আলোকপাত

সংকটকালীন পরিস্থিতিতে শিক্ষায় আর্থিক সহায়তার গুরুত্ব

মোহাম্মদ জমির

শিক্ষা যে শুধু আমাদের সুকুমারবৃত্তির বিকাশ ঘটায় এমন নয়, বরং সংঘাত বা সংকটকালীন পরিস্থিতিতে ট্রমা বা মনঃসামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়তা করে। হতে পারে সেটা যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনশীলতার প্রভাব বা স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত কারণ। যেমন কভিড-১৯ মহামারী ও সাম্প্রতিক ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। এটি এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে যেখানে আর্থিক অগ্রাধিকার সামনে আসে এবং কোন খাতে ব্যয় করতে হবে তা নির্ধারণে হিমশিম খায় দরিদ্র পরিবারগুলো। এ প্রপঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আমরা দেখতে পাই, শিশুশিক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যয় করা থেকে বিরত থাকেন সংশ্লিষ্টরা। 

এমন পদক্ষেপ বিভিন্ন শিশুর শিক্ষা চালিয়ে যাওয়া ও সুকুমারবৃত্তির বিকাশ ঠেকিয়ে দেয় বলে জানান এডুকেশন ক্যান নট ওয়েট (ইসিডব্লিউ) উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক ইয়াসমিন শেরিফ। এ ট্রমার বিস্তার আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। জাতিসংঘ বলছে, এর ফলে বাংলাদেশে তথা পুরো উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ আর্থসামাজিক উন্নয়নে কালো ছায়া ফেলতে পারে। এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক যে তথ্য জানা গেছে, বিশ্বে প্রায় ২২ কোটি ৪০ লাখ শিশু মানসম্মত ও অব্যাহত (ধারাবাহিক) শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যাদের ন্যূনতম সাক্ষরতা ও সংখ্যাজ্ঞান নেই। এতে আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন যে ব্যাহত হবে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এ পরিস্থিতি কীভাবে সামাজিক স্তর থেকে শুরু করে দেশের সার্বিক উন্নয়নে নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে সেদিকে আলোকপাত করেছেন এন হোসাইন। 

জাতিসংঘের সদর দপ্তরে আয়োজিত ‘‌এনসিওরিং এডুকেশন কন্টিনিউটি: দ্য রোলস অব এডুকেশন ইন ইমার্জেন্সিজ, প্রটেক্টেড ক্রাইসিস অ্যান্ড বিল্ডিং পিস’ শিরোনামে সংস্থাটির এক কনফারেন্সে আলোচনা রাখেন ইসিডব্লিউর নির্বাহী পরিচালক ইয়াসমিন শেরিফ। সেখানে অংশগ্রহণকারী বক্তাদের আহ্বান ছিল, সংকটপূর্ণ অঞ্চলে শিক্ষার জন্য তহবিল অবিলম্বে বৃদ্ধির। সম্মেলনটির সহআয়োজকের তালিকায় ছিল জাপান, ইতালি ও সুইজারল্যান্ডের স্থায়ী মিশন, ইউনিসেফ, ইসিডব্লিউ, গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশন (জিপিই), ইউনেস্কো, সেভ দ্য চিলড্রেন, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এবং জাপান এনজিও নেটওয়ার্ক ফর এডুকেশন। জরুরি অবস্থায় জীবন রক্ষা ও টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর আলোকপাত করতে আয়োজন হয়েছিল ইভেন্টটি। 

এ প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন, জাতীয় মানবাধিকার আইন এবং জাতীয় শরণার্থী আইনের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল। প্রস্তাব উত্থাপন হয়েছিল যে এ নীতিগুলোর লঙ্ঘন বন্ধ করতে সর্বস্তরে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। জাতিসংঘে জাপানের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত কিমিহিরো ইশিকানে সেখানে বলেন, শিক্ষাকে একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে আমলে নেয়া সর্বোচ্চ পর্যায়ের এ রাজনৈতিক ফোরামের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসডিজির সময়সীমার সাত বছর বাকি আছে উল্লেখ করে ইউনেস্কোর শিক্ষাবিষয়ক সহকারী মহাপরিচালক স্টেফানিয়া জিয়ানিনিও সদস্যদেশগুলোকে আন্তঃসরকারি চুক্তির মাধ্যমে সশস্ত্র সংঘাতের সময় শিক্ষাকে রক্ষায় সেফ স্কুলস ডিক্লারেশন ঘোষণার আহ্বান জানান। 

গুরুত্বপূর্ণ এ সভায় অন্য বক্তারাও সংকটের সময়ও ধারাবাহিক শিক্ষার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছিলেন। কারণ এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক ও মানসিক সুস্থতা বৃদ্ধি করে। দক্ষিণ সুদানের শিক্ষামন্ত্রী আউত দেং আকুইল আরো জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেন কীভাবে মনুষ্যসৃষ্ট সংঘাত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট ব্যাঘাত শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে কয়েক সপ্তাহ আগে ইসিডব্লিউ দক্ষিণ সুদানে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছে। নবীন রাষ্ট্রটির নাজুক ছেলে ও মেয়ে এবং প্রতিবেশী সুদান থেকে পালিয়ে আসা শিশুদের রক্ষায় কাজ করছে তারা। আকুইল আরো বলার চেষ্টা করেন, শিক্ষা স্রেফ শ্রেণীকক্ষে অর্জিত জ্ঞান নয় বরং তার চেয়ে বেশি কিছু। তার ব্যাখ্যানুসারে, মনঃসামাজিক শিখন দেশের উন্নয়নে সহায়তা করে, সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, দ্বন্দ্ব নিরসনে ভূমিকা রাখে, এমনকি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে পারে। দক্ষিণ সুদানের ওই শিক্ষামন্ত্রী আরো বলেন, সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত লক্ষাধিক শিশুর শিক্ষার ধারাবাহিকতা এখনো ঝুঁকির মধ্যে। যদিও আমরা সবাই জানি যে শিক্ষা সব শিশুর জন্য একটি মৌলিক অধিকার এবং উচ্চঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে শিক্ষার ধারাবাহিকতা অনেক জাতিগোষ্ঠীর কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়। 

জাতিসংঘে নাইজেরিয়ার স্থায়ী মিশনের মন্ত্রী আসাজু বোলাও মন্তব্য করেছেন যে ‘‌শিক্ষা পরিষেবা প্রদানের চেয়ে বেশি কিছু। এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গির সংক্রমণের মাধ্যমে সামাজিকীকরণ এবং পরিচয় বিকাশের একটি মাধ্যম। তাই শান্তি রক্ষার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, কারণ শিক্ষা ছাড়া আমরা শান্তি পেতে পারি না।’

আমরা দেখেছি কীভাবে সাম্প্রতিক সময়ে সুদান, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান এবং বিশ্বের অন্যান্য অনেক জায়গায় স্কুলে যাওয়া শিশুরা শুধু চারপাশেই নয়, স্কুলেও সহিংসতার সম্মুখীন হচ্ছে। শিশুরা যাতে নিরাপদ থাকে সেজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। স্কুলে যাওয়া-আসার নিরাপদ পরিবহন নিশ্চিত করার মাধ্যমেও এতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখা যাবে, যা সন্তানদের নিয়ে অভিভাবকদের অনিরাপত্তা বোধ প্রশমনে সহায়তা করবে। শিক্ষার্থীদের সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। স্পষ্টতই আফগানিস্তানে, যেখানে তালেবান মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এবং তার ওপরে পড়া নিষিদ্ধ করেছে, স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে সমর্থন করার জন্য কাজ করছে ইসিডব্লিউ। এ ব্যাপারে দেখা গেছে যে কমিউনিটি পর্যায়ে ইসিডব্লিউ বিভিন্নভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে যে সুশীল সমাজের বিকাশে ইসিডব্লিউর বিনিয়োগ এবং জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত সংস্থাগুলোকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশের কক্সবাজারে এ ধরনের কমিউনিটি-ভিত্তিক স্কুলিং এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে মিয়ানমারে সহিংসতা, বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বসবাস করছে। শিক্ষার সুযোগ সহজলভ্য করতে এ ধরনের উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।

ডিজিটালাইজেশনের এ যুগে এবং স্মার্ট বিশ্বের প্রয়োজনীয়তা আমলে নিয়ে ইউনেস্কো ও ইউনিসেফ যৌথভাবে স্কুল, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের জন্য মানসম্পন্ন ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধির সামগ্রী সহজলভ্য করার জন্য একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ চালু করেছে। ডিজিটাল লার্নিং এবং শিক্ষা ব্যবস্থার বিকল্প মাধ্যমগুলো বিনিয়োগের উপযুক্ত প্লাটফর্ম হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা কিংবা স্বাভাবিক শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত ছাত্রছাত্রীদের কাছে ডিজিটাল মাধ্যম প্রয়োজনীয় সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার জন্য কভিডকালে উদ্ভাবনী সব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে দূরবর্তী শিক্ষা প্রদানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা গিয়েছিল। এছাড়া স্মার্টফোনের মাধ্যমে অনলাইন শিখন-পঠনে বিপ্লবী পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে ওই সময়টায়। সেই সময়ে ইউনিসেফের শিক্ষাবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ফ্র্যাঙ্ক ভ্যান ক্যাপেল বলেছিলেন, এ ধরনের প্রয়াস তখনই সফলতার মুখ দেখবে যখন তা সামগ্রিক একটি প্রক্রিয়ার অংশ হবে এবং নমনীয় পদ্ধতির মাধ্যমে তা কার্যকরের চেষ্টা করা হবে। এক্ষেত্রে মানবসংযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

যা-ই হোক, তার পর থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে, কিছু অর্জন সত্ত্বেও তহবিল সংকট এ কর্মসূচির সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশনের সিইও চার্লস নর্থের মতে, সংকটে পড়া শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু অর্থায়ন সেভাবে বাড়ছে না। এটা সত্যিই দুঃখজনক।

মজার বিষয় হলো, সেভ দ্য চিলড্রেনের পলিসি, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড ক্যাম্পেইনস-বিষয়ক নির্বাহী পরিচালক রোটিমি জোসায়ার আহ্বান, যেসব দেশ ঋণের বোঝায় আক্রান্ত শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের জন্য তাদের যেন ঋণ মওকুফ করা হয়। পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তিনি জানান, ২০২০ সালে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ১৪টি দেশের মধ্যে চারটিই শিক্ষার চেয়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অধিক অর্থ ব্যয় করেছে। এ.ভি. নিলির মতো অন্যান্য বিশ্লেষকের লেখায়ও এ বিষয়গুলো উঠে এসেছে। 

ইয়াসমিন শেরিফের পর্যবেক্ষণ আমলে নিয়ে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সমৃদ্ধতর বিশ্ব গঠনের ভিত্তি হচ্ছে শিক্ষা। একই সঙ্গে এটিতেও একমত হতে হবে, যেকোনো বাজেটে শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয়কে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। কারণ এটি বলতে গেলে মানুষের ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ করা। এমন কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত জাতিসংঘ কাঠামোর আওতায় থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসা। শিক্ষায় অধিকতর বিনিয়োগে বিদ্যমান অচলাবস্থা নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 

শেষ করার আগে এটি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে গত জুলাইয়ে বাংলাদেশে ইউনিসেফের একটি উদ্যোগ বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোচায় লণ্ডভণ্ড হওয়ার পরও রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে শিক্ষার আলো ফুটেছে। ২৩ জুলাই স্কুলের প্রথম দিনে রোহিঙ্গা শিশুদের কলরবে মুখরিত ছিল শরণার্থী শিবির। বাংলাদেশে অবস্থান করা রোহিঙ্গা শিশু-কিশোর ও মেয়েদের মাঝে শিক্ষার সুযোগ বিস্তৃত করার উদ্যোগে সাড়া দিয়েছে রেকর্ড তিন লাখ রোহিঙ্গা শিশু। তারা ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছে। বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত সব বয়সী শরণার্থীরা প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমের অধীনে শিক্ষাগ্রহণ করবে। এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই আমাদের একক প্রয়াস হয়তো কিছু সাফল্য নিয়ে আসবে। কিন্তু এটাকে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হলে সর্বব্যাপী প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে। 

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত

পররাষ্ট্র, তথ্য অধিকার ও সুশাসনসংক্রান্ত বিষয়াদির বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন