আলোকপাত

আইএমএফ ও বৈদেশিক মুদ্রার সদ্ব্যবহার

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া

গত ৩০ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বোর্ড সভা বাংলাদেশের জন্য ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন (৪৭০ কোটি) ডলার ঋণ মঞ্জুর করেছে। ৭ কিস্তিতে ৪২ মাসে এ ঋণ দেয়া হবে। এ ঋণের গড় সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। বর্ধিত ঋণসহায়তা বা বর্ধিত তহবিল (ইসিএফ/ইএমএফ) থেকে দেয়া হবে ৩৩০ কোটি ডলার এবং রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির আওতায় পাওয়া যাবে ১৪০ কোটি ডলার। আইএমএফের প্রেস রিলিজে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা, সামাজিক ও উন্নয়নমূলক ব্যয়ে আরো সক্ষমতা তৈরিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার, আর্থিক খাত শক্তিশালী করা, নীতি কাঠামোর আধুনিকায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে জনগণকে সহনশীল করার কাজে এ ঋণ সাহায্য করবে।

নিঃসন্দেহে আইএমএফের উপর্যুক্ত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থ ব্যবস্থাপনার ওপর এ বহুজাতিক সংস্থাটির আস্থারই বহিঃপ্রকাশ। তবে আইএমএফের শর্ত মোতাবেক বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কারমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। যেমন রাজস্ব খাতে সংস্কার করে রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি করতে হবে, যার মাধ্যমে সামাজিক খাত, অবকাঠামো উন্নয়ন, সরকারি অর্থায়ন ও বিনিয়োগ এবং জলবায়ু পরিবর্তন খাতে অধিক বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হবে। আর্থিক খাত ও ব্যাংক ব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। নীতি কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের সহায়ক পরিবেশের সৃষ্টি করতে হবে। বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমিয়ে অর্থনীতির লোকসান কমানোরও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ফলে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়বে। বাজেটের ঘাটতি সীমিত রাখার কথাও বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে দেশী-বিদেশী ঋণ গ্রহণ ও সরকারি অর্থ ব্যয়ে লাগাম টানা যায়।

তবে এ মুহূর্তে আইএমএফের সব শর্ত এক সঙ্গে পালন না করলেও প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, অনিয়ম দূর করে সুশাসন আনয়ন ও দেশের কর-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি করে স্বনির্ভরতা আনয়নের জন্য এসব সংস্কার বাস্তবায়নে দেশের অভ্যন্তরে সুশীল সমাজ ও অর্থনীতিবিদদেরও পরামর্শ রয়েছে। কৃষি, জ্বালানি ও গ্যাস-বিদ্যুতে ভর্তুকি পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনতে হবে।

বৈশ্বিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সরবরাহ চেইনে বিপর্যয়, মূল্যস্ফীতি প্রভৃতির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ কতিপয় সমস্যার দিকেও আশু নজর দেয়া এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। 

দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজ ও ব্যাংকাররা ব্যাংক ব্যবস্থার নানা দুর্বলতা চিহ্নিত করে বিস্তর লেখালেখি করছেন, কিংবা সভা-সেমিনারে আলোচনা করছেন। গত পাঁচ বছরে ঋণখেলাপিদের যে সুযোগ-সুবিধা ও ছাড় দেয়া হয়েছে তা নজিরবিহীন। এর ফলে ঋণ আদায়ের তো উন্নতি হয়ইনি, বরং খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ঋণের পরিমাণ আরো বেড়ে গেছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবমতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন প্রকার সুযোগ ও রাইট অফ করে যে খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলা হয়েছে তাসহ প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা বলে অনেকের অভিমত। ব্যাংকে সুশাসনের অভাবে মন্দ ঋণ ও অর্থ পাচার বাড়ছে। তাছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার এখন নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এনবিআর, বিএফআইইউ, দুদক কিংবা সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কেউই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। দেশের সচেতন মানুষ এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। ব্যাপারে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের আশু নজর দেয়া প্রয়োজন। 

বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ লোক বিদেশে থেকে চাকরিবাকরি করছে। ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডায় বসবাসকারী কতিপয় বাংলাদেশী ব্যতীত অন্য সবাই নিয়মিত দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণ করেন। কিন্তু অনেকেই বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রেরণ করেন না। হুন্ডি ব্যবসার কারণে কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পৌঁছে না। আবার দেশের রফতানি আয়েরও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশে রেখে দেয়া হচ্ছে। এসব কারণে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত বিরতিতে বাজারে বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়া সত্ত্বেও সংকট কাটছে না। এরই মধ্যে দেশীয় মুদ্রা (টাকা) প্রায় ২০-২২ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার দুষ্প্রাপ্যতার আর একটি কারণ হচ্ছে একশ্রেণীর ব্যাংক কর্মকর্তা, এক্সচেঞ্জ হাউজ এমনকি সাধারণ মানুষও দাম বাড়িয়ে ডলার/পাউন্ড/ইউরো পরে বিক্রি করার জন্য বেশ কিছুদিন রেখে দিচ্ছে। ডলার পাউন্ডের অবৈধ ব্যবসার কারণেও বৈদেশিক মুদ্রার বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এবং রফতানিসামগ্রীর কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলার জন্য তফসিলি ব্যাংক ডলার সরবরাহ করতে পারছে না। 

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুর্বিপাকের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের পাশাপাশি দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগও ক্রমান্বয়ে কমছে। টাকার মূল্যের পতন, পুঁজি বাজারের প্রাইস সিলিং, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ডলার সংকট, এনবিআরের ট্যাক্স ছাড়ের সুবিধাপ্রাপ্তি ও মুনাফা প্রত্যাবাসনে জটিলতা ইত্যাদি কারণে বিগত কয়েক বছর বৈদেশিক বিনিয়োগে নিম্নগতি পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে গত বছর ইকুইটি মূলধন, পুনর্বিনিয়োগকৃত আয় ও আন্তঃকোম্পানি ঋণ এ তিন খাতেই এফডিআই স্টক কমেছে। এছাড়া বিদেশী নতুন বিনিয়োগও তেমন আসছে না। দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে ব্যবসা সহজীকরণের যে প্রচেষ্টা হচ্ছে তার অগ্রগতি খুব সামান্য। বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানপূর্বক সমাধান বের করা জরুরি। 

বিদেশী বিনিয়োগের পাশাপাশি বর্তমান অর্থবছরে বিদেশী সহায়তার প্রতিশ্রুতি ও অর্থ ছাড়করণের পরিমাণও কমেছে। সাধারণত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি ডলারের সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সূত্রমতে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরে উন্নয়ন-সহযোগীদের কাছ থেকে মাত্র ১৭৬ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এছাড়া বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে উন্নয়ন-সহযোগীদের অর্থ ছাড়ও কম হয়েছে। দেশের রিজার্ভ কম থাকা ও ডলার সংকটের কালে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সঠিক উন্নয়ন প্রকল্প নির্বাচনের মাধ্যমে ডলার দেশে এলে সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারত।

বিগত বেশকিছু বছর ধরে দেশে উচ্চপ্রবৃদ্ধির আশায় বার্ষিক বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ ও আকার বাড়ানো হচ্ছে। বাজেট ঘাটতি ৪ থেকে ৬ শতাংশে সীমিত রাখার জন্য রাজস্ব সংগ্রহের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো বছরই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরিত হয় না। ফলে ঘাটতির পরিমাণ বাড়তে থাকে, যা অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে পূরণ করা হয়েছে। ফলে সরকারের ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার মতো সংস্থার সহজ শর্তের ঋণের সঙ্গে সঙ্গে চীন ও রাশিয়া বা ভারত থেকে উচ্চসুদের ও অপেক্ষাকৃত কঠিন শর্তের ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। ফলে বার্ষিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ প্রতি বছরই বাড়ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের শেষে বিদেশী ঋণ দাঁড়াবে প্রায় ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৪ সালের শেষে এই ঋণ ১২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারে। ২০২১ সালে সরকার সুদসহ ২ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে। ২০২২ সালে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ হয়েছে পূর্ববর্তী বছরের প্রায় দ্বিগুণ। ২০২৪ সালে এ ঋণ পরিশোধের পরিমাণ পূর্ববর্তী বছরের তিন গুণ ছাড়িয়ে যেতে পারে। এমতাবস্থায় বহুজাতিক সংস্থার ঋণ ব্যতীত অন্য কোনো দেশ থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে এবং ঋণের শর্তাবলির ব্যাপারে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অবশ্য বছর বছর আমাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও বাড়ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেসরকারি বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের পরিমাণও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বর্তমানে বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২৬০০ কোটি ডলার। বেসরকারি খাতে গৃহীত ঋণের ক্ষেত্রেও সরকারকে গ্যারান্টি প্রদান করতে হয়। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটকালে বেসরকারি ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার ওপর বাড়তি চাপের সৃষ্টি করছে। ব্যাংকের ঋণের মতো বিদেশী ঋণ কোনো বেসরকারি ব্যক্তি বা কোম্পানি কর্তৃক খেলাপি হলে এর দায়ভার সরকারের ওপর বর্তাবে। বিষয়টি সঠিকভাবে তদারকি না করলে ভবিষ্যতে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। 

বৈদেশিক মুদ্রা সদ্ব্যবহারের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের প্রতি দৃষ্টি দেয়া দরকার। প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে গৃহস্থালি ও শিল্প-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবি ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার হয়তো শিগগিরই জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পুনর্ভরণ এক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজন। আইএমএফের কাছ থেকে ফেব্রুয়ারিতে প্রাপ্ত ঋণের পাশাপাশি রফতানি বৃদ্ধি ও রফতানি আয় দেশে আনা নিশ্চিতকরণ এবং বৈধপথে বৈদেশিক আয় আনয়নের দিকে আশু দৃষ্টি দিতে হবে। 

পরিশেষে বলা যায় সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, পেশাজীবী, প্রবাসী বাংলাদেশী প্রভৃতি সবার দেশপ্রেম ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও দক্ষতা দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সাবেক সিনিয়র সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন