নাইন প্লাস ওয়ান

আন্তঃসংযুক্ত জীবনের সিম্ফনি

রুহিনা ফেরদৌস

‘নাইন প্লাস ওয়ান: ইন্টার ডাইমেনশনাল জার্নিস’ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা ছবি: এজ গ্যালারি প্রদর্শনীটি চলবে ৮ জুলাই পর্যন্ত

দেবতা ডায়োনিসাসের কাছে অদ্ভুত এক বর চেয়েছিলেন ফ্রিজিয়ার রাজা মিডাস। চাওয়ামাফিক যা কিছু তিনি স্পর্শ করেন সব স্বর্ণে পরিণত হতে থাকে। মুশকিলটা বাধে মিডাস যখন কোনো মানুষকে স্পর্শ করছেন, সে স্বর্ণের মূর্তি হয়ে যাচ্ছে। মিডাস যখন তৃষ্ণার্ত হয়ে পানির পাত্র হাতে তুলে নিচ্ছেন, তা স্বর্ণ হয়ে যাচ্ছে। বস্তুগত ভোগবাদিতার করুণ পরিণতি মিডাস যেন আমাদের উপলব্ধিহীন বর্তমানের সংকটগুলো দেখিয়ে দেয়। নারগীস পলিরগিফট ফ্রম কিং মিডাস টু দ্য পুওর শিল্পকর্মটিও যেন হালের দুনিয়ার বস্তুগত লোভ-লালসার প্রতি মকারি। ছবিতে দেখা যায় একজন সৈনিক স্বর্ণের আপেল নিয়ে আসছেন, চারপাশে অসংখ্য পিঁপড়া ছড়িয়ে আছে। কাজটি সম্পর্কে শিল্পী বলেন, ‘বর্তমানের আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ তথাকথিত উন্নয়ন দিয়ে আমাদের বোঝায়, এই দেখো, তোমাদের জন্য স্বর্ণের আপেল নিয়ে এসেছি। কিন্তু উন্নয়ন, অবকাঠামো এগুলো দিয়ে তো আসলে গরিবের পেট ভরে না। আপেলের চারপাশে ছড়ানো পিঁপড়াগুলোকে আমি রূপক অর্থে সাধারণ দরিদ্র মানুষকে বুঝিয়েছি; পুঁজিবাদী শ্রেণী মনে করে যাদের সহজে পিষে ফেলা যায়।

৪৬টি পেইন্টিংস ১৫টি ভাস্কর্য নিয়ে ১৮ জন তরুণ শিল্পী যূথবদ্ধ হয়েছেন গুলশানের এজ গ্যালারিতে চলমাননাইন প্লাস ওয়ান: ইন্টার ডাইমেনশনাল জার্নিস প্রদর্শনীতে। শিল্প সংগ্রাহক রেজওয়ান রহমানের প্রয়াসে নির্বাচিত শিল্পীদের কাজের মধ্যে হদিস মেলে আন্তঃসংযুক্ত ঐকতানের। যেখানে আছে বিশ্বায়ন, আঞ্চলিক ব্যবচ্ছেদ, টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়া মূল্যবোধ, অস্তিত্বের বহুমুখী সংকট, রোজকার লড়াই-সংগ্রাম-পীড়ন পুরাণের আলাপ।

প্রত্যেক শিল্পী তাদের দেখা, ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে। অপু রাজবংশীর দ্য ফিশারম্যান, সৈয়দ তারেক রহমানের ইগজিস্ট্যান্স-, শরদ দাসের স্ট্রাগল উইথ মিস্ট্রি, রুপম রায়ের ইনার নেচার অব সাউন্ড-১০ কাজগুলোর কথা উল্লেখ করতে হয় আলাদা করে। শিল্পীরা কাজ করেছেন ভাস্কর্য মাধ্যমে। কিন্তু গ্যালারিজুড়ে সবার কাজগুলো আন্তঃসংযুক্ত অনুভূতির সিম্ফনি ছড়িয়ে দেয়।

ক্যানভাসে স্বপ্নের সমাজকে আঁকেন রাসেল রানা। তার ক্যানভাসের বিষয়বস্তুর বহুমাত্রিক স্তর জীবন সমাজের জটিলতাকে প্রতিফলিত করে সাবলীল ভঙ্গিতে। তার ছবির রঙ-তুলি বলে আমরা তো স্বর্গের স্বপ্ন দেখি, অথচ পৃথিবীটাই তো সেই স্বর্গ হতে পারে। যেখানে কারো সঙ্গে কারো কোনো সংঘাত, বিভেদ, লৈঙ্গিক দ্বন্দ্ব নেই।

নাজমুন নাহার কেয়া কাজ করেন পুরান ঢাকা নিয়ে।কিনটসুগি ঢাকা নামের কাজে তিনি পুরান ঢাকার চির ধরে যাওয়া, ভেঙে পড়তে থাকা ঐতিহ্যবাহী অবকাঠামোর ছবি তুলে তা ক্যানভাসে জোড়া লাগিয়েছেন। কিনটসুগি এক ধরনের জাপানি শিল্প; কোনো কিছু ভেঙে গেলে সেখানে স্বর্ণের প্রলেপ দিয়ে তা জোড়া লাগানো হয়। আমরা মানুষেরাও তো কতশতভাবে ভেঙে যাই, ক্ষত আড়াল করি। ভেতরে জ্বলজ্বল করতে থাকা ক্ষতকে রূপক প্রলেপ দিয়ে সাজিয়ে নিতে হয়। নিজের অপূর্ণতাকেও এভাবে আলিঙ্গন করা যায় বলে মনে করে জাপানি দর্শন।

তবে সব ক্ষত আড়ালের তত্ত্বে বিশ্বাসী নন ফারজানা আহমেদ ঊর্মি। তিনি বরং তার ক্যানভাসজুড়ে ক্ষত আঁকেন। ডিসপ্লেসমেন্টের বাংলা যদি হয় উৎখাত, তাহলে ঊর্মির আঁকামকবুল এর সবচেয়ে স্পর্শকাতর উদাহরণ। ঘর পোড়া, জমিন হারানো মকবুল কক্সবাজারে এসেছেন নাফ নদী পাড়ি দিয়ে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঊর্মি তাকে খুঁজে পান। কারিগর মকবুলকে দেখে ঊর্মির মনে হয়েছে বাস্তুচ্যুত মানুষটির ভাবনাগুলো তো দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। একটা ভাবনা সে নাফ নদীর ওপারে রেখে এসেছে, অন্যটা সে বহন করছে। ৪৮×৬০ ইঞ্চির ক্যানভাসজুড়ে আঁকা মকবুল যেন পৃথিবীজুড়ে থাকা নির্বাসিত মানুষের প্রতিচ্ছবি।

ঊর্মি কাজ করেন মেন্টাল ফিজিক্যাল ডিসপ্লেসমেন্ট নিয়ে। কেন এই ডিসপ্লেসমেন্ট? তিনি বলেন, ডিসপ্লেসমেন্ট কি সামাজিক সংকটের কারণে হচ্ছে? মানুষের ক্রাইসিসটাই আমার কাছে বড় মনে হয়। নিজের সংকটগুলোর পাশে অন্যেরটা রেখে দেখতে বুঝতে চাই থেকে কোনো উত্তরণ আছে কিনা। মানুষের অন্তর্মুখী যে যাত্রাটা, তাতে অংশগ্রহণ করতে চাই আমি। আমার কাজের মধ্যে আমি বিষয়গুলো খুঁজতে থাকি।

মাহমুদা সিদ্দিকারসেভ দ্য ফ্লাওয়ার কাজটিতে মাঝখানে একটি সাদা গোলাপ আর তার ব্যাকগ্রাউন্ডে অনেকগুলো পোর্ট্রেট যা কিনা কল্পনায় যুদ্ধ আক্রান্ত অসহায় মানুষের মুখচ্ছবি। তিনি বলেন, আমার কাজে দুই পাশে দুটো বোমার ফর্ম, এতে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অতিসাধারণ প্রতিচ্ছবি রয়েছে। কিছু ভালো সময়ের স্মৃতি, অতিসাধারণ কিছু বস্তু যা মনকে মুহূর্তেই ভালো করে দেয় এমন কিছু ছবি রয়েছে। যে বোমার মতো বিধ্বংসী একটা বস্তুকে এর প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি ভেঙে তার মধ্যে সরল সাধারণ সময়ের দিকে ইঙ্গিত দিতে চেয়েছি কিংবা সাধারণ মানুষের ভাবনাকে প্রকাশ করতে চেয়েছি আমার শিল্পের মধ্য দিয়ে; তাতে হয়তো যুদ্ধ থেমে যাবে না বা একদিনেই শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না। তবু আমি আশা করি একটা সুখী, সুন্দর সময় আসবে।

উপলব্ধি শিরোনামে সুবর্ণা মোর্শেদার কাজে ছড়িয়ে রয়েছে প্রিয় মানুষের অনুপস্থিতির তীব্রতা, ব্যথা। তিনি বলেন, আমার দাদির মৃত্যুর পর গায়ের গন্ধ থেকে শুরু করে তার সঙ্গে কাটানো প্রতিটি বিষয় আমাকে তাড়া করে ফিরেছে। দীর্ঘদিন ট্রমাটাইজড ছিলাম আমি। কিন্তু গায়ের গন্ধ, স্পর্শ তো আঁকা যায় না। দাদি প্রিন্টের শাড়ি পরতেন। নীল রঙ খুব পছন্দের ছিল। তখন আমি তার শাড়ির প্রিন্ট, তার পছন্দের রঙ নিয়ে কাজ করি।

মানুষ সবসময় তার নিজের গল্পই বলে। আমাদের চারপাশে ছড়ানো প্রতিটি মানুষেরই আছে নিজস্ব উপলব্ধির, অভিব্যক্তির কথা। বহুমাত্রিক উপস্থাপনের মাধ্যমে টুকরো, ছেঁড়া গল্পগুলোই তুলে ধরে গোটা মনোজগৎকে; যেখানে রোজকার ব্যথা-বাস্তবতা আছে, আছে পিছুটান কিংবা ঘুরে দাঁড়ানো। তরুণ শিল্পীদের কাজ সামাজিক, আধুনিক দিকগুলোর আলোকে সম্মিলিত মানবিক উদ্বেগগুলো বহন করে। তাদের নির্বাচিত মাধ্যম আর ক্যানভাসজুড়ে আঁকা বহুমাত্রিক রঙ, রেখা, অভিব্যক্তি, ভাংচুরগুলো আমাদের মণ্ডন দৃষ্টিকে পুনরায় মূল্যায়ন করতে প্ররোচিত করে। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী অন্য শিল্পীরা হলেন সোমা সুরভী জান্নাত, জান্নাতুন জান্নাত, আনিসুজ্জামান ফারুক, রাকিবুল আনোয়ার, অন্যন্যা মেহপার আজাদ, অন্তরা মেহরুখ আজাদ, আজীজী ফাউমি খান হৃদিতা আনিশা।

১৮ জন শিল্পীর প্রত্যেকের কাজ আলাদা হলেও তাদের ভাবনাগুলো একত্রিত, যূথবদ্ধ পারস্পরিক সহাবস্থানে রাজি হয়ে ঐক্যের সিম্ফনি সুর ছড়ায়। আমন্ত্রণ জানায় বর্তমানের না হয়ে ওঠা আলাপের, মানুষের অস্তিত্বের বহুমুখী প্রকৃতি নিয়ে চিন্তার।

‘এ শিল্পীরা প্রচলিত ধারা থেকে ভিন্ন’

রেজওয়ান রহমান

নাইন প্লাস ওয়ানের জার্নিটা শুরু হয় প্রায় সাত মাস আগে। আমি বিভিন্ন তরুণ শিল্পীর স্টুডিও ভিজিট করি, তাদের কাজ দেখি। এ কাজগুলো আমার ভিন্ন মনে হয়েছে। শিল্পীরা কাজ করেছেন নিজস্ব স্টাইল ধরে রেখে; বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভাবেননি।

 বয়সের তুলনায় এ শিল্পীদের কাজ অনেক বেশি পরিণত। এরা প্রচলিত ধারা থেকে ভিন্ন। আমি ২২ বছর ধরে আর্ট কালেক্ট করি। আমার অভিজ্ঞতা বলে, প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা এক ধরনের কমফোর্ট জোনে চলে যান। তারা একটা স্টাইল গ্রহণ করে নেন এবং তা থেকে আর সরে আসেন না। কেননা তারা জানেন যে ওই স্টাইল দিয়েই মানুষ তাদের কাজগুলো চেনে। 

এজ গ্যালারির এ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের প্রত্যেকেই ভীষণ প্রতিভাবান। তারা নিজেদের মতো করে কাজ করে যাচ্ছেন। বাইরের অনেকেই তা জানেন না। তাই মনে হয়েছে এজ গ্যালারিতে যদি এ শিল্পীদের কাজের প্রদর্শনী করা হয়, তাহলে গুলশানের শিল্প সংগ্রাহক, শিল্পপ্রেমীরা তাদের সম্পর্কে জানবেন, কাজ সম্পর্কে ধারণা পাবেন। এ উদ্যোগের পেছনে মূল কারণ এটা, তাদের কাজগুলোকে তুলে ধরা। আমি মনে করি, তরুণ এ শিল্পীরাই বাংলাদেশের আর্ট সিনের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতে দেখা যাবে, এদের মধ্য থেকেই বাংলাদেশের নেক্সট গ্রেট আর্টিস্ট বের হয়ে আসবেন। 

সোমা সুরভী জান্নাত যেমন পেনসিল দিয়ে ক্যানভাসের ওপর কাজ করেন। তিনি ইনস্টলেশন করেন, পেইন্টিংও। অন্তরা মেহরুখ আজাদের কাজ ইন্টারেস্টিং। তিনি বন্যা, নগরায়ণের ওপর কাজ করেন। নির্দিষ্ট রঙ ব্যবহার করেন। রাসেল রানার কাজ অনেক বেশি বোল্ড। আমি খুব খুশি যে রাসেলের কাজ এখানে আছে। এ সমাজের মধ্যে থেকে রাসেল যে সাহসিকতার সঙ্গে আপসহীনভাবে তার কাজ করছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার। আমরা মনে করি, প্রদর্শনী এমন হওয়া উচিৎ যেখানে প্রত্যেক শিল্পীর চিন্তার ও কাজের স্বাধীনতা থাকবে। 

আমরা ভাবছি এ ধরনের বার্ষিক প্রদর্শনী করতে। প্রতি বছর এ আয়োজনের মাধ্যমে নতুন অন্য শিল্পীদের আমরা আবিষ্কার বা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। অনেক শিল্পী আছেন যাদের আমরা নাইন প্লাস ওয়ানে জায়গা দিতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে তাদের অন্তর্ভুক্ত করব, এটাই পরিকল্পনা। 

রেজওয়ান রহমান: নাইন প্লাস ওয়ান প্রদর্শনীর কিউরেটর, শিল্প সংগ্রাহক ও ব্যবসায়ী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন