চট্টগ্রামে বড় প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও সেপ্টেম্বরে উদ্বোধনের পরিকল্পনা সরকারের

সুজিত সাহা I চট্টগ্রাম ব্যুরো

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন ও উদ্বোধনের মাধ্যমে প্রচারণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের বিভিন্ন মেগা ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প উদ্বোধনের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী সেপ্টেম্বরে। পুরোপুরি সম্পন্ন এবং এমনকি অর্ধেক সম্পন্ন প্রকল্প একই সময়ে উদ্বোধনের পরিকল্পনায় রয়েছে বলে জানা গেছে। বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার ঘোষণায় বিষয়টি উঠে এসেছে। 

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় অঞ্চলে যেসব দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করে তার অধিকাংশই বাস্তবায়নের পথে। এর মধ্যে রয়েছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু টানেল, চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বায়েজিদ লিংক, আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইন ও আখাউড়া-আগরতলা ক্রসবর্ডার রেল প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয়ের পরিমাণ ৪৬ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়াদ শেষ হওয়ার মুহূর্তে প্রকল্পগুলোর উদ্বোধনকে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর কৌশল হিসেবে দেখছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। 

চট্টগ্রামে চলছে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নদীর তলদেশে বহুলেন টানেল নির্মাণ প্রকল্প। কর্ণফুলী নদীতে নির্মিতব্য বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পটির কাজ প্রায় শেষ হয় চলতি বছরের শুরুতে। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ টানেল উদ্বোধনের পরিকল্পনা করেছিল সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি, মার্চ কিংবা এপ্রিলে। চলতি বছরের শুরুতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এটি উদ্বোধনের একাধিক ঘোষণাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে বিষয়টি নিয়ে কোনো নির্দেশনা না থাকায় এটি পিছিয়ে যায় বলে জানান এ প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে প্রকল্পের ৯৮ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। গত ২৬ এপ্রিল সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সেতু বিভাগে এক মতবিনিময় সভায় বলেছেন, ‘‌বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল আগামী সেপ্টেম্বরে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ টানেল উদ্বোধন করবেন।’

প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে পর্যটন শহরের সঙ্গে রেলপথে এ সংযোগ স্থাপন হবে। এরই মধ্যে প্রকল্পের ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ থাকায় রেলওয়ে ও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ আশা করেছিল মেয়াদের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে উদ্বোধনের মাধ্যমে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচল চালু করা হবে। 

১৬ মে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প পরিদর্শনে যান রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। পরিদর্শন শেষে তিনি ঘোষণা দেন, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ট্রেন চালু হবে। আগস্টের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করে সেপ্টেম্বরে উদ্বোধনের জন্য সার্বিকভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। এর পরই সেপ্টেম্বরের আগে প্রকল্পটি উদ্বোধন উপযোগী করে তুলতে দ্রুত কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন এ প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এছাড়া সেপ্টেম্বরে উদ্বোধনের তালিকায় রয়েছে আখাউড়া-লাকসাম ডুয়াল গেজ ডাবল লাইন ও আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ চালু। 

আইন অনুযায়ী, বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে সেপ্টেম্বরের শেষার্ধ কিংবা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে। বড় বড় প্রকল্প উদ্বোধনের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিজ দলের উন্নয়ন দক্ষতার পরিচয় দিতে চায় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

রেলওয়ে-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের শেষ মাস সামনে রেখে একাধিক রেলওয়ে প্রকল্প উদ্বোধনের চিন্তা করা হচ্ছে। সড়ক, নৌ, বিমান, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্বাস্থ্য কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে রেলপথ খাতের উন্নয়ন সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয়। রেলপথের প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ ও উদ্বোধন মানেই নতুন ট্রেন সার্ভিস চালু। এ কারণে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই পুরনো প্রকল্পও চলতি সরকারের মেয়াদেই শেষ করা হবে। এতে কিছু প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ করতে না পারলেও সেপ্টেম্বরেই উদ্বোধন করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আবার যেসব প্রকল্পের কাজ সেপ্টেম্বরের কয়েক মাস আগে শেষ হয়ে যাবে সেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে সেপ্টেম্বরে উদ্বোধনের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।

জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গেলেও উদ্বোধন কখন করা হবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে আখাউড়া-আগরতলা ক্রসবর্ডার রেল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু জাফর মিঞা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আখাউড়া-আগরতলা রেল প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও কিছু কাজ বাকি থাকবে। তবে জুলাইয়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ করা হবে। কাজ শেষ হওয়ার পর কখন উদ্বোধন হবে সেটি সরকারের ঊর্ধ্বতন বিভাগের বিষয়।’

বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক হারুনুর রশীদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘টানেলের মূল কাজ শেষ হয়েছে। তবে নিরাপত্তা ইস্যুর কারণে উদ্বোধনের বিষয়টি কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে। আমাদের কাজ নির্মাণকাজ শেষ করে বুঝিয়ে দেয়া। এরপর কখন উদ্বোধন হবে সে বিষয়টি ঠিক করবে সরকার। তবে নিরাপত্তা স্ক্যানার বসানো হয়ে গেছে। টানেল যানবাহন চলাচল কিংবা উদ্বোধনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তত।’

চট্টগ্রামের লালখানবাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ চলমান। ২০১৭ সালে কাজ শুরু হওয়া মেগা প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে। ২০২২ সালের শেষার্ধে প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুনে শেষ করার কথা রয়েছে। শুরুতে খরচ ছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। বর্ধিত সময়ের জন্য প্রকল্পের খরচ আরো ১ হাজার ৪৮ কোটি বাড়িয়ে মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৪ হাজার ৩৬৯ কোটি ৭ লাখ ১০ হাজার ৮১৯ টাকা।

এর আগে বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পতেঙ্গা থেকে নিমতলা বিশ্বরোড পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার কথা ছিল। ফেব্রুয়ারিতে আংশিক উদ্বোধন বাদ দিয়ে এখন সেপ্টেম্বরে সম্পূর্ণ এক্সপ্রেসওয়েটিই উদ্বোধনের পরিকল্পনা করছে সিডিএ। আগামী সেপ্টেম্বরে একাধিক উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনের মিছিলে এটাকেও রাখতে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে নির্দেশনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিডিএ কর্মকর্তারা। অন্যদিকে চট্টগ্রামের বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডের অসমাপ্ত কাজ চলতি বছরের জুনে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে আগামী সেপ্টেম্বরে। ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সংযোগ সড়কটির নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে ৩৫৩ কোটি টাকায় উন্নীত করেছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। 

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষমতার থাকার পর শেষ সময়ে এসে উন্নয়নের চিত্র জনগণের কাছে তুলে ধরে জনপ্রিয়তা বাড়াতে চাইবে। আর জনগণকে উন্নয়ন দেখাতে অবকাঠামো খাতই সবচেয়ে দৃশ্যমান ও সহজ। এটা অন্যায্য কিংবা অন্যায় কিছু নয়। যে কারণে শেষ সময়ে এসে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনের মাধ্যমে সরকার আগামী নির্বাচনের ভিত তৈরি করছে। তবে কাজ শেষ হয়ে গেলেও একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উদ্বোধনের জন্য ফেলে রাখা কিংবা তড়িঘড়ি করে শতভাগ শেষ না হওয়া প্রকল্প উদ্বোধনের চেষ্টা গ্রহণযোগ্য নয়।’ 

সেপ্টেম্বরেই একাধিক রেলওয়ে-সংশ্লিষ্ট প্রকল্প উদ্বোধন সরকারের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের কৌশল কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বিষয়টি নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন