সংশ্লেষ

রাষ্ট্রীয় সম্পদের লাভজনক ব্যবহারে পারঙ্গমতা দেখাতে পারছি কি

সায়ীদুল হক খান

অন্যায়কে ন্যায় হিসেবে প্রমাণ করতে অনেক কোশেশ লাগতেই পারে, কিন্তু ন্যায়কে যদি ন্যায় হিসেবে প্রমাণিত হতে হয়, তবে ভেবে নিতে হয় যে ‘‌গোড়া’য় ‘‌সমস্যা’ রয়ে গেছে। আচ্ছা, আমাদের গোড়াই বা কী আবার কথিত সমস্যাই বা কী? গোড়ার কথা আপাতত তোলা থাকুক, না হয়। তবে ‘সমস্যা’ হচ্ছে, দুনিয়ার অন্য সব মানুষের মতোই আমরাও যে মানুষ, সেই ধারণায় বিশ্বাস বজায় না রাখা। দুনিয়ার মানুষ যে প্রচুর কাঠখড় পুড়িয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও হচ্ছে, সেটা জানা ও বোঝার পরও আমরা বেবুঝের মতো আচরণ করি। আমরা ‘হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছি, পৃথিবীর পথে...’ বটে এবং এরই মধ্যে ‘সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগর...’ ছাড়িয়ে পৃথিবী আমাদের জন্য অনেক বিস্তৃতও হয়েছে। আমরা ইদানীং সেই মহা-পৃথিবীর মহা-পথে উঠতে চেষ্টা করছি এবং বলতেই হবে সেটা ব্যক্তিচেষ্টার প্রতিফলন, যা বিদ্যমান দুনিয়ার অন্য সব ব্যক্তিচেষ্টার সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ: কেউ কাউকে করে দেয় না, নিজেকেই করে নিতে হয়। দেখা যাচ্ছে যে নিজেদের এ করণীয় নির্ধারণে ব্যক্তি কোনো পিছুটানে নেই, অন্য কারো দূতিয়ালিও যাচে না, কিন্তু সমষ্টি তথা সরকার/বেসরকার তাদের করণীয় নিয়ে গর্তে পড়লেই দ্বারে দ্বারে ঢুঁ মারে এবং তখনই নাবালকত্ব ধরা পড়ে। নির্বাচন প্রক্রিয়া হাস্যকর করে তুলে বর্তমান গাড্ডায় পতিত হওয়া সেই নাবালকত্বের পরিচায়ক। 

গত ৫০ বছরে এ দেশের মানুষ অনেক সাবালক হয়েছে, নিজের স্বার্থ বোঝার ক্ষমতা তার অনেক বেড়েছে। কারণ একান্ত নিজস্ব চেষ্টায় সে জীবনের স্বাদ পেয়েছে, জীবনকে ভালোবাসতে সে প্রলুব্ধ হচ্ছে, সেই ভালোবাসার ছিটেফোঁটা অন্যকে দিতেও সে আগ্রহী হচ্ছে এবং অধিকতর স্বাদু জীবনের ধান্দায় সে অষ্টপ্রহর ব্যস্ত। আমাদের রাজনীতি সেই সাবালকত্বকে সম্যক উপলব্ধি করতে না পারার কারণে, মানুষ তিতিবিরক্ত হয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকেই নিজেকে সরিয়ে রাখছে। মানুষের এ বিচ্ছিন্নতা বিভিন্ন কারণে সর্বনেশে, অন্যতম কারণ, কখনো সার্বভৌমত্ব যদি হুমকিতে পড়ে তখন মিলিটারি ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যাবে না। এই যেমন ’৭১-এ পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব হারানোর প্রক্রিয়ায়, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে পাশে পাওয়া যায়নি। আজকের দুনিয়ায় যুদ্ধ করে জমি দখল করা লাগে না, অর্থনীতি দখল এবং রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে নিলেই চলে। আগে কথিত ও বর্তমানে দৃষ্ট দূতিয়ালি এ নিয়ন্ত্রণ ও দখলের বায়নাপত্র। হাবেভাবে বোঝা যাচ্ছে যে কাঁটাতারের ওই পার এবং আটলান্টিকের হেই পার, বাংলাদেশের বিষয়ে আপাতত At Per, অবশ্য বাংলাদেশের মানুষও ‘অ-পার হয়ে বসে...’ নেই। এ দেশীয় বুর্জোয়া এবং তাদের টাকার পরিমাণ কল্পনা করুন। তারা কি এমনি এমনি বসে থেকে নিজেদের কামানো টাকা এবং কামাইযোগ্য টাকায় অন্য কাউকে ভাগ বসাতে দেবে? না, দেবে না। তারা হচ্ছে নতুন শ্রেণী যারা এদ্দিনে, দেশীয় অন্য সবার চেয়ে বেশি সক্ষম ও বুদ্ধিমান। নিজেদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই আগামী দিনের বাংলাদেশে তাদের আরো সক্রিয় থাকতেই হবে। Primitive-accumulation সমর্থিত এ বুর্জোয়ারা, জাতীয় বুর্জোয়া হিসেবে রূপান্তরিত হওয়ার স্বাভাবিক ক্ষমতা (আর্থিক ও মানসিক) এবং যুক্তি (জাতীয়তাবাদ) অর্জন করেছে। এ বুর্জোয়াদের দ্বিতীয় প্রজন্ম এখন প্রায় মাঝবয়সী, দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত, দুনিয়া দেখেছে ও দেখছে, নিজেরা অনেক কিছু ভোগ করেছে ও করছে এবং সেটা দেখিয়ে আত্মপ্রসাদ পেয়েছে ও অন্যদের মিন্‌মিনে্‌ স্বীকৃতিও আদায় করেছে। সুতরাং, সম্পদ ও সম্পদ উদ্ভূত প্রাথমিক তৃপ্তি তাদের হয়েছে, পরবর্তী পর্যায়ের তৃপ্তি তারা খুঁজছে এবং সেই তৃপ্তি চাখবার আগ্রহে আছে। এখনই যদি তাদেরকে তাদের কাঙ্ক্ষিত তৃপ্তির সঙ্গে জাতীয় প্রয়োজনগুলোর সংযোগ ঘটিয়ে না দেয়া যায়, তবে তাদের সম্পদগুলো হয় বিদেশে আরো পাচার হবে, নয়তো দেশে কম লাভজনকভাবে ব্যবহার হবে।

এ ধরনের বাস্তবতায় জাপানি অর্থনৈতিক ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া যেতে পারে। 

প্রথম মহাযুদ্ধের শেষ থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরু পর্যন্ত জাপানি অর্থনীতির যে বিস্ময়কর পরিবর্তন, সেটার অন্যতম কারণ হিসেবে Zaibatsu তথা ‘সম্পদশালী গোষ্ঠী’র অবদান স্বীকার করা হয়। ভারী শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, বাণিজ্য ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সুযোগ করে দেয়া হয়: Sumitomo, Mitsui, Mitsubishi ও Yasuda—তারা ছিল সেই গোষ্ঠী যারা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনেন এবং রাজনীতির সঙ্গেও সম্পর্কিত থাকেন। দুনিয়ায় তারা কি অবদান রেখেছেন সেটা ভিন্ন কথা, কিন্তু জাপানে তাদের অবদান খোদ জাপানিদের দিয়ে স্বীকৃত। 

এবার বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত। আগেই বলা হয়েছে যে আমাদের দেশীয় বুর্জোয়াদের হাতে বিস্তর টাকা রয়েছে, তারা অভিজ্ঞ হয়েছে এবং তাদের দূরদৃষ্টি খুলেছে...অন্যদিকে আমাদের দেশীয় সরকারের হাতে যে পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ রয়েছে, তার লাভজনক ব্যবহারে সরকার এখনো পারঙ্গমতা দেখাতে পারেনি। বিভিন্ন সরকারি করপোরেশন তথা সংস্থা যেমন কেমিক্যাল, সুগার, স্টিল, জুট, পানি, রেল, জ্বালানি ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণে যে পরিমাণ ভূসম্পত্তি ও ভূমির ওপর অকেজো অথবা অল্প কেজো স্থাপনাগুলো রয়েছে, সেগুলোর নতুন ও অধিক লাভজনক ব্যবহারের কথা ভাবতে বাধা কোথায়? এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এ দেশীয় টাকার মালিকদের জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী হিসেবে আত্মপ্রকাশে উৎসাহ দিতেই বা কোথায় বাধা। এ দুইয়ের সংযোগ ঘটালে যে বিস্ফোরণ হবে তার প্রভাব ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে ছোট ছোট বিস্ফোরণের দ্বার উন্মুক্ত করতে। আমার ধারণা আর একটিমাত্র সুবিধা প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে: সরকারের মাধ্যমে জনগণের পয়সায় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ওপর ইন্টারনেটের চাঁদোয়া মেলে দেয়া। 

এবারের (২০২৪) নির্বাচন তথা ম্যান্ডেট নিয়ে ‘দুতিয়াল’দের যে আগ্রহ, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে সম্পদের আবাহন। এ দেশের অরক্ষিত সম্পদ যতটা সহজে হাতানো সম্ভব, অন্য কোথাও তেমন নয়। আর সহজ হলেই বা কি? সম্পদ তথা অর্থের লোভ কার নেই এবং বিশেষ করে অর্থের সর্বগ্রাসী ক্ষমতা যারা উপভোগ করেছেন, তারা তো আরো অর্থ চাইবেনই। আমাদের যা গেছে তা হয়তো একদমই গেছে, কিন্তু যা রয়েছে এবং যা হবে, সেটাকে ধরে রাখতে হলে বিভিন্নরূপ কাঁটাতারের বেড়া দৃঢ় থাকতে থাকতেই সম্পদকে আত্মস্থ করে নিতে হবে। এই দিনকে যদি সেই দিনের কাছে নিয়ে যেতেই হয়, যেখানে পৌঁছার জন্য এ দেশের মানুষ যার যার অবস্থান থেকে সক্রিয় রয়েছে, সেই দিনের দিকে না তাকিয়ে, আমাদের দেশীয় রাজনীতি শুধু হাত কচলাচ্ছে এবং কখনো কখনো হাতকড়া পরাচ্ছে। এ কেমন অর্বাচীনতা? 

সেই আদ্যিকাল থেকে মাঝে মাঝে একটা শোর ওঠে ‘গেল, গেল...নিল নিল’। অনেক কিছুই এ শোরের অন্তর্ভুক্ত, তবে সেসবের মধ্যে যেটা বেশ চমকপ্রদ, সেটা হচ্ছে সেন্ট মার্টিন! ওই দ্বীপকে স্বাধীনতার আগে থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়েই যাচ্ছে...। যাচ্ছে যাক, তবে যদ্দিন আছে, তার মধ্যে আগামী ৩০ বছরের জন্য ওই দ্বীপকে বাংলাদেশী বুর্জোয়াদের কাছে লিজ দেয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। তারা মাঝেমধ্যে ওখানে গিয়ে ইহলৌকিক সাধ-আহ্লাদের কিছু অংশ পুরিয়ে আবার ফেরত আসবে। নিজেদের খরচে তারা ওই দ্বীপকে নিজেদের মতো সাজিয়ে নিয়ে ওখানে জোরে গাড়ি চালাবে, বেদম জোরে গান বাজাবে, জোরে সমুদ্র স্নান করবে, জ্বরে আরক খাবে, জোড়-বেজোড়ে হুল্লোড় করবে, দেশী-বিদেশী শিল্পী এনে কনসার্ট মাতাবে এবং রাতে শোয়ার আগে এ সুবিধাদি পরলোকেও বজায় রাখার জন্য দোয়া করবে। বুর্জোয়াদের একত্র হওয়ার জন্য ওই দ্বীপকে Bourgeoisie Consolidating Zone হিসেবে বিশেষ মর্যাদা দেয়ার কথা ভাবতে অসুবিধা কোথায়? এ কথা তো সত্য যে তাদের ক্ষমতা যেহেতু বেশি, তাই খাই-ও ভিন্ন। সেই ভিন্ন খাই মেটানোর ব্যবস্থা দেশের এক অংশে করে দিতে অসুবিধা কোথায়? 

বিশেষ করে ’৪৭-এর পর থেকে ক্রমে নিজস্বতা অর্জনের যে চেষ্টা এ ভূখণ্ডে চলে এসেছে এবং ’৭১-এ যেটার উল্লম্ফন ঘটেছে, তার ক্রমধারায় এ ভূখণ্ড এখন পরবর্তী লম্ফের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত, দরকার শুধু সহায়ক পরিবেশ, যেটা বজায় রাখার দায়িত্ব সরকারের তথা রাজনীতির। কাজটা মোটেও সহজ নয়, তবে অসম্ভবও নয়, কারণ আমরা তো জানিই যে ‘বাংলাদেশ হচ্ছে সব সম্ভবের দেশ’। নিত্য মরার এ দেশে মৃত্যু কোনো বিশেষ ঘটনা নয়, তাই ‘দেশের জন্য জীবন দিন’ মার্কা কোনো কথা আর আবেদন তৈরি করে না। মানুষের মৃত্যু কোনো ফয়সালাও আনে না; যা হয় তা হচ্ছে এ মওকায়, যারা নিত্য মরার অভিজ্ঞতাহীন, তারা আহা! উহু! করে তড়িঘড়ি একটা ব্যবস্থা করে মৃত্যু ঠেকানোর বাহবা নিয়ে, বিনিময়ে কিছু সয়-সুবিধা আদায় করে নেয়। এই যদি আমাদের নিকট ইতিহাস হয়ে থাকে, তবে যে সুবিধা আমরা বিদেশীদের দিতে প্রস্তুত, সেটারই রকমভেদ দেশীদের দিলে অসুবিধা কোথায়? এবং দেশ শাসনে বিরোধীদের কোনো এক ধরনের অংশীদারত্ব দিতেই বা বাধা কোথায়? বিরোধীরা কী ধরনের অংশীদারত্ব চাইছে এবং কী ধরনের অংশীদার পেতে পারে তা নিয়ে আলোচনা তো হতেই পারে? ৭ মার্চ “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” বলার পরও আলোচনা তো চালুই ছিল! সুতরাং, আলোচনা হওয়াই উচিত এবং সেটা সংসদ-টিভি মারফত এ দেশের জনগণকে দেখানো উচিত। 

শোনা যায়, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন: ‘বিরোধীদের নিয়ে আপনি কী করবেন? ওদেরকে কিছু আসন ছেড়ে দিন না!’ জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে দেশ পরিচালনা করার যে সাংবিধানিক পন্থা, সেটা এখনো যথেষ্ট সুগম না হওয়ায় জ্ঞানতাপসের সেই প্রশ্ন স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আজও তার উত্তর খুঁজছে! আমাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে যে সংসদ তথা আইনসভায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ বিধান হয়েছিল। সেই একইভাবে বিরোধী দল, উপজাতীয়, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ব্যবসায়ী, মিলিটারি ইত্যাদি শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে এবং সংসদ সদস্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে পরিমার্জিত সংসদ তো হতেই পারে! কেন নয়? অনেকেই বলবেন, ‘এমন নজির দুনিয়ায় নেই’, সেই বলুয়াদের এটাও মনে রাখা উচিত হবে যে ‘এমন বাংলাদেশও দুনিয়ায় নেই’!

সরকারের মতো এমন একটি জমকালো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়ে এবং রাজনীতির মতো চমকানো একটি ব্যবস্থার সঙ্গে সহবাস করার পরও এ দেশের মানুষ এরই মধ্যে যা করতে সক্ষম হয়েছে, তাতে এটা বলাই যেতে পারে যে সরকার ও রাজনীতি যতই পশ্চাৎপদ হোক না কেন, মানুষ সেগুলো পাশ কাটিয়ে বেড়ে উঠতে শিখেছে এবং আরো বর্ধিত হবেও।

সায়ীদুল হক খান: সাবেক চেয়ারম্যান, মার্কেটিং বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন