ক্যাম্পাসে গানের দল

ত্রিশ ব্যান্ডের ক্যাম্পাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আনিসুর রহমান

টিএসসিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যান্ড সোসাইটির সহযোগিতায় লেটস ভাইব আয়োজিত কনসার্টে গান করছে ব্যান্ড কোলস্লো ছবি: ডিইউবিএস

ভালো লাগা থেকে গান করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একদল শিক্ষার্থী। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ক্যাম্পাসের এখানে-সেখানে দল বেঁধে গান করতেন তারা। কলা ভবন, টিএসসি, ডাকসু ভবনসহ পুরো ক্যাম্পাসে ছিল তাদের প্র্যাকটিস রুম। একসঙ্গে চলতে চলতে ২০০২ সালে গড়ে তোলেন ব্যান্ড। প্রয়াস ছিল নতুন গান ও ভাবনা শ্রোতাদের উপহার দেয়া। এভাবেই গড়ে ওঠে আজকের জনপ্রিয় ‘চিরকুট’। বর্তমান সময়ে দেশের প্রথম সারির অন্যতম চাহিদাসম্পন্ন ব্যান্ড চিরকুট। হৃদয়গ্রাহী ও মানসম্মত কথা, সুর, দর্শন, লাইভ পারফরম্যান্সে যারা জায়গা করে নিয়েছেন কোটি মানুষের হৃদয়ে। দাপিয়ে বেড়ানো এ ব্যান্ডের যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ২১ বছরের পথচলায় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলা গান করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, ইন্ডিয়া, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বড় বড় সংগীত উৎসবে। পারফর্ম করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভেন্যু ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে। মঞ্চ শেয়ার করেছেন বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ড ‘স্করপিয়ন্স’-এর সঙ্গেও। 

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ব্যান্ড গঠনের কথা স্মরণ করে চিরকুটের প্রধান ভোকালিস্ট শারমীন সুলতানা সুমি বলেন, ‘‌আজকের চিরকুট যে অবস্থানে এসেছে, দেশে-বিদেশে শ্রোতাদের ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছে; এসবের সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পড়াশোনার পাশাপাশি আমাদের জীবন সংগ্রামের ওই সময়টাতে এ  বিশ্ববিদ্যালয়ের আলো-ছায়া-বাতাস, গাছ-পাখি, কৃষ্ণচূড়া, সোনালু-জারুল ফুল; রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া কুকুর, হাকিম চত্বর কিংবা তুমুল বৃষ্টিতে ক্লাস ফাঁকি দেয়া বটতলার আড্ডা—এ সবকিছুই চিরকুটের ভিত। এখনো প্রতিটি সাফল্যের পর চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে কলা ভবনের বারান্দা, লাইব্রেরি চত্বর, জয়ধ্বনির কক্ষ আর আমাদের ভালোবাসার গানগুলো নিয়ে ছুটে চলার দিনগুলো। এ সবকিছুর কাছে আমি ঋণী, চিরকুট ঋণী।’

শুধু চিরকুট নয়, ঢাবিতে গড়ে ওঠা এমন ব্যান্ডের সংখ্যা এখন ৩০টির অধিক। এগুলোর মধ্যে মেঘদল, জলের গান, ব্ল্যাক, আর্বোভাইরাস, সহজিয়া, ব্লু জিন্স, জয় শাহরিয়ার, কৃষ্ণপক্ষ, সর্বনাম ও মেহেরিন দেশব্যাপী জনপ্রিয়। এছাড়া আপেক্ষিক, দুর্গ, ইন্ট্রোয়েট, জংশন, কোলস্লো, লিসান অ্যান্ড দ্য ব্লাইন্ড ম্যান, ফিউজড, সাইরেন, বন্দিশ, ক্র্যাক প্লাটুন, আপন ঘর, অর্জন, অসৃক, শুভযাত্রা, ক্রাইনেশন, কাল, অবলিকের মতো ব্যান্ডগুলোর মাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশিত মৌলিক গানগুলো শ্রোতাদের প্রশংসা কুড়াচ্ছে। 

ঢাবির ব্যান্ডগুলো সাধারণত দুটি ধারায় গান করে—রক ও ফোক। রক ব্যান্ডগুলো আবার সাইকাডেলিক, প্রগ্রেসিভ, মেটাল, পপ সাবক্যাটাগরিতে বিভক্ত। আপেক্ষিক, দুর্গ, ইন্ট্রোয়েট, জংশন, কোলস্লো, ফিউজড, সাইরেন, ক্র্যাক প্লাটুন, লিসান অ্যান্ড দ্য ব্লাইন্ড ম্যান, অর্জন, শুভযাত্রা, ক্রাইনেশন, কাল, অবলিক রক ব্যান্ড হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে ফোক ব্যান্ডের মধ্যে রয়েছে কৃষ্ণপক্ষ, সর্বনাম, জলের গান, জংশন ও আপন ঘর। 

ব্যান্ডগুলোর কাজের ধরন নিয়ে কথা হয় ক্যাম্পাস ব্যান্ডগুলোর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যান্ড সোসাইটির সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী শিবলী হাসান জয়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘‌আবহমান বাংলার লোকসংগীত ফিউশনের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে ফোক ব্যান্ডগুলো। রক ব্যান্ড মূলত এসেছে পশ্চিম থেকে। ব্যক্তিগত আনন্দ, উচ্ছ্বাস, প্রেম-বিরহের পাশাপাশি এ গানগুলোর মূলে থাকে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সংকট। তবে বিদ্যমান সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমানে রক ব্যান্ডগুলোর বিষয়বস্তু হয়ে উঠছে ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপড়েন।’

শুধু মনোরঞ্জনের বিষয় নয়, গানকে মানবিকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে ঢাবির ব্যান্ডগুলো। বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও অগ্নিকাণ্ডসহ যেকোনো প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অভিপ্রায়ে গানকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন তারা। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম ক্যাম্পাসভিত্তিক ব্যান্ড মিউজিক্যাল সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যান্ড সোসাইটি বিদ্যমান ব্যান্ড দলগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। এ বিষয়ে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী এএসএম কামরুল ইসলাম বলেন, ‘‌শিল্পী তৈরির মাধ্যমে ব্যান্ড সংগীতের চর্চা বাড়ানোর লক্ষ্যে শুরু থেকে আমরা ক্যাম্পাসে বিভিন্ন কনসার্ট, সেমিনার, ওয়ার্কশপ আয়োজন করছি। সংগঠনের সার্বিক সহযোগিতায় বছরজুড়ে আয়োজিত কনসার্টে নতুন নতুন ব্যান্ডকে প্লাটফর্ম দেয়া হয় যেন তারা সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠতে পারে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন