গ্যাস খাত নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন পর্ব-২

ভুল নীতি ও উদ্যোগের অভাবে পেট্রোবাংলা এখন তলাবিহীন পাত্র

আবু তাহের

ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

তিন বছর আগেও পেট্রোবাংলার গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে আমানত হিসাবে জমা ছিল প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। এর প্রায় ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এরই মধ্যে খরচ হয়ে গেছে। এর সঙ্গে গত পাঁচ বছরে সংস্থাটি ভর্তুকি হিসেবে পেয়েছে আরো ২২ হাজার কোটি টাকা। এর পরও পাঁচ বছরে সংস্থাটির মোট লোকসান হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জ্বালানি খাতের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো পেট্রোবাংলার কাছে গ্যাসের বিল বাবদ পাবে ৭০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরেও জ্বালানি খাতের ভর্তুকি হিসেবে বরাদ্দের বড় অংশই ব্যয় হবে পেট্রোবাংলার এলএনজি আমদানিতে। লোকসান, ভর্তুকি ও দায়দেনার এ ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যেই এলএনজি আমদানি করতে আরো ৭ হাজার ১৮১ কোটি টাকার ঋণ চেয়ে অর্থ বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছে সংস্থাটি। 

অথচ একপ্রকার অর্থশূন্য অবস্থায় যাত্রা করেও এক সময় বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল সংস্থাটি। স্বাধীনতার পর সংস্থাটির তহবিল যখন নেই বললেই চলে, সেই মুহূর্তে বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে সাড়ে ৪ মিলিয়ন পাউন্ডে দেশের পাঁচ গ্যাসক্ষেত্র কিনে নিয়ে পেট্রোবাংলার মালিকানায় দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এসব ক্ষেত্রের গ্যাস উত্তোলন ও ব্যবহারের মাধ্যমে পরের চার দশকে আর্থিকভাবে বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল পেট্রোবাংলা। বঙ্গবন্ধুর কিনে দেয়া এ পাঁচ গ্যাসক্ষেত্র এখনো স্থানীয় উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সরবরাহকৃত গ্যাসের বেশির ভাগের জোগান দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নতুন গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধান ও উত্তোলনের মাধ্যমে স্থানীয় সরবরাহ বৃদ্ধির পরিবর্তে আমদানিনির্ভর ভুল জ্বালানি নীতি গ্রহণের কারণে আর্থিক সক্ষমতা হারিয়েছে পেট্রোবাংলা। অসম্ভব হয়ে পড়েছে সরকারের ভর্তুকি বা ঋণ ছাড়া সংস্থাটির পক্ষে কার্যক্রম চালানো। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিন বছর আগেও প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থান ছিল শক্ত ও মজবুত। গ্যাস বিক্রি বাবদ লাভে থাকা প্রতিষ্ঠানটি দেশের এ গুরুত্বপূর্ণ খাতের উন্নয়নে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ), জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলের মতো আর্থিক ফান্ডও তৈরি করেছিল। কিন্তু এলএনজি আমদানিতে নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি ও স্থানীয় গ্যাস খাত উন্নয়নে বহুমুখী উদ্যোগহীনতার কারণে পেট্রোবাংলা এখন আর্থিকভাবে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর হয়েছে। 

অর্থ সংকটের কারণে এলএনজি আমদানির ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সংস্থাটি। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে কার্যক্রম চালানো বহুজাতিক গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (আইওসি) কাছেও বিপুল পরিমাণ বকেয়ার দায় সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে ক্রমেই কমে আসছে দেশের গ্যাসের মজুদ। এ অবস্থায়ও স্থানীয় পর্যায়ে অনুসন্ধান ও উত্তোলন বৃদ্ধির পরিবর্তে এলএনজি আমদানিতেই কেন্দ্রীভূত পেট্রোবাংলার জ্বালানি সংস্থান কার্যক্রম। 

আর্থিক সংকটের বিষয় স্বীকার করেছেন পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এলএনজি ও আইওসির জন্য অর্থ সংস্থান করা যাচ্ছে না। এ অর্থের জন্য সরকারের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইওসি ও এলএনজি আমদানির অর্থ আমরা পাচ্ছি। সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার মতো আমদানির অর্থ পেট্রোবাংলা পেয়েছে। তবে বিল পরিশোধে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, সেটি মূলত টাকার জন্য নয়, এটি ডলারের সংকট। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যত দ্রুত এ সংকট নিরসন করা যায়।’

এলএনজি আমদানিতে গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে অর্থ সংকটে ভুগছে পেট্রোবাংলা। পণ্যটি আমদানি বাবদ অর্থ সংকট একদিনে তৈরি হয়নি বলে মনে করেন জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, বছরের পর বছর ধরে স্থানীয় জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধানে পেট্রোবাংলার উদাসীনতা ও আমদানিনির্ভরতায় ঝুঁকে পড়াই সংস্থাটির বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে ক্রমবর্ধমান হারে গ্যাসের ঘাটতি তৈরি হলে তা এলএনজি দিয়ে মেটানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেটি করা যায়নি। বরং এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে পেট্রোবাংলার বিপুল অংকের আর্থিক ঘাটতি তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি গ্যাস খাতের তহবিল শেষ হয়েছে। এখন গ্যাস অনুসন্ধানে পর্যাপ্ত অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না, গ্যাস উন্নয়ন তহবিলেও অর্থ নেই। আমদানিনির্ভর জ্বালানি দিয়ে দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণ করার এ পরিকল্পনা যে ভুল ছিল, তার দৃশ্যত উদাহরণ পেট্রোবাংলার আর্থিক কার্যক্ষমতা হারানো।’

দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও গ্যাসের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গত দশকের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ ছিল ১০৮টি কূপ খননের পরিকল্পনা নেয়া। পেট্রোবাংলার আওতাধীন কোম্পানি বাপেক্সের এ উদ্যোগ সে সময় সাড়া ফেললেও অবিন্যস্ত এসব পরিকল্পনা পরবর্তী সময়ে কোনো কাজেই আসেনি। ২০২১ সালে বাপেক্সের মাধ্যমে কূপ খনন করে জাতীয় গ্রিডে এক হাজার এমএমসিএফ গ্যাস যুক্ত করা ছিল এ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য। কিন্তু দেশের কয়েকটি এলাকায় কূপ খনন করে গ্যাস না পাওয়ায় এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন আর সফল হয়নি।

দেশের গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রমের মধ্যেই আমদানিনির্ভর এলএনজির সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে কাতার ও ২০১৮ সালের মে মাসে ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বার্ষিক সর্বোচ্চ ৪০ লাখ টনের এ এলএনজি আমদানি চুক্তি বাংলাদেশকে আমদানীকৃত গ্যাসের যুগে প্রবেশ করায়। স্থানীয় গ্যাসের ক্রমবর্ধমান হ্রাসের মধ্যেই ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। সে সময় বিশ্ববাজার থেকে কমমূল্যে এলএনজি আমদানির লোভনীয় সুযোগও পেট্রোবাংলাকে স্থানীয় গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রমে অমনোযোগী করে তোলে বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে দেশে গ্যাস উৎপাদন বাড়তে থাকে। তবে ২০১৭ সালে স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকার এলএনজি আমদানিতে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু বিশ্ববাজারে এলএনজি আমদানিতে ২০২০ সাল পর্যন্ত সুবিধা করতে পারলেও কভিড মহামারী এবং পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়। সে সময় পণ্যটির দাম ৭০ ডলার পর্যন্ত ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে গত বছরের জুলাই থেকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে জ্বালানি বিভাগ। কিন্তু স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন হ্রাস এবং আমদানি গ্যাসের বড় নির্ভরতা তৈরি হওয়ায় বিশ্ববাজারে দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকা সত্ত্বেও চলতি বছরের জানুয়ারিতে আবারো এলএনজি কিনতে এক প্রকার বাধ্য হয় পেট্রোবাংলা। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে এখন পণ্যটির দাম প্রতি এমএমবিটিইউ ১২ ডলারে নেমে এসেছে।

পেট্রোবাংলার আর্থিক সংকট দৃশ্যমান হয় মূলত ২০২০ সালে। সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির উদ্বৃত্ত তহবিল কোষাগারে স্থানান্তর করার নির্দেশনা জারি করে। এরই অংশ হিসেবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো পেট্রোবাংলাকেও রাষ্ট্রীয় তহবিলে সংস্থাটির প্রায় ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা জমা দিতে হয়। পেট্রোবাংলা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যখন এ পরিমাণ অর্থ জমা দেয়, তখন সংস্থাটির বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে আমানত ছিল ১৮ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়া এ অর্থের বড় অংশই (৩ হাজার কোটি টাকা) নেয়া হয় গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) থেকে। এখনো সে অর্থ ফেরত পায়নি পেট্রোবাংলা। 

পেট্রোবাংলার আর্থিক সংকট তৈরি হওয়ার পেছনে গত কয়েক বছরের হিসাব মেলানো উচিত হবে না বলে মনে করেন জ্বালানি খাতের অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি দীর্ঘ সময়ে পেট্রোবাংলার সিদ্ধান্তহীনতারই ফসল। যথাসময়ে পেট্রোবাংলা আমদানিনির্ভরতার পাশাপাশি স্থানীয় গ্যাসের অনুসন্ধানে মনোযোগী হয়ে তার কোম্পানিগুলোকে কাজে লাগালে এ অর্থ সংকটের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। বরং পেট্রোবাংলা ভালো অবস্থানেই থাকত।’ 

আন্তর্জাতিক বাজারে যখন এলএনজি সংকট ও দাম ঊর্ধ্বমুখী ঠিক সে সময় দেশে ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা নেয় জ্বালানি বিভাগ। ২০২৫ সালের মধ্যে এসব কূপ খননের মাধ্যমে দেশের জাতীয় গ্রিডে ৬১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দৈনিক যুক্ত করার পরিকল্পনা সংস্থাটির। যদিও এসব কূপের বেশির ভাগই পুরনো ও ওয়ার্কওভার করা। এরই মধ্যে এসব কূপ খনন করে অনেক কূপে গ্যাসও মিলেছে। তবে এসব কূপ আরো আগে খনন করা হলে গ্যাস পাওয়া যেত বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিনটি কূপ খনন করলে একটিতে সাফল্য পাওয়া যায়। সে হিসেবে অধিক মাত্রায় কূপ খনন করলে পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সে পথে না গিয়ে সহজ এবং ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির পথে অগ্রসর হচ্ছে পেট্রোবাংলা। কিন্তু অস্থিতিশীল বাজারে এ ধরনের পণ্য আমদানি করতে গিয়ে পেট্রোবাংলা একদিকে যেমন আর্থিক ঘাটতিতে পড়েছে, অন্যদিকে এ আর্থিক ঘাটতি সংস্থাটির অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।’

যদিও জ্বালানি বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দেশে মোট ২১টি অনুসন্ধান কূপ, ৫০টি উন্নয়ন কূপ, ৫৬টি কূপের ওয়ার্কওভার করা হয়েছে। এ সময়ে এক হাজার এমএমসিএফডি গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন