অভিমত

উচ্চতর গবেষণা: জ্ঞানীজনদের অবক্ষয়িত নৈতিকতা

আবু তাহের খান

সম্প্রতি দৈনিক পত্রিকায় এ মর্মে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের (বিএসএসআরসি) কাছ থেকে নানা সময়ে বিভিন্ন গবেষণাকাজের জন্য অর্থ বরাদ্দ নিয়ে সংশ্লিষ্ট গবেষকদের একটি বড় অংশ পরে আর কোনো গবেষণা প্রতিবেদন পেশ করছে না বা গৃহীত অর্থ ফেরতও দিচ্ছে না (বণিক বার্তা, ১৩ আগস্ট ২০২৩)। এ ব্যাপারে তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে। কিন্তু তার পরও অনেকের কাছ থেকেই গবেষণা প্রতিবেদন বা অব্যবহৃত অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যাপারে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেছেন, ‘‌বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্যমান্য গবেষকরা টাকা নিয়ে সময়মতো রিপোর্ট দিচ্ছেন না, টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না। এটি সামাজিক অবক্ষয়ের একটি চিত্র।...আমরা শুদ্ধি অভিযানের কথা বলি। কিন্তু নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ছাড়া এগুলো কীভাবে সম্ভব হবে?’

শিক্ষাদীক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে পিছিয়ে থাকলেও পৃথিবীর অনেক অগ্রসর সমাজের মতোই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা অনুরূপ পর্যায়ের উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের বিশেষ সম্মানের চোখে দেখে। কিন্তু সমাজের সেই উচ্চশিক্ষিত সম্মানিত মানুষরাই যখন এরূপ নানা নৈতিকতাবিবর্জিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েন, তখন সেই সম্মান কি আর অক্ষুণ্ণ থাকে বা থাকা সম্ভব? তারা যে শুধু গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ নিয়েই সেটি তছরুপ করে দেয়ার লক্ষ্যে নানা ফন্দিফিকির করেন তাই নয়, এরূপ হাজারটা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়াটা এখন তাদের নিত্যদিনের মামুলি আচরণে পরিণত হয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের (ভিসি) দুর্নীতি, অনিয়ম, কেলেঙ্কারি ও অপকর্মের তালিকা এখন এতটাই দীর্ঘ যে দুর্নীতিতে শীর্ষস্থান অধিকারের জন্য খেতাব দেয়ার রীতি থাকলে সেটি তারাই পেতেন। 

আর খেতাবের প্রসঙ্গ যখন এলই তখন উল্লেখ করতেই হয় যে খেতাবদানের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রেও এখন দুর্নীতির মহোৎসব, যে উৎসবের কল্যাণে ফেসবুকে লিখেও একুশে পদক পাওয়া যায়। আর তথ্য হচ্ছে, এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লিখিত জ্ঞানীগুণীদের সংখ্যাও যথেষ্টই রয়েছে। যে সমাজে কথিত গুণীজনরা তদবির করে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে, লেজুড়বৃত্তি ও চাটুকারিতা করে, লেখাজোকার ভুয়া ফিরিস্তি দিয়ে তথাকথিত ‘‌কর্ম ও অবদানে’র স্বীকৃতি আদায় করে, সে সমাজে চিন্তা ও নৈতিকতার অবক্ষয় যে কতটা নিচে নেমেছে তা শুধু এ দেশের মানুষের পক্ষেই উপলব্ধি করা সম্ভব। এমনকি তা আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া, সুদান কিংবা শাদের মানুষের পক্ষেও উপলব্ধি করা সম্ভব কিনা, সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে।

দেশ-বিদেশের নানা লেখক, গবেষক, বিজ্ঞানী ও গুণীজনের গ্রন্থ, প্রবন্ধ ও অন্যবিধ লেখা বা লেখার অংশবিশেষ চুরি করে সেগুলোকে নিজের গবেষণাকর্ম বলে চালিয়ে দেয়ার অভিযোগ এখন বাংলাদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বিরুদ্ধেই উঠছে। কী ভয়ংকর চৌর্যবৃত্তি! যে ধাঁচের ও মানদণ্ডের মূল্যায়নে একজন শিক্ষার্থীকে নকলের অভিযোগে তাৎক্ষণিকভাবে পরীক্ষা কক্ষ থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে, অনুরূপ মানদণ্ডে গবেষণাকর্ম চুরির অভিযোগে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেও তো অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে তা কি হচ্ছে? বরং কখনো কখনো ছোটখাটো কোনো শাস্তি হলেও রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীগত কিংবা অন্য কোনো ক্ষুদ্র স্বার্থগত বিবেচনায় তা মওকুফ করে দেয়া হচ্ছে। আর কখনো কখনো তা পুরোপুরি মওকুফ না হলেও শাস্তির ধরন এমনই হয়ে থাকে যে সেটিকে নিছক প্রহসন বলেই মনে হয়।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) নানা আদেশ, নির্দেশ ও হুঁশিয়ারি, রাষ্ট্রপতির (প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ) উপর্যুপরি উদ্বেগ ও হতাশা ব্যক্তকরণ এবং গণমাধ্যমের ক্রমাগত সমালোচনা সত্ত্বেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনৈতিক সান্ধ্য কোর্স বাণিজ্য আজও বন্ধ করা যায়নি। এ সান্ধ্য কোর্সগুলোর শিক্ষকরা দিনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, সেখান থেকে ফিরে এসে সান্ধ্য কোর্সের ক্লাস নেন এবং বাকি সময়টা কনসালট্যান্সি ও নীল-গোলাপির বলয়ে ব্যয় করেন। এ অবস্থায় নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের কাছ থেকে কতটা সময় পান, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ এ ঘটনায় সরাসরি না ভুগেও এটা ভালো করেই বুঝতে পারেন যে আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চিনি, ডিম, সয়াবিনের সিন্ডিকেটের মতোই সান্ধ্য কোর্স ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো নিয়ে এক নতুন সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন, যেখানে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে গোলাপি-নীলের মাঝামাখি। 

দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি বড় অংশই বর্তমানে উচ্চশিক্ষার নামে আসলে সনদ বিক্রি করছে। শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে এরূপ নৈতিকতাহীন কাজে যুক্ত থাকাটা যে অপরাধ, এ কাজের সঙ্গে যুক্ত উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষকরাও তা বোঝেন। কিন্তু তার পরও যে এ অপরাধ তারা অবলীলায় করে যাচ্ছেন, তার একটাই কারণ—নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সীমাহীন অবক্ষয়। অবক্ষয়িত এ সমাজে রাজনীতিক, আমলা, বণিক প্রভৃতি শ্রেণীর মানুষের গায়ে এখন পচনের যে গন্ধ, তা থেকে মুক্ত থাকতে পারেননি আমাদের শিক্ষকরাও—বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তো নয়ই। বরং পচনের এ গন্ধ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গায়েই সর্বাধিক।

পক্ষ-বিপক্ষের সবাই এখন নিঃসংকোচে স্বীকার করেন যে দেশটা আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। কিন্তু এ দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের মধ্যে কতজন লেখাপড়া না-জানা বা স্বল্প জানা সাধারণ মানুষ, আর কতজন উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া সাজানো-গোছানো চৌকস (স্মার্ট) নাগরিক? দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদের প্রায় সবাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেয়া নিপাট ভদ্রলোক। রাজনীতিবিদদের মধ্যেও ডিগ্রিধারী লোকের অভাব নেই, যারা চেহারা ও লেবাসে অনেকটাই ধর্মগুরুর মতো, দেখলেই মনে হয় যেন এইমাত্র স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন। কিন্তু লেবাসের ভেতর থেকে নিয়ত নিঃসৃত পুঁতিগন্ধময়তা আশপাশকে যে অতিষ্ঠ ও অসহনীয় করে তুলেছে, সেটি অস্বীকার করা যাবে কেমন করে? ব্যবসায়ও ইদানীং উচ্চশিক্ষিত লোকের অভাব নেই। সাম্প্রতিক সময়ে ইভ্যালি, আলেশামার্টের মতো ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের নামে হায় হায় কোম্পানি খুলে প্রতারণার ব্যবসা ফেঁদে যারা ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয় পক্ষকে ঠকিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন, তাদের প্রায় সবাই স্বনামধন্য উচ্চশিক্ষিত নাগরিক, যাদের মধ্যে খ্যাতিমান অভিনেত্রী, জনপ্রিয় গায়ক প্রমুখ অনেকেই রয়েছেন।

তাহলে এ সমাজের জন্য কী অবদান রাখছেন দেশের উচ্চশিক্ষিত খ্যাতিমান নাগরিকরা? সে তুলনায় আমাদের খেটে খাওয়া নিরক্ষর কৃষক ও শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকেই দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য অধিক নিরাপদ ও প্রকৃত সম্ভাবনায়, যাদের নীতি ও মূল্যবোধ যেকোনো বিচারেই তথাকথিত ওই উচ্চশিক্ষিত শ্রেণীর চেয়ে অধিকতর উন্নততর। এমতাবস্থায় ঘটনার তাগিদ হিসেবে শেষ পর্যন্ত বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এই যে রাষ্ট্র ও সমাজে উচ্চতর নৈতিকতা ও মূল্যবোধ যদি ফিরিয়ে আনতেই হয়, তাহলে সর্বাগ্রে গণহারে উচ্চশিক্ষিত নাগরিক সৃষ্টির ধারা ও প্রবণতা দুই-ই বন্ধ করতে হবে। আমাদের নীতি-নৈতিকতাবর্জিত সনদধারী উচ্চশিক্ষিত লোকের কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের দরকার আসলে উচ্চতর রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি, মনন ও সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনা সংবলিত স্বাপ্নিক ও মানবিক মানুষ, যারা সাধারণের প্রতি শুধু মমতাবানই হবেন না—তাদের সঙ্গে নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রগতির পথে বদলেও দিতে চাইবেন। আর তাই এতশত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে চলুন একটি সৃষ্টিশীল শিক্ষাধারাপুষ্ট মানবিক সমাজ ও ন্যায্য রাষ্ট্র ব্যবস্থার পথে এগোনোর চেষ্টা করি।


আবু তাহের খান: সাবেক পরিচালক, বিসিক 

শিল্প মন্ত্রণালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন