স্মরণ

আকবর আলি খানের সমাজ ও অর্থনৈতিক ইতিহাস অন্বেষা

ড. কাজল রশীদ শাহীন

আকবর আলি খানের বিশেষ আগ্রহ ছিল বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা অনুসন্ধান। লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা’ এবং ‘বাংলায় ইসলাম প্রচারের সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ’ নামে গবেষণালব্ধ দুটি বই, যা আমাদের সমাজ ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের ভিত্তি নির্মাণে পালন করেছে যুগান্তকারী ভূমিকা।

তিনি ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। উচ্চতর শিক্ষা নিয়েছেন অর্থনীতিতে। একজন ব্যক্তি কীভাবে প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন। দেশ ও জাতির দিশা হয়ে দেখা দেন, আকবর আলি খান সেসবের জ্যোতির্ময় উদাহরণ। যিনি ইহজাগতিক যাত্রা শুরু করেছিলেন ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে। সমাপ্ত করেছেন ২০২২-এর ৮ সেপ্টেম্বর। এক বছর হলো, তিনি আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার লেখা বইগুলো রয়েছে, যা পাঠে আমরা পাই তার প্রজ্ঞার পরশ। অর্থনৈতিক ইতিহাসের গভীরতর অনুসন্ধান, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও চিত্তাকর্ষক মূল্যায়ন। 

আকবর আলি খান বিশ্বাস করতেন, ধর্ম নিরপেক্ষতার জন্য গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বাস্তবায়ন করা জরুরি। সমাজতন্ত্র অর্থ কেবল মার্ক্স, লেনিনের সমাজতন্ত্র নয়, স্থানীয়ভাবেই সমাজতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব। তার এষণা হলো, গণতন্ত্র না থাকলে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা কোনোটাই বাস্তবায়ন ও টেকসই করা সম্ভব নয়। তার একমাত্র সন্তান নেহরীন খানের ইচ্ছা ছিল—বাবা যেন সবিস্তারে লেখে পূর্বপুরুষের ঠিকুজি। কন্যা মারা যাওয়ার পরও তিনি আত্মজার সেই ইচ্ছার কথা বিস্মৃত হননি, লিখেছেন আত্মস্মৃতিমূলক বই, ‘পুরানো সেই দিনের কথা’। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তিনি, যার পরিপ্রেক্ষিত কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘একজন সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে আমি যুদ্ধে যোগ দিইনি। যোগ দিয়েছিলাম যখন দেখলাম ওরা নির্বিচারে আমার দেশের মানুষকে হত্যা করছে। দেশের মানুষের প্রতি এই অবিচার-অন্যায় আমি সহ্য করতে পারিনি। এসব দেখে-শুনে আমার মনে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে—আমি যুদ্ধে যোগ দিয়ে সেই দায় মিটিয়েছি।’ উল্লেখ্য, পাকিস্তান সরকারের একজন চাকরিজীবী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যারা যোগ দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন একেবারে শুরুর দিকের একজন। একজীবনে যতটা ঝুঁকি নেয়া যায় ঠিক ততটাই নিয়েছিলেন। ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে ট্রাকে করে ৩ কোটি টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন যুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার পরিচালনার সুবিধায়-মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে। এসবের কারণে তার অনুপস্থিতিতে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেয় পাকিস্তান সরকার। তিনি মনে করতেন, বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হওয়া।

যতদিন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি থাকবে ততদিন আকবর আলি খানের গবেষণানিষ্ঠ কাজগুলো তাকে স্মরণীয়, প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় করে রাখবে। কারণ তিনি আমাদের জাতিসত্তার অন্বেষণে ব্রতী ছিলেন। ‘বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা’, ‘বাংলায় ইসলাম প্রচারের সাফল্য একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ’ বইয়ের ভেতর দিয়ে তিনি আমাদের শিকড়ে নতুন আলো খোঁজার চেষ্টা করেছেন। নতুন চিন্তাকে হাজির করেছেন। রিচার্ড ইটন, অসীম রায়ের গবেষণার বাইরেও তার জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধান জ্ঞানকাণ্ডের এ ধারায় নতুনমাত্রা যুক্ত করেছেন। শুধু এ বই দুটিতে নয়, আকবর আলি খানের বইয়ের বিশেষত্ব হলো সব কাজেই অনুসন্ধান করেছেন বহুমাত্রিক অর্থ। 

আকবর আলি খান অর্থনীতিতে শ্লেষের আশ্রয়ে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় যুক্ত করেছেন, যা যতটা প্রশংসিত ঠিক ততটা আলোচিতও। ‘শুয়োরের বাচ্চার অর্থনীতি’, ‘সুকতলার অর্থনীতি’, ‘জুতার রাজনীতি’, ‘জন্মদিনের অর্থনীতি’ প্রভৃতি। এসব বিষয় যে একেবারে আনকোরা তা নয়। ব্রিটিশ শাসনের সময়ই ‘শুয়োরের বাচ্চার অর্থনীতি’র বিষয়টা সেই সময়ের প্রশাসনে আলোচিত ছিল। আকবর আলি খান স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতায় নতুন করে এসবের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।

আকবর আলি খান সামাজিক পুঁজির তত্ত্বকে গবেষণায় ব্যবহার করে নতুন তত্ত্ব হাজিরপূর্বক তাৎপর্যবাহী উপসংহারে পৌঁছেছেন। আমাদের জাতিসত্তার অন্বেষায় যেখানে রিচার্ড ইটন, অসীম রায় নজর দেননি, সেখানেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তার যৌক্তিকতাও উপস্থাপন করেছেন। সামাজিক পুঁজির ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান পাকিস্তান, ভারতের চেয়ে কম নয় শুধু, গড় সামাজিক পুঁজির পরিমাণেও আমরা পিছিয়ে। আমাদের সমাজের এ প্রবণতা কেন এবং কবে থেকে তা জারি রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

বাংলাদেশের সমাজ ও প্রাচীন বাংলার সমাজের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো এখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রকাশটা বেশি। যেটা পশ্চিমবঙ্গেও এভাবে নেই, ভারতের অন্যত্রও নেই, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায়ও নেই। আকবর আলি খান মনে করেন, আমাদের সমাজ রাষ্ট্রকে বুঝতে এবং আমাদের জাতিসত্তার প্রশ্নের ফয়সালায় সমাজের এসব বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপ সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে জানতে হবে। 

বাঙালি মুসলমানের ঠিকুজি অন্বেষণে রিচার্ড ইটন, অসীম রায়ের বাইরে আকবর আলী খান হেঁটেছেন ভিন্ন পথে, স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে। তিনি মূলত ‘টেক্সট টু টেক্সট’ পদ্ধতিতে দাঁড় করিয়েছেন এতদ্বিষয়ক অনুসন্ধান এবং তা থেকে প্রাপ্ত নতুন ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। 

‘বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ’ বইয়ে আকবর আলি খান চারটি প্রশ্ন হাজির করেছেন। 

প্রথম প্রশ্ন. ‘বাংলার বেশির ভাগ মুসলমান স্থানীয় ধর্মান্তরিত হিন্দুদের বংশধর। কিছু বিদেশী অভিবাসী এর মধ্যে রয়েছে। এদের বেশির ভাগ নিম্নবর্ণের ধর্মান্তরিত হিন্দুদের বংশধর। নৃতাত্ত্বিক গবেষণা এ অনুমানকেই সমর্থন করে। তবে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে যথেষ্ট ঐতিহাসিক উপাদান/প্রমাণ নেই। মধ্যযুগের ঐতিহাসিকরা রাজা-বাদশাহদের ইতিহাস লিখেছেন, নিম্নবর্ণের মানুষদের নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। তাই নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ধর্মান্তর সম্পর্কে যথেষ্ট ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায় না।’

আমরা মনে করি, ‘বাংলার বেশির ভাগ মুসলমান স্থানীয় ধর্মান্তরিত ‘হিন্দু’দের বংশধর নন। বিদেশী অভিবাসীর সংখ্যাও খুবই কম। সেই তুলনায় বরং ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে বাংলায় বেশি সংখ্যক অভিবাসী হয়েছে। বাংলায় মুসলমানের আগমন ও বসতি শুরু হয়েছে রিচার্ড ইটন, অসীম রায় ও আকবর আলি খান যে সময়ের কথা বলছেন তার কয়েকশ বছর আগে। আমাদের মত হলো, হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই এখানে ইসলামের আগমন ঘটে। বিশেষ করে তার মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে যখন চারদিকে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হচ্ছে তখনই এখানে শাসন ক্ষমতার বাইরে ইসলামের প্রচার ও প্রসার শুরু হয় আরব বণিকদের মাধ্যমে। তখন বাংলায় চলছিল রাজনৈতিক মাৎস্যন্যায়। সিল্করোডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল এ অঞ্চল। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, জৈন ধর্ম, বৈষ্ণব ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, শাক্ত ধর্মের তখন ক্ষয়িষ্ণু সময়। এসব বিষয় মনে রাখলে মুসলমান হওয়ার প্রকৃত কারণ বুঝতে সুবিধা হয়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সপ্তম শতাব্দীতে এ অঞ্চলে রাষ্ট্রকূট রাজাদের প্রযত্নে বেশ কয়েকটি মসজিদ স্থাপন হয়। 

দ্বিতীয় প্রশ্ন. কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, বাংলায় মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার আগেই ইসলাম প্রচার শুরু হয়। এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে আরব বণিকরা বাংলায় ব্যবসা করলেও তারা এখানে ইসলাম প্রচার করেননি কিংবা বসতি স্থাপন করেননি। যেখানে আরব বণিকরা বসতি করেছেন, সেখানে শাফেয়ি মজহাবের প্রাধান্য দেখা যায়। বাংলার কোথাও মুসলমানদের মধ্যে শাফেয়ি মজহাবের অস্তিত্ব দেখা যায় না।

বাস্তবিকই বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার আগেই ইসলাম প্রচার শুরু হয়েছে। ভারতের কেরালা প্রদেশে হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত একটি মসজিদ এবং বাংলাদেশের লালমনিরহাটের রামদাস গ্রামে ৬৯ হিজরি অনুযায়ী ৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত একটি মসজিদ তার প্রমাণ। বাংলায় ও ভারতবর্ষে হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর অঙ্গুলি নির্দেশে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনা প্রচলিত রয়েছে। সেটা রাজা নিজে দেখে, রাজকন্যার দর্শন থেকে শুনে এবং স্বপ্নযোগে জানার পর আরব বণিকদের মাধ্যমে তার সত্যতা যাচাই করে ধর্মান্তরিত হওয়ার একাধিক কাহিনী এখনো প্রচলিত রয়েছে। এ কাহিনীতে কেবল রাজাই ধর্মান্তরিত হয়েছে বলে উপস্থাপিত হয়েছে। রাজা যদি ধর্মান্তরিত হয়, তার সঙ্গে প্রজারাও কিছু সংখ্যক হলেও ধর্মান্তরিত হবে—এটাই কি স্বাভাবিক ও যুক্তিযুক্ত নয়? আরব বণিকরা এখানে বসতি স্থাপন করেননি—এ মত আক্ষরিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। হাজার বছরের পুরনো চট্টগ্রামের আরব কলোনি এ যুক্তিকে সত্যরূপে হাজির করে। শাফেয়ি মজহাবের প্রাধান্যের কথা বলা হয়েছে, আমরা যে সময়ের কথা বলছি তখন ইসলামে মজহাবের ধারণাগত কোনো ভিত্তিই প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

তৃতীয় প্রশ্ন, বাংলায় ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন সুফি, দরবেশ ও পীররা। পীরদের মাজেজায় অভিভূত হয়ে তাদের জীবদ্দশায় অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তাদের মৃত্যুর পর দরগার মাধ্যমে অনেক বিধর্মীকে ইসলাম ধর্মে আকৃষ্ট করা হয়েছে। সুফি, পীর ও দরবেশ ভারতের সর্বত্রই ইসলাম প্রচার করেছেন। কিন্তু বাংলার বাইরে তারা তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। তার কারণ হলো, বাংলার বাইরের গ্রামগুলোয় শক্তিশালী সামাজিক সংগঠন ছিল। এ সামাজিক সংগঠন অস্বীকার করে মুসলমান হওয়া অনেক শক্ত ব্যাপার ছিল। বাংলায় সামাজিক সংগঠন ছিল দুর্বল। তাই এখানে মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে পেরেছে।

সুফিরা ইসলামের প্রসারে যতটা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে তার চেয়ে অধিক ভূমিকা পালন করেছে ইসলামের ভিত্তি শক্তিশালীকরণে। ইসলামের প্রচার ও প্রসার সুফিরা আসার আগেই প্রবহমান ছিল এবং বাংলার গ্রাম সমাজে ইসলাম ধর্মের অনুসারী মানুষের বসবাস ছিল। তবে তারা যে খুব শক্তভাবে ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিলেন এমনটা নয়। সুফিদের যখন আগমন শুরু হয় তখন বাংলায় মুসলমান রাজাদের শাসনকাল হলেও স্থানীয়ভাবে দাপুটে হিন্দু রাজা ছিল। সুফিরা আসায় তাদের দাপট ফিকে হয়ে আসে এবং যারা ইসলামের অনুসারী ছিল আবার অন্য ধর্মের সংস্কার-কৃত্য ও রীতিনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিল। ওই সময় তারা শক্তভাবে ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়ে ওঠেনি। পাশাপাশি সুফিদের কারণে অন্য ধর্মাবলম্বী যারা নামেমাত্র ধর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল কিংবা সেই অর্থে কোনো ধর্মই পালন করত না তারা ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কোথাও কোথাও পরিস্থিতিও বাধ্য করে ঝুঁকতে।

আকবর আলি খান মনে করেন, সামাজিক সংগঠনের কারণেই ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য পাওয়ার অন্যতম একটা কারণ। তিনি মনে করেন বাংলার সামাজিক সংগঠন দুর্বল ছিল। অন্যত্র শক্তিশালী সামাজিক সংগঠন থাকায় সেই বেষ্টনী ভেদ করে কারো পক্ষে ধর্মান্তরিত হওয়া সহজসাধ্য ছিল না।

আমরা মনে করি, সামাজিক সংগঠনের এ রহস্য লুকিয়ে রয়েছে বাংলার নদী সংস্কৃতির ভেতরে। এখানে প্রশ্নটা দুর্বলতা বা সবলতার নয়। প্রশ্নটা সেই সমাজ গড়ে উঠছে কোথায় এবং তার সঙ্গে নদ-নদীর সম্পর্ক কী। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে নদ-নদী থাকলেও বাংলার মতো এত সংখ্যক নদীর উপস্থিতি নেই। এমনকি আমরা যদি পশ্চিমবঙ্গের দিকে খেয়াল করি তাহলে দেখব সেখানকার চেয়ে এখানে নদীর উপস্থিতি রয়েছে বেশি। এখানে ব্যক্তির মতো সমাজও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিটে বিভক্ত থাকে এবং প্রত্যেকেই নিজের মতো করে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করে। ১৮৭২ সালের আদমশুমারিতে প্রথমবারের মতো জানা গেল বাংলায় মোট জনসংখ্যা ৩৫ লাখ ৭৬৯ হাজার ৭৩৫ জন। এর মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যা ১৮ লাখ ২০০ হাজার ৪৩৮ জন এবং মুসলমান জনসংখ্যা ১৭ লাখ ৬০৯ হাজার ১৩৫ জন; বাকিরা ছিল অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত। শতকরা হিসাবে মোট জনসংখ্যার তুলনায় হিন্দুর হার ছিল ৫০ দশমিক ১ শতাংশ আর মুসলমান ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ। পরের আদমশুমারিতে পাল্টে যায় এ চিত্র। ১৮৮১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায় মোট জনসংখ্যা ৩৫ লাখ ৬০৭ হাজার ৬৬৮ জন। এর মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যা ১৬ লাখ ৩৭০ হাজার ৯৬৬ জন এবং মুসলমান জনসংখ্যা ১৭ লাখ ৮৬৩ হাজার ৪১১ জন। শতকরা হিসাবে হিন্দু ৪৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং মুসলমান ৫০ দশমিক ১৬ শতাংশ। প্রথম জনগণনার তুলনায় দ্বিতীয় জনগণনায় দেখা গেল মুসলমানের সংখ্যা ১৫ লাখ বেড়েছে। আমরা মনে করি, এর বাস্তব কারণ অনুসন্ধান করতে হলে আমাদের নদী সংস্কৃতির গভীরে যেতে হবে।

চতুর্থ প্রশ্ন, অধিকাংশ আধুনিক ঐতিহাসিকই মনে করেন যে বাংলায় পীরদের উদ্যোগে ইসলাম প্রচার হয়েছে। কিন্তু কেন পীররা বাংলায় সফল হন অথচ ভারতের অন্যত্র ব্যর্থ হন, এ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। অসীম রায় মনে করেন, বাংলার নিষ্ঠুর প্রাকৃতিক পরিবেশে পীররা জলাভূমির মানুষের আধ্যাত্মিক প্রয়োজন মিটিয়ে ছিল। তাই স্বল্প সময়ে বাংলায় পীরদের উদ্যোগে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের গণধর্মান্তর ঘটে। অল্প সময়ে (১০০-২০০ বছরে) এ ধর্মান্তর ঘটেছে। তবে কখন এ ধর্মান্তর ঘটেছে অসীম রায় সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করেননি। রিচার্ড ইটন ও অসীম রায়ের সঙ্গে একমত যে বাংলায় হিন্দুদের গণধর্মান্তর ঘটেছে উদ্যোক্তা-পীরদের উদ্যোগে। যারা পশ্চিম বাংলার মৃতপ্রায় বদ্বীপ অঞ্চল থেকে দুর্দশাগ্রস্ত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের পূর্ব বাংলার সক্রিয় বদ্বীপে বসতি স্থাপন করেন। ইটন মনে করেন, মোগল আমলে (১৪৫০-১৬০০ সাল) বাংলায় মুসলমান সংখ্যাধিক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সম্পর্কে দুটি প্রশ্নে এখনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রথম প্রশ্ন হলো, বাংলায় ইসলাম কি গোষ্ঠীগত পর্যায়ে প্রচারিত হয়েছে, না ব্যক্তিক পর্যায়ে প্রচারিত হয়েছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, বাংলায় ইসলাম প্রচার কি স্বল্প সময়ে হয়েছে, না অনেক দিন ধরে হয়েছে? 

উপর্যুক্ত প্রশ্নে পীরদের উদ্যোগে ইসলাম প্রচার হয়েছে বলে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন অসীম রায় ও রিচার্ড ইটন, তার সঙ্গে আমরা একমত নয়। আমরা মনে করি, ইসলামের প্রচার ও প্রসার আগেই হয়েছে, পীররা সেই অবস্থাকে সংহত ও শক্তিশালী করেছে। ইটন বলছেন, মোগল আমলে (১৪৫০-১৬০০) বাংলায় মুসলমান সংখ্যাধিক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু জনগণনা তো সেটাকে সমর্থন করছে না। আমরা মনে করি, ইটনের উল্লিখিত সময়কালের আগেই ইসলাম প্রচার হয়েছে এবং তা ক্রম প্রসারমাণ ছিল। মোগল সময় সেই অবস্থাকে যেমন স্থিতি দিয়েছে তেমনি গতিশীলও করেছে এবং ইসলাম থেকে ধর্মান্তরের ঘটনা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে, উল্টো অন্যান্য ধর্ম থেকে ইসলামে ধর্মান্তরের প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। সুফি ও পীরদের জীবনযাপন অন্যদের যেমন আকৃষ্ট করেছে তেমনি ইসলামের অনুসারীরা বিশেষ করে নতুন অনুসারীরা অন্যদের প্রভাবিতও করেছে। 

চতুর্থ প্রশ্নের দ্বিতীয় জিজ্ঞাসায় আমরা মনে করি, বাংলায় ইসলাম প্রচার তাৎক্ষণিকভাবে কিংবা স্বল্প সময়ে হয়নি এবং এখানে গণধর্মান্তরের তেমন কোনো নজির নেই। বাংলায় ইসলাম প্রচার কয়েকশ বছর ধরে হয়েছে। হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় কিংবা তার মৃত্যুর পর পরই এখানে ইসলামের আগমন ঘটে এবং এ প্রক্রিয়া ক্রমে প্রসারমাণ ছিল। 

আকবর আলি খান বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা এবং বাঙালি মুসলমানের শিকড়সন্ধানকে যেমন সাধনা হিসেবে নিয়েছিলেন, তেমনি দেশ ও জাতির কল্যাণের প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন, নির্লোভ ও প্রখর যুক্তিবাদী একজন ব্যক্তিত্ব। মননসমৃদ্ধ মানস, তীক্ষ্ণধী গবেষকের বিরল দৃষ্টিভঙ্গির নিরলস চর্চায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন সমকালের একজন বিরলপ্রজ ব্যক্তিত্ব। একজন আমলা, একজন অধ্যাপক কীভাবে কীর্তিমান হতে পারেন, নতুন প্রশ্ন, নতুন ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ হাজির করতে পারেন, নতুন চিন্তা উৎপাদন করতে পারেন তার পাঠ নেয়ার অপার সুযোগ রয়েছে আকবর আলি খানের জীবন ও কর্মে। 

দেশ ও জাতির যেকোনো পরিস্থিতিতে যুক্তিগ্রাহ্য ও স্পষ্ট কথা কীভাবে বলতে হয়, ক্ষমতাকে কীরূপে প্রশ্ন করতে হয়, জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের পক্ষে সতত নিজের শক্ত অবস্থান কীভাবে জারি রাখতে হয় সব ধরনের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে, তার ধারাপাত জেনে নিতে এ দেশের লেখক-কবি-সাংবাদিক-অধ্যাপক-সম্পাদক-সুশীল সমাজের আকবর আলি খানকে পাঠ করা কেবল জরুরি নয়, অবশ্যম্ভাবীও।

ড. কাজল রশীদ শাহীন: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন