোপযোগী ও অর্থবোধক শিক্ষা কাঠামো উপহার দিতে চাইলে তো আর প্রকৃত সংকটকে লুকিয়ে রাখা চলে না। সংকট উন্মোচন করে এর প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের কাজ। কিন্তু কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি সরকারের কোনো কাজে খামতি দেখেন, অদক্ষতার ক্ষেত্র চিহ্নিত করেন বা দুর্নীতির চিত্র উন্মোচন করেন তখন আত্মসমালোচনায় না গিয়ে রে রে করে তেড়ে আসতে চায় সরকার পক্ষ।

এসব সংকটের উৎস খোঁজা প্রয়োজন সবার আগে। এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার কারিকুলাম এবং পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে শুরুতে কথা বলতে হয়। আমার পর্যবেক্ষণে প্রাথমিক স্তরের জন্য প্রণীত বইগুলো আরো সুবিন্যস্ত হতে পারত। যতটা তথ্যসমৃদ্ধ, সুলিখিত ও সাবলীল হওয়া উচিত ছিল তেমনটি হয়নি বলে অনেক অভিভাবক ও শিক্ষকের মন্তব্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পিইসি নামে সনদপ্রাপ্তির সমাপনী পরীক্ষা। শিক্ষানীতিতে জেএসসি পরীক্ষার প্রস্তাব থাকলেও প্রাথমিক স্তরে পিইসি পরীক্ষার কথা ছিল না। কিন্তু কাদের উর্বর চিন্তা থেকে অমন পরীক্ষার সংযুক্তি ঘটল জানি না। এই পরীক্ষা নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আমরা বুঝেছিলাম এই হাইব্রিড চিন্তা বেশিদিন বজায় রাখা সম্ভব হবে না। অবশেষে অনেক তেল পুড়িয়ে বন্ধ করতে হলো। শোনা যাচ্ছে আবারো নাকি পিইসি জেএসসি ফিরিয়ে আনার চিন্তা চলছে। পাঠ্যপুস্তকের দুর্বলতা এবং পিইসি পরীক্ষার অপ্রয়োজনীয় চাপে পড়ে শিক্ষার্থীদের বড় অংশ পাঠ্যবইয়ের বদলে ঝুঁকে পড়েছিল গাইড বইয়ের দিকে। অর্থাৎ শিক্ষাজীবনের শুরুতেই জ্ঞানার্জনের বদলে শর্টকাট পথে গ্রেড অর্জনের প্রতিযোগিতায় নেমে যেতে হচ্ছে। এ কারণেই অভিভাবকদের মেনে নিতে হয়েছে কোচিং বাণিজ্যের বন্দিত্ব।  

শুনেছি গাইড বই এবং কোচিং-নির্ভরতা জেএসসি পরীক্ষার সূত্রে ক্লাস সিক্স থেকে আরো বেড়ে যায়। তা ভয়ংকর রূপ নেয় এসএসসি পর্বে প্রবেশের পরে। নতুন কারিকুলামে অবশ্য স্কুল সমাপনি পরীক্ষা আরো পরে হবে। আমি বছরের শুরুতে বিনামূল্যে বই বিতরণের কৃতিত্ব দেই সরকারকে। কিন্তু পাশাপাশি বলি, বিশেষ করে যেখানে গাইড বইয়ের দাপটে পাঠ্যবই (এনসিটিবি থেকে প্রকাশিত টেকস্ট বই) অপাঠ্য হয়ে গেছে সেখানে রাষ্ট্রের এত সহস্র মুদ্রা ব্যয়ের প্রয়োজনটি কী!

বারবার নিরীক্ষা হচ্ছে শিশুশিক্ষার কারিকুলাম ও পুস্তক প্রণয়ন নিয়ে। আমি দীর্ঘদিন এনসিটিবির কারিকুলাম তৈরি ও পুস্তক প্রণয়নে যুক্ত ছিলাম। তখন এতটা বিতর্ক ছিল না। বুঝেছিলাম শিশুশিক্ষার কারিকুলাম ও পুস্তক প্রণয়নে যুক্ত থাকতে হয় অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের। কিন্তু এনসিটিবি তা থেকে বেরিয়ে এসে পছন্দের নবিস দিয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে চাইলেন। তাই অচীরেই বাতিল করতে হলো বিগত শিক্ষাবর্ষে চালু করা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর বেশ কয়েকটি পাঠ্যবই। আবারো এবার নিরীক্ষা করা হলো। শিক্ষার্থীদের আধুনিক বিজ্ঞানমনষ্ক করার জন্য অনেকটা পরীক্ষার ভারমুক্ত করে নিরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেয়া হলো বিদেশী মডেল প্রয়োগ করে। উদ্দেশ্য হয়তো ভালো। তবে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে দেশের বাস্তবতা মানা হয়নি অনেক ক্ষেত্রে। বর্তমান ব্যবস্থায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক রয়েছে আর ভীতি তৈরি হয়েছে দরিদ্র অভিভাবকের মনে। আমরা চাইব বিষয়সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে দেশের বাস্তবতা মেনে নিরীক্ষার বদলে বাস্তবায়নযোগ্য কারিকুলামে শিশুশিক্ষা এগিয়ে যাক।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন