উদ্যমী তরুণ নেতৃত্ব গড়ে তুলছে সেভ ইয়ুথ

শফিকুল ইসলাম

ইয়ুথ প্রমিজ লিডারশিপ সামিট-২০২৩-এ অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছবি: সেভ

বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের দক্ষ নেতৃত্ব হিসেবে গড়ে তুলছে ‘‌ সেভ’। স্টুডেন্টস অ্যাগেইনেস্ট ভায়োলেন্স এভরিহয়্যারের সংক্ষিপ্ত রূপ (এসএভিই) সেভ। শান্তির প্রচার, সহিষ্ণুতা, বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচার এবং নারী-পুরুষ, সক্ষম-অক্ষম নির্বিশেষে সমাজের সবার অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সংগঠনটি। পাঁচ বছর ধরে সব ধরনের সংঘাতের বিরুদ্ধে প্রচারণার পাশাপাশি সংগঠনটি শিক্ষার্থীদের সমাজিক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক সচেতনতা ও সক্ষমতা উন্নয়নে ভূমিকা রেখে আসছে।

সেভ সদস্যরা সমাজের ছোট সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করেন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কৌশল, ধর্ম এবং বিজ্ঞানের সম্পর্ক, পরিবেশ সচেতনতা, ডিজিটাল স্পেসে নিরাপদে কাজ করার কৌশলসহ আরো অনেক কিছু, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের কমিউনিটিতে এসব কৌশল ব্যবহার করে সমাজের জন্য কাজ করে যেতে পারেন। সেভ থেকে এক ধরনের পরিবর্তন তত্ত্ব প্রচার করা হয়, যাতে তরুণ প্রজন্ম বিভিন্ন গঠনমূলক কাজে যুক্ত থাকার মাধ্যমে সহিংস সংগঠনে যুক্ত হওয়া থেকে বিরত থাকেন। পাশাপাশি তরুণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের ক্যাম্পাস, নিজ এলাকা, কর্মক্ষেত্রে সারা জীবন শান্তির বাণী প্রচারের দূত হিসেবে কাজ করেন। 

এ লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, তরুণ সংলাপ, ইয়ুথ সামিট আয়োজন, বিতর্কসহ ক্যাম্পাসভিত্তিক নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে সংগঠনটি। সেভ ইয়ুথ এ পর্যন্ত প্রায় ৬০টির অধিক দিনব্যাপী ক্যাম্পাস কর্মশালা, শতাধিক ওয়েবিনার এবং চারটি সামিট আয়োজন করেছে। প্রতি বছর সারা দেশ থেকে তিন শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে আয়োজিত হয় ইয়ুথ প্রমিজ লিডারশিপ সামিট। প্রায়ই সেভ সদস্যরা অনলাইন ও অফলাইনে বিভিন্ন সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন আয়োজন করেন। এর মধ্যে রয়েছে ঘৃণামূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা, ডিজিটাল স্পেসে একজন মানুষের অধিকার এবং দায়িত্ব নিয়ে সচেতন করা, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দিবস উদযাপনের মাধ্যমে সচেতনতা গড়ে তোলা। 

২০১৮ সালে যাত্রা করে বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজারের বেশি তরুণ শিক্ষার্থী সেভের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বর্তমানে ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করছে সংগঠনটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আইনুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বা একাধিক তরুণ শিক্ষক মডারেটরের তত্ত্বাবধানে সেভ চ্যাপ্টারগুলো পরিচালিত হচ্ছে। 

সেভের কাজগুলো পরিচালনার জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২ সদস্যবিশিষ্ট একটি কার্যকরী কমিটি রয়েছে। কো-প্রেসিডেন্ট এবং সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে কমিটিতে আরো বিভিন্ন বিষয় যেমন সি-লিডস, গণতন্ত্রে তরুণদের ভূমিকা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা উন্নয়ন এবং অন্তর্ভুক্তি, ক্যাম্পাস রেজিলিয়েন্স, তরুণদের মন ও মানসিক স্বাস্থ্যসহ নানা বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য তরুণদের দায়িত্বে নিয়ে আসা হয়। 

প্রতিটি সদস্যকে একটি দিনব্যাপী মৌলিক কর্মশালার মাধ্যমে সেভের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়, যেখানে তরুণরা দিনব্যাপী শান্তি, সহিষ্ণুতা ও বৈচিত্র্য নিয়ে তাত্ত্বিক ধারণা ও অনুশীলন করেন। সদস্য হওয়ার পর তাদের বিভিন্ন উন্নত প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যার মাধ্যমে একজন সদস্য একাডেমিক গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পাশাপাশি একজন সেভ গ্র্যাজুয়েট হিসেবেও গড়ে ওঠেন। 

সেভের সদস্যরা নিজ কমিউনিটিতে বিরোধ নিষ্পত্তিতে ভূমিকা রাখছেন। যেমন একজন সেভ ইয়ুথ সদস্য দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ রঘুনাথপুর গ্রামে সাঁওতাল সম্প্রদায় এবং বাঙালিদের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য তার অভিনব কৌশল প্রয়োগ করে তাদের মধ্যে একটি ফুটবল খেলার আয়োজন করেন। যার মাধ্যমে উভয়ের দূরত্ব কমে আসে। আবার আরেক সেভ ইয়ুথ সদস্য তার নিজ উদ্যোগে এবং বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার প্রত্যন্ত রানিপুরায় দুই গ্রামের মধ্যে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সাঁকো নির্মাণ করে তাদের মধ্যে চলমান দীর্ঘদিনের বিরোধ নিষ্পত্তিতে ভূমিকা রাখেন। এ রকম কাজের মাধ্যমে সেভ ইয়ুথের উদ্যমী তরুণ শিক্ষার্থীরা সামাজিক সমস্যা নিষ্পত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন, যা তাদের একধরনের সামাজিক নেতা হিসেবে গড়ে তুলছে। সেভ শিক্ষার্থীদের ইয়ুথ ফেলোশিপ, ইন্টার্নশিপসহ বিভিন্ন গবেষণা কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণে ভূমিকা রেখে চলেছে। দেশের একজন ইনফর্ম নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠছেন সেভের প্রতিটি সদস্য। 

সেভের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে। মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তরুণ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশে ভূমিকা রাখা এবং সমাজের ছোট সমস্যাগুলো সমাধানে সেভের নেতৃত্বে কাজ করে যাওয়া। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সেভ নেতৃত্ব একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যবিহীন ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের প্রচেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে শ্রীলংকা, ইথিওপিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেভের আদলে প্রোগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ সেভের তরুণ নেতৃত্ব আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন। 

সেভ ইয়ুথ বাংলাদেশের ন্যাশনাল মডারেটর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্যাম্পাসে যেন কোনো সহিংসতা না হয় সে লক্ষ্যে কাজ করার মধ্য দিয়ে সেভের যাত্রা শুরু হয় ২০১৮ সালে। দীর্ঘদিন পর ডাকসু নির্বাচন হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীরা যাতে কেউ সহিংসতায় না জড়ান এবং অন্যকে সহিংসতা থেকে দূরে রাখা, ক্যাম্পাসে সহনশীলতা প্রমোট করা এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করতে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। তবে আমাদের কাজ শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। অন্যান্য যুব সংগঠনের থেকে সেভ আলাদা এ কারণে যে শিক্ষার্থীদের ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা যেন সামাজিক, রাজনৈতিক দায়িত্ব বুঝতে পারেন সে ব্যাপারে তাদের নেতৃস্থানীয় হিসেবে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেভ শুধু একটি সংগঠন নয়। এটি একটি সামাজিক আন্দোলন বলা যেতে পারে। যেখানে সামাজিক নেতৃত্ব তৈরি, রাজনৈতিক সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ, সহিংসতার প্রতি না বলা—এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হয়। আমাদের লিডারশিপ প্রশিক্ষণ সামাজিক নেতৃত্ব তৈরি করছে। সেভ তার সদস্যদের শেখায় ‘‌লিডারশিপ ইজ আ চয়েজ’, সমাজের প্রয়োজনে তরুণদের সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে এগিয়ে আসতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন