![](https://bonikbarta.net/uploads/news_image/news_344089_1.png?t=1720297035)
বয়স তখন পাঁচ। মা-বাবার সঙ্গে ফ্রাঁসোয়া জিলো ঘুরতে গেছেন সুইস আল্পসে। সেখানকার হালকা সবুজ তৃণভূমি ও গাঢ় সবুজ বনের মিশ্রণ তাকে অভিভূত করে। কচি মনে প্রশ্ন জাগে বাকিরাও কি তার মতো দেখছে? প্রশ্নের গূঢ় অর্থ ধরতে পারেননি বাবা। ‘বোকা’ মেয়েকে বললেন, সবার রেটিনা একই দেখে। নিয়তি যার চিত্রশিল্পী হওয়া, সে হার মানবে কেন! জিলো বলেন, সবার রেটিনা সমান, কিন্তু কল্পনা নয়।
‘অন দ্য ওয়ে’ শিল্পীকে যারা অল্পও জানেন, তাদের কাছে এ গল্প অবিশ্বাস্য নয়। পুরোপুরি স্বাধীন ও পুরুষের কর্তৃত্বকে বরাবরই অস্বীকার করেছেন তিনি। জিলো বলতেন, চোখের সামনে যা আছে তা নয়, বরং শিল্পীর ভেতর থেকে উদ্ভূত হয় শিল্প।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিকশিত স্কুল অব প্যারিসের অন্যতম এ মুখ একবার বলেছিলেন, দুনিয়ায় দুই ধরনের মানুষ আছে—সাহসী ও যারা এর উল্টো। সাহসীদের পথে অনেক বাধা, আর জীবনও বেশি আকর্ষণীয়।
প্যারিসের শহরতলির এক বুর্জোয়া পরিবারে ১৯২১ সালের ২৬ নভেম্বর জিলোর জন্ম। ১০ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই পড়েছেন। স্কুলে যাওয়ার পর আবিষ্কার করলেন, বাকি বাচ্চাদের চেয়ে এগিয়ে তিনি। কারণ যে নিয়মের কোনো অর্থ নেই তা মানতে বাধ্য নন।
দর্শনে স্নাতক শেষে ১৯৩৯ সালে পারিবারিক পছন্দে আইন স্কুলে ভর্তি হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওই পর্যায়ে প্যারিস জার্মানদের দখলে চলে গেলে চিত্রকলাকে জীবিকা হিসেবে বেছে নেন জিলো। বাবা এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে তাকে মারধর করেন এবং বাড়ি থেকে বের করে দেন।
নিজ স্টুডিওতে ফ্রাঁসোয়া জিলো। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
নিছক
শিল্পের জন্য জীবন কাটাতে আগ্রহী ছিলেন না। নাৎসিবিরোধী প্রতিবাদে অংশ নেয়ায় প্রতিদিন স্থানীয় থানায় হাজিরা দিতে হতো। বারণ ছিল প্যারিস ছাড়ার। মাতৃভূমির এ বন্দি অবস্থাও
আঁকা আছে তার ছবিতে।
১৯৪৩ সালে প্রথম প্রদর্শনীর বছরে পাবলো পিকাসোর সঙ্গে দেখা। ফ্রাঁসোয়া জিলোর বয়স ২১ ও পাবলোর ৬১। বয়সের ব্যবধান এ জুটির ১০ বছরের রোমান্টিক সম্পর্কে বাধা হতে পারেনি। যার বিস্তারিত আছে ‘লাইফ উইথ পিকাসো’ বইতে।
একসময় দুই সন্তানের মা ও পিকাসোর মডেল পরিচয়ে হতাশ হয়ে পড়েন জিলো। নিজের ব্যক্তিত্বকে পকেটে ঢুকিয়ে বাঁচতে চাননি। পিকাসোকে বলেছিলেন, আমি নিজের খুশিতে এসেছি, যখন চাই তখন চলে যাব। পিকাসো বললেন, আমার মতো লোককে কেউ ছেড়ে যায় না। পরে ফ্রাঁসোয়া জিলোকে নানা বিপত্তিতে ফেলেন পিকাসো।
ঠিক যে পরিবারে নিজের ইচ্ছার যোগ্য মর্যাদা পাননি জিলো। পিকাসোর সঙ্গে সম্পর্ক জটিল হলেও সম্ভবত পেশাদার চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্নপূরণে পথ দেখিয়েছিল। শিল্পীর আবেগ ভাগাভাগি করতে পেরেছিলেন। এই যৌথবাস কাজেও প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষ করে মানব শরীরকে ভেঙেচুরে দেখার ধরনটি। তবে পিকাসোর হিংসাত্মক ধরনকে কম প্রাধান্য দিয়ে শীতল ভঙ্গি বেছে নেন জিলো। এও বলা হয়ে থাকে, ফ্রাঁসোয়ার ওপর স্থায়ী আছর ছিল দীর্ঘদিনের বন্ধু হেনরি মাতিসের, যার রঙের ব্যবহার তাকে প্রভাবিত করে।
ছবি : নিউ ইয়র্ক টাইমস
আধুনিকতাবাদী দুই বড় শিল্পীর সঙ্গে জড়িয়ে গেলেও জিলো সবসময় নিজের পথটি খুঁজেছেন। একসময় তো নিজের কর্মের চেয়ে ‘পিকাসো প্রেমিকা’ পরিচয়টি বেশি আলো পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিমূর্ততাবাদী শিল্পীদের সঙ্গে যোগ দেন। তবে ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে নিজের প্রতিনিধিত্বমূলক শৈলী ও উপাদানে ফিরে আসেন। নানা সময়ে মাধ্যম ও বিষয়ে পরিবর্তন আনেন তিনি। ওই বছরের ৬ জুন মারা যান। এর কয়েক বছর আগে কাজের বিষয় হিসেবে বেছে নেন প্রকৃতি, সময় ও মহাজাগতিক শক্তি।
গত শতকের শুরুতে ইউরোপে একজন স্বাধীন নারীকে কোনো একটা বিষয় বেছে নিতে হতো। কিন্তু ফ্রাঁসোয়া জিলো সবসময় পুরোটাই চেয়েছেন। চাইতেন আবেগ ঢেলেই। তাই পেয়েছেনও। আর নিজের শর্তে যাপন করা দীর্ঘ জীবনে কখনো ক্লান্ত হননি।