লালসার উপাখ্যান

পাপমুখী ভোগবাদিতার আলাপ

শার্মিলি রহমান

কলাকেন্দ্রে শুরু হওয়া লালসার উপাখ্যান নামের তাসাদ্দুক হোসেন দুলুর চলমান চিত্রকর্ম প্রদর্শনীতে শিল্পী সুখভোগের সঙ্গে আনুষঙ্গিক পাপবোধের যোগসূত্রের অনুসন্ধান করেছেন। এ সংবেদনশীল বোধগুলো খুব অবিচ্ছেদ্যভাবে তার চিত্রকর্মে উপস্থিত হয়, যেখানে রঙের উজ্জ্বল ও আপসহীন ব্যবহার প্রথম দর্শনে আপনাকে মন্ত্রমুগ্ধ করলেও গভীরভাবে অবলোকন করলে খটকা লাগবে। প্রদর্শনীটির শিরোনামেই নাগরিক জীবনাচরণের আত্মপ্রসাদসর্বস্বতা আর পাপমুখী ভোগবাদিতার আলাপ পাওয়া যায়, যা কিনা বৈশ্বিক প্রভাবের অধীনে ডুবে যাওয়া বেপরোয়া রকমের মিশ্র সংস্কৃতির দুঃখ-বেদনার প্রতিনিধিত্ব করে। 

শিল্পীর শিল্পকর্মে মানবচেতনার বৈচিত্র্যের প্রশ্নে আঞ্চলিক, মাটি ঘেঁষা সংস্কৃতি বিকাশের ধারার সঙ্গে অসংলগ্ন, উন্নাসিক বিশ্বসংস্কৃতির ধারার সংঘাতের ফলে তৈরি হওয়া এক রুদ্ধশ্বাস সন্তরণের চিত্রপট ধরা পড়ে।

ব্যালান্স আর ফর্মে সাজানো চিত্রকল্পে নিলাজ ভাঁজ থাকা সত্ত্বেও তার শিল্পে উদ্ভট কিংবা অতিরঞ্জিত উপস্থাপনার বদলে নাগরিক রসবোধের পরিশীলিত উপস্থাপন দেখা যায়। এমনকি তার ড্রইংগুলো রূপান্তরিত বস্তুর নিবিষ্ট অধ্যয়নের দিকে সরে গেলে কিংবা মূল্যায়নের অদলবদল হলেও বাস্তববাদী আবহের একটা নীরব, ব্যঙ্গাত্মক সুর ধরে রাখে। 

তার কাজগুলো মানুষের মূর্খতা আর তার ফলাফলের প্রতিফলন হলেও সেগুলো ডিস্টোপিয়ার অন্ধকারের বাইরেই থাকে। তার পদ্ধতি আমুদে, কোনো প্রকার হীনতামুক্ত এবং মূলত অতীতের স্মৃতিকারতায় রঞ্জিত। 

এ স্মৃতিকাতরতা ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় ইতিহাসেরই একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, শিল্পীর স্মৃতিতে এ ইতিহাস বদলে গিয়ে শিল্পীর নিজস্বতার বোধে একটা গঠনমূলক ভূমিকা রাখে। এ পর্যবেক্ষণগুলো তার ডায়েরিতে লেখা আত্মজীবনীমূলক টুকরো গল্পগুলো থেকে নেয়া। 

শিল্পীর ক্যানভাসের পশ্চাৎপটে ভেসে ওঠে লোকসংস্কৃতির চিত্রমালা, ফাঁদে আটকে পড়া পাখি, উদ্ভিদ-প্রাণীর মাঝামাঝি পাখাওয়ালা রূপে রূপান্তরিত মানুষ। এ উদ্ভট প্রতীকগুলো অতীতকে ধারণ করে, একটা ভবিষ্যতের আভাস দেয় এবং বর্তমানকে প্রবঞ্চনা করে, ভাঁড়ের মাথাটা যে বিদ্রূপাত্মকভাবে তাকিয়ে থাকে—তা থেকেই এর আভাস পাওয়া যায়। নাগরিক অন্দরের রূপসজ্জায় শিল্পীর বর্তমানের সঙ্গে অস্বস্তিকর সম্পর্ক সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাতে দেখা যায় ক্ষয়িষ্ণুতা আর দৃষ্টিকটুতার আধিক্য, সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত প্রাকৃতিক বিকাশের অবদমিত ত্রাস আর অনিয়মিত আবেগ। প্রত্যেকটা ক্যানভাসই নিজেকে ভাঙা-গড়ার যুগপৎ প্রক্রিয়ার কথা বলে, তাতে সুস্পষ্ট রসবোধ আর পরিমিত উদ্ভটতার ভেতর দিয়ে অনিশ্চয়তার এক উদ্বায়ী পরিস্থিতি প্রদর্শিত হয়। 

দুলুর কাজগুলোয় রঙের ব্যবহার আবেগ ও নিষ্কলুষতার আভাস দেয়, মনে করিয়ে দেয় সিনেমার পোস্টার আর রিকশা পেইন্টিংয়ের কথা। অর্ধেক টানা শাটারের ওপর আঁকা আবেদনময় দেহচিত্র আবারো এ অনুপ্রেরণার ইঙ্গিত দেয়। যা কিছু ভোগ্য, তার সঙ্গেই জুড়ে আছে দুলুর শিল্পকর্মগুলো...মানবীয়, অমানবীয়, ভোজনযোগ্য কিংবা নিছক বস্তু—এ সব কিছুর মধ্যকার বিভাজনরেখা অস্পষ্ট হয়ে শিল্পকর্মগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এদের শূন্যতা এবং পারস্পরিক রূপান্তরপ্রবণতা। এ ছবিগুলোর পরতে পরতে অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ঠাসা, যা পাঠযোগ্যতার জন্য সাংস্কৃতিক সরঞ্জামাদি আর সংকেতের ওপর নির্ভরশীল। বেশির ভাগ কাজই নিবিষ্টভাবে পুরুষতান্ত্রিক স্বৈরদৃষ্টিভঙ্গির কপট এবং অতৃপ্ত খাসিলতের প্রতিনিধিত্ব করে, যা কিনা ব্যক্তি অথবা সমষ্টির রূপে মানুষ শিকারের নেশায় মত্ত এবং পুঁজিবাদের মুনাফার সর্বাধিকীকরণের প্রতিফলন। নারীদেহের লাস্যময় ভাঁজগুলোকে কাঁঠালের অবয়বে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে তিনি ভোগবাদী সমাজের প্রবঞ্চক চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছেন। দুলুর ছবিগুলো অনুশীলিত অবয়ব ধারণ করে, তাতে মানবিক নষ্টামিগুলো বস্তুজাগতিক বিষয়ে পরিণত হয় এবং এর ভেতর দিয়ে অমানব বিষয়গুলোকে তিনি মানুষের ভেতর বসবাস করান, মানুষের রূপ দেন, তাতে একটা সহাবস্থানমূলক বাস্তুতন্ত্রের সম্ভাবনা এবং তাকে বিঘ্নিত করার অপরিবর্তনীয় কুফলগুলোকেও ফুটিয়ে তোলা যায়। চলতি মাসব্যাপী চলমান ‘লালসার উপাখ্যান’ দৃষ্টি উদ্দীপক এবং চিন্তায় উসকানিমূলক অভিজ্ঞতা দেয়।

শার্মিলি রহমানের কিউরেটরিয়াল টেক্সটা

ইংরেজি থেকে ভাবানুবাদ: তাসনীমা ইসলাম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন