সাক্ষাৎকার

৭৫ বছরেও আমাদের শিল্পের বাজার তৈরি হয়নি

কায়ার কর্ণধার শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী। ছবি: গ্যালারি কায়া

২০ বছরে পা রেখেছে গ্যালারি কায়া। এ উপলক্ষে প্রথিতযশা ৫০ শিল্পীর বিভিন্ন মাধ্যমে আঁকা ৭৮টি শিল্পকর্ম নিয়ে চলছে ১৯তম বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। ২ জুন প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। দুই যুগের পথচলা, প্রতিবন্ধকতা, অর্জনগুলো নিয়ে কথা বলেছেন কায়ার কর্ণধার ও শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী। সাক্ষাৎকার গ্রহণে রুহিনা ফেরদৌস

কী চিন্তা থেকে গ্যালারি কায়া শুরু করেছিলেন?

গ্যালারি করার কোনো চিন্তা ছিল না। স্থপতি সামসুল ওয়ারেস বাড়িটির নকশা করার সময় তাকে বলেছিলাম, চাচা, একটা বড় হল রাখবেন, যেখানে আমি বা বাবা (দেবদাস চক্রবর্তী) ১০-২৪ ফুটের বড় ক্যানভাসে কাজ করতে পারি। বাড়ির কাজ শেষ হলো। নিচতলাটা ভাড়া দেয়ার পরিকল্পনা। হঠাৎ একদিন চারপাশের শূন্য দেয়ালে চোখ রেখে মনে হলো এখানে যদি শিল্পকর্ম রাখি। এভাবে গ্যালারির চিন্তাটা আসে।

শুরুতে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল?

গ্যালারি কায়ার অবস্থান উত্তরায়। শাহবাগকে আমরা যদি ঢাকার সিটি সেন্টার ধরি, তাহলে কায়া কিছুটা দূরে। জাতীয় জাদুঘর, চারুকলা অনুষদসহ অন্যান্য গ্যালারিও ওদিকে। আমাদের চ্যালেঞ্জটা ছিল অবস্থানগতএত দূরে প্রদর্শনী দেখতে লোকেরা কেন আসবে। মনে আছে, বশীর চাচা (শিল্পী মুর্তজা বশীর) বলেছিলেন, ‘তুই চালাতে পারবি? এত দূরে লোকজন যাবে?’ শুরু থেকেই আমরা তাই এমন ধরনের আয়োজনের চেষ্টা করে আসছি, যাতে মানুষের আগ্রহ তৈরি হয় এবং তা প্রথম প্রদর্শনী থেকেই হতে হবে।উদ্বোধন শিরোনামে ৫০ জন শিল্পীর যৌথ চিত্রকর্ম নিয়ে ২০০৪ সালের ২৮ মে গ্যালারি কায়া আত্মপ্রকাশ করে। প্রথম প্রদর্শনীর আয়োজন করতে করতেই আমি পরবর্তী দু-তিনটি প্রদর্শনী কেমন হবে, কোন শিল্পীরা থাকবেন, সে পরিকল্পনা করে ফেলি। মনে আছে, প্রথম প্রদর্শনী উদ্বোধনের আগে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান আমার কাছে জানতে চাইলেন, শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের কাজ পেয়েছি কিনা। আমি না বলাতে তিনি তার সংগ্রহ থেকে একটি কাজ দেন। ওপেনিংয়ের দিন শিল্পী আমিনুল ইসলাম, মোহাম্মদ কিবরিয়া, মনিরুল ইসলাম থেকে শুরু করে অনেকে এসেছিলেন।

বাংলাদেশের অনেক গ্যালারিই দু-তিন বছরের বেশি চলেনি। কোন বিষয়গুলো কায়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে?

কায়া যখন শুরু হয়, ঢাকায় তখন গ্যালারি বলতে বেঙ্গল গ্যালারি আর শিল্পাঙ্গন। বেঙ্গল থেকে আর্ট ক্যাম্প করা হতো। গ্যালারি কায়া প্রথম আর্ট ক্যাম্প করে ২০০৬ সালে, যমুনা রিসোর্টে। এতে অংশ নিয়েছিলেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, নিতুন কুন্ডু, হামিদুজ্জামান খান, কালিদাস কর্মকার, কাজী রকিবসহ অনেকে। শুরু থেকে আমরা সিনিয়রদের পাশাপাশি জুনিয়র শিল্পী নির্বাচনকে গুরুত্ব দিয়েছি। তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরা যখন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের গল্প কাইয়ুম চৌধুরী বা মুর্তজা বশীরের থেকে শুনেছে, গল্পগুলো তারা বহন করছে। গল্প এভাবেই বেঁচে থাকে। ধরনের আয়োজনে বড় শিল্পীদের সঙ্গে তরুণদের দূরত্বগুলো কেটে যায়। প্রথম আর্ট ক্যাম্পের মাধ্যমে খুব সাড়া পড়ে। সংবাদমাধ্যমগুলো বিশ্বাসযোগ্যভাবে খবর প্রকাশ করে। শিল্পীদের সমর্থন পাই। সংগ্রাহকদের আগ্রহ তৈরি হয়, যা সহায়ক হয়েছে। কায়ার পক্ষ থেকে পর্যন্ত দেশে দেশের বাইরে সাতটি ক্যাম্প ৩১টা আর্ট ট্রিপ করেছি আমরা।

উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রদর্শনী সম্পর্কে জানতে চাই।

২০০৬ সালে শম্ভু আচার্য্যের শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। ওই প্রদর্শনীর কাজগুলোওভার সোলড হয়। অর্থাৎ গ্যালারিতে ১০টি কাজ থাকলে ১৫টি বিক্রি হয়েছে। ২০০৭ সালে মুর্তজা বশীরের এচিং, লিনো, উডকাটের প্রেজেন্টেশন করি। তিনি জানালেন, তার কাছে প্রিন্ট নেই, কিন্তু প্লেট আছে। আমি দায়িত্ব নিয়ে কাজের লিমিটেড এডিশন করাই। প্রিন্ট করার এথিকস বা আন্তর্জাতিক চর্চা আছে। একটা প্লেট থেকে তিনটি আর্টিস্ট প্রুফ এবং ১০টা প্রিন্ট বের হয়। তিনটি আর্টিস্ট প্রুফের একটা শিল্পীর, একটা গ্যালারির, অন্যটা যে প্রিন্ট করবে তার। বাকিগুলো ডিসপ্লে হবে। প্রদর্শনীর শেষ দিন আমরা মুর্তজা বশীরের উপস্থিতিতে প্লেটগুলো নষ্ট করে ফেলি। এছাড়া রণজিৎ দাস, রতন মজুমদার, আশরাফুল হাসান, সৈয়দ আবদুল্লাহ্ খালিদ, মকবুল ফিদা হুসেইনসহ অনেকের কাজের প্রদর্শনীর কথা বলব।

শিল্পকর্মের মূল্য নির্ধারণ কীভাবে করেন, বিশেষ করে স্বনামধন্য তরুণ শিল্পীদের ক্ষেত্রে?

শিল্পী মুর্তজা বশীরের একটা ক্লাস ওয়ার্ক আছে, যেখানে লাল কালি দিয়ে কারেকশন করা। আমি যদি ভুল না করি তাহলে ৫০-এর মধ্যে তিনি ২৪ নম্বর পেয়েছিলেন। লাল কালির ওই কারেকশনটা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের। প্রদর্শনীতে কাজটি রাখলে বশীর চাচা আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি আমার অন্য কাজগুলো বাদ দিয়ে কাজটা রাখলে? আবার অন্য কাজের তুলনায় দামও দ্বিগুণ ধরেছো?’ আমি উত্তরে বলেছিলাম, কাজটিকালেক্টর আইটেম বলে আমি মনে করি। আপনার জীবনের যে জার্নি তাতে এটা একটা মাইলস্টোন। কাজটার দাম আমি ৫০ হাজার টাকা ধরি। তবে অন্য কাজের দাম ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা ঠিক করার সময় তিনি খানিকটা বিরক্ত হয়েছিলেন। দেখুন, মুর্তজা বশীরের যে কাজগুলো তখন ১০-২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে, আজ তার দাম লাখ থেকে সোয়া লাখ টাকা। ২০০৭ থেকে ২০২৩ সালে শিল্পকর্মের দাম ১০ গুণ বেড়েছে। আমরা আর্টে বিনিয়োগ বা শিল্পকর্মের বাজার নিয়ে কথা বলি। এটি নিশ্চয়ই সেক্ষেত্রে একটা ভালো রেফারেন্স।

আমাদের দেশের আর্ট মার্কেট কী অবস্থায় রয়েছে বা কতটা পরিণত হয়েছে?

চারুকলা ইনস্টিটিউট (বর্তমান চারুকলা অনুষদ) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালে। হিসেবে ৭৫ বছরের শিল্পচর্চার সময়েও আমাদের শিল্পের বাজার তৈরি হয়নি। অথচ পাশের দেশগুলোয় শিল্পের বাজারের পাশাপাশি ভিত্তি তৈরি হয়েছে। অন্য ১০টা জিনিসের মতো শিল্পের চাহিদা রয়েছে। মূল্য ওঠানামা করে। বড় বড় নিলাম হয়। আমাদের এখানে আজ পর্যন্ত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক অকশন হয়নি। সাধারণত যখন শিল্পকর্মের অকশন হয়, তখন এর পেছনে বিভিন্ন এক্সপার্টরা কাজ করেন। চিত্রকর্মের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করেন। দেখা যায় অকশনে অনুমিত মূল্যের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি দামে কাজটি বিক্রি হচ্ছে। এভাবে বড় ধরনের সাড়া পড়ে। অথচ শিল্পকর্ম কেনাকে আমরা এখনো ঘর সাজানোর বিষয় হিসেবেই মনে করি।

অবস্থায় কোন ক্ষেত্রগুলো নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন?

কাজটা শুধু একটা গ্যালারি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে করা সম্ভব নয়। সবাই মিলে চর্চা করা পেশাদারি মনোভাবের প্রয়োজন। যিনি চিত্রকর্ম সংগ্রহ করবেন তারও পেশাদারত্বের প্রয়োজন আছে। বৃহৎ পরিসরে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ থাকা দরকার। শিল্প-সংস্কৃতির জন্য বাজেটের একটা বড় অংশ বরাদ্দের প্রয়োজন, যেখানে নানা ধরনের পলিসি থাকবে। আমাদের দেশে ওই অর্থে কোনো ভালো প্রকাশনা নেই, গবেষণা নেই। অবস্থায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের ব্যক্তিগত পছন্দের ঊর্ধ্বে গিয়ে পেশাদারি মনোভাব নিয়ে কাজগুলো করতে হবে। নির্ভীক থাকতে হবে। শিল্পকলা একাডেমি এখানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারে। কোন শিল্পীকে কেন পুরস্কৃত করা হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার পরও যেন বলা সম্ভব হয়, ‘না ঠিক আছে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে তত আমাদের বিতর্কের জায়গাটা বড় হচ্ছে।

নানাভাবে গ্যালারির সংখ্যা বাড়ানো দরকার। প্রতিটি গ্যালারির নিজস্ব গতিপথ থাকে। কেউ ইম্প্রেশনিস্ট আর্ট, কেউ ক্ল্যাসিক্যাল কিংবা কেউ তরুণ শিল্পীদের নিয়ে কাজ করবে। যে পরিমাণ শিল্পী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের হচ্ছে তাদের প্রমোট করার জন্য বিভাগীয় পর্যায়েও গ্যালারি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আমাদের দেশে এমন কোনো আর্ট গ্যালারি বা পাবলিক মিউজিয়াম নেই যেখানে শিল্পকর্ম দেখতে দেখতে মানুষ চা-কফি পান করতে কিংবা সুভেনির কিনতে পারে। আমাদের কোনো পাবলিক আর্ট প্লেস নেই। মনে রাখা জরুরি, আমাদের রাজনৈতিক অর্জনের পেছনে সংস্কৃতির সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। নিরাসক্তভাবে কেউ যখন বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে যাবে, তখন সংস্কৃতির বিষয়গুলো উঠে আসবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন