বাজেট বাস্তবায়নে ব্যাংকঋণ-নির্ভরতা আরো বাড়ল

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট চলছে। সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড কিনে সরকারকে ঋণ দেয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না ব্যাংকগুলোর হাতে। এজন্য চলতি অর্থবছরজুড়ে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থবছরের এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত নতুন টাকার পরিমাণ ছিল প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। এ পরিস্থিতিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা আরো এক-চতুর্থাংশ বাড়িয়েছে সরকার। ঘাটতি বাজেট মেটাতে আগামী অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে যে পরিমাণ ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সে পরিমাণ ঋণ দেয়ার সামর্থ্য ব্যাংকগুলোর নেই। সরকারকে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিলে দেশের বেসরকারি খাত ঋণবঞ্চিত হবে। এতে সরকার ঘোষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য পূরণ হবে না। এজন্য চলতি অর্থবছরের মতোই আগামী অর্থবছরেও বাংলাদেশ ব্যাংককে নতুন টাকা ছাপাতে হবে। এটি হলে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। গতকাল সংশোধিত বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ব্যাংক খাত থেকে ৮২ হাজার ৫৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। এ অর্থের ৮০ শতাংশই জোগান দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময়ে নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেয়া হয়েছে। সরকারের অর্থ সংকট তীব্র হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ দেয়ার সামর্থ্য দেশের ব্যাংকগুলোর নেই বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) এ শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতে তারল্যের সংকট আছে। চলতি অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে যে ঋণ নিয়েছে, সেটির ৮০ শতাংশের জোগান কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিয়েছে। আগামী অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকারকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ঋণ দিতে হলে সেক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংককেই এগিয়ে আসতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজে থেকে যত বেশি নতুন টাকা সরকারকে দেবে, দেশে মূল্যস্ফীতির চাপও তত বাড়বে। ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে বেসরকারি খাত ঋণবঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হবে।’

কয়েক বছর ধরেই জিডিপির ৫ শতাংশের বেশি ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করে আসছে সরকার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্যও রেকর্ড ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার ঘাটতি রেখে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে ঘাটতি বাজেট। রেকর্ড ঘাটতি বাজেট পূরণে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা দেশের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের ৮৬ হাজার ৫৮০ কোটি টাকার মেয়াদ হবে দীর্ঘ। বাকি ৪৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকার মেয়াদ হবে স্বল্প। যদিও মাত্র দুই বছর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নেয়া ঋণ ছিল ৭৫ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা।

চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৪৪ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত, সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে জনগণের কাছ থেকে সরকার এ ঋণ নিয়েছে।

দেশে ব্যাংক পরিচালনায় সুশাসনের ঘাটতি প্রকট হয়ে উছেছে। এতে রুগ্‌ণ ব্যাংক খাত আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছে। ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ বাড়ছে ধারাবাহিকভাবে। পরিচালনা পর্ষদের চাপে ব্যাংকে বাড়ছে বেনামি ঋণের পরিমাণও। এ পরিস্থিতিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের রূপরেখা, আইনি কাঠামো সংস্কারসহ ব্যাংক খাতের জন্য সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর কিছু পদক্ষেপ প্রত্যাশা করেছিলেন ব্যাংকাররা। করপোরেট করহার কমানো, ব্যাংকের বিভিন্ন সেবার ওপর আরোপিত অযৌক্তিক ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিও জানানো হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাংক থেকে বিপুল অংকের ঋণ নেয়া ছাড়া অর্থমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো ভালো খবর আসেনি।

প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের ব্যাংক খাতের জন্য তেমন কিছুই নেই বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে ব্যাংক খাতের সংস্কার, মার্জার অ্যাকুইজিশনের কথা আসবে। ব্যাংক খাতে সুশাসনের বিষয়ে কার্যকর বক্তব্য থাকবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দেয়া হবে। কিন্তু সে রকম কিছু পাইনি। বাজেট বক্তব্যে ব্যাংক খাত সম্পর্কে যেসব কথা এসেছে, সেগুলো চলমান প্রক্রিয়া। এতে নতুন কিছু দেখিনি।’

বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী মূলত গত এক বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে রয়েছে আমদানি কমাতে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও রফতানি আয় দেশে প্রত্যাবসনসংক্রান্ত নির্দেশনা। অর্থমন্ত্রী তার লিখিত বক্তব্যে বলেছেন, ‘৫০ লাখ টাকার অধিক মূল্যমানের বেসরকারি আমদানির ক্ষেত্রে ঋণপত্র খোলার জন্য অন্তত ২৪ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। যদিও শর্তটি ৩০ লাখ ডলার মূল্যের ঋণপত্রের ক্ষেত্রে আরোপ করা হয়েছিল।’

অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে আর্থিক খাতে জনমানুষের অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর জন্য গত ১৩ বছরে বাস্তবায়ন হওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব চালু, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস), বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে এনএফআইএস অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ইউনিট (এনএইউ) নামের একটি স্বতন্ত্র ইউনিট গঠনের কথা। এছাড়া ক্যাশলেস বাংলাদেশ গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ‘বাংলা কিউআর’ প্রবর্তন, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নেয়া গ্রিন ব্যাংকিংয়ের পুনঃঅর্থায়ন প্রকল্প, উদ্যোক্তা তৈরির জন্য নেয়া ইএসএফ প্রকল্পের কথা বাজেট বক্তব্যে তুলে ধরা হয়েছে।

তবে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন-২০২৩ প্রণয়নের কাজ চলছে। এ আইনে আর্থিক খাতের ঝুঁকি নির্ণয় ও ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়া দ্রুততর ও এর পরিধি ব্যাপকতর করার কৌশল নির্ধারণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি কমিটি কাজ করছে। কমিটি ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের রূপরেখা প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করেছে। আশা করছি, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপন করতে পারব। আমরা আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি প্রয়োগ করে ক্রেডিট স্কোরিং সিস্টেম চালু করার জন্য কাজ করছি। ডিজিটাল ব্যাংক ও ক্রেডিট স্কোরিং চালু হলে খুব সহজে ভুয়া ও বেনামি ঋণগ্রহীতাকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে বলে।’

এক দশক ধরেই দেশের ব্যাংক খাতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো খেলাপি ঋণ। বিগত সময়ে অর্থমন্ত্রীরা তাদের বাজেট বক্তব্যে ঋণখেলাপিদের বিষয়ে কিছু হলেও বক্তব্য রেখেছিলেন। তবে এবারের বাজেট বক্তব্য একেবারেই ব্যতিক্রম। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের গতকালের বাজেট বক্তব্যে খেলাপি ঋণ শব্দটি একবারও উচ্চারিত হয়নি।

গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকায়। ব্যাংক খাতে এত পরিমাণ খেলাপি ঋণ এবারই প্রথম। শুধু চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আর গত এক বছরে ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন