অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগের সুযোগে অর্থনীতি স্বাবলম্বী হবে

আলমগীর শামসুল আলামিন , রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেট

মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার অন্যতম বাসস্থান তথা আবাসন। সরকারের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আমরা নাগরিকদের বাসস্থানের সমস্যা সমাধানের কাজ করে যাচ্ছি। একই সঙ্গে অর্থনীতিতে আমরা অবদান রাখছি নিরলসভাবে। মহামারী করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এক বছরের বেশি সময় ধরে শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরি করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় নেতৃত্বে ২০২০-২১ অর্থবছরে বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগের সুযোগে আমরা মহামারী করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম। এনবিআরের হিসাবমতে, অর্থনীতির মূল স্রোতে এসেছে ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ওপরে। যেখান থেকে সরকার ট্যাক্স পেয়েছে হাজার কোটি টাকার ওপরে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে শতাংশ কর দিয়ে যে কেউ বিদেশ থেকে তাদের অর্থ ফিরিয়ে আনতে পারবেন, এমন একটা সুযোগ রাখা হয়েছে। গণমাধ্যমে বিষয়ে যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে সিদ্ধান্ত ফলপ্রসূ হয়নি। নাগরিকরা সুযোগ খুব একটা গ্রহণ করেনি।

আমরা বারবার বলে এসেছি দেশের টাকা দেশে থাকুক। বাইরে না যাক, দেশে বিনিয়োগ হোক। তাতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং অর্থনীতি সাবলম্বী হবে। বর্তমানে অর্থনীতি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের মতো বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগের সুযোগ দিলে অর্থনীতিতে বিশাল পরিমাণ অর্থ মূল স্রোতে প্রবেশ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আমরা আবাসন খাতে অর্থ বিনিয়োগের আহ্বান জানাই। আমরা দীর্ঘদিন ধরে সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থা প্রচলনের দাবি জানিয়ে আসছি, কিন্তু সেটা কার্যকর হচ্ছে না। এটা চালু হলে একদিকে যেমন শিল্প এগিয়ে যাবে, অন্যদিকে সরকারও তার রাজস্ব আয় বাড়াতে সক্ষম হবে। পুরনো ফ্ল্যাট একবার রেজিস্ট্রেশনের পর পুনরায় যখন বিক্রি হবে, তখন যদি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে সর্বমোট দশমিক শতাংশ কর নির্ধারণ করা হয়, তবে বিপুল পরিমাণ ফ্ল্যাট হাতবদল হবে। বর্তমানে নির্মাণসামগ্রীর উচ্চমূল্যের কারণে ফ্ল্যাটের দামও বাড়ছে। ফলে অনেক নাগরিকের পক্ষে নতুন ফ্ল্যাট ক্রয় করা সম্ভব নয়। তারা ঝুঁকেছে পুরনো ফ্ল্যাটের দিকে, কিন্তু সেখানে উচ্চমূল্যেও রেজিস্ট্রেশনের ব্যয়ের কারণে তারা হতাশ হচ্ছেন। আমরা সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থা প্রচলনের জন্য জোর দাবি জানাই। আমরা নিবন্ধন ব্যয় কমানোসহ আরো বেশকিছু দাবির কথাও জানিয়েছি। আশা করি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আমাদের দাবির প্রতি সদয় হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সরকারের রাজস্ব দরকার সেটাও আমরা জানি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বাস্তবতা বিবেচনা করে আবাসন খাতকে গতিশীল রাখার জোর দাবি জানাই। কারণ আবাসন খাত গতিশীল থাকলে গতিশীল থাকবে চার শতাধিক লিংকেজ শিল্প।

সাধারণ মানুষের জন্য আবাসন জোগান দেয়া গণতান্ত্রিক সরকারের রাজনৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু ক্রমবর্ধমান মানুষের আবাসন চাহিদা সীমিত সম্পদের কারণে সরকারের একার পক্ষে আবাসন সমস্যার সমাধান সম্ভবপর নয়, বিধায় বেসরকারি উদ্যোক্তারা এগিয়ে এসেছে। অমিত সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের গৃহায়ন শিল্পের বেসরকারি উদ্যোক্তারা দুই যুগের বেশি সময় ধরে এদেশের আবাসন সমস্যার সমাধানে সরকারের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের একমাত্র শীর্ষ সংগঠন রিহ্যাব-এর সদস্যরা প্রতি বছর প্রায় ১৫-১৭ হাজার ফ্ল্যাট সরবরাহ করছে। যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই প্রবাসে বসবাসকারী ক্রেতারা। বাংলাদেশের গৃহায়ন শিল্প প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। ফলে একদিকে যেমন দেশের আবাসন শিল্পের বিকাশ ঘটছে, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে।

এছাড়া সরকারের রাজস্ব আয়, কর্মসংস্থান, লিংকেজ শিল্প প্রসারের মাধ্যমে সমগ্র নির্মাণ খাত জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বাংলাদেশের আবাসন শিল্প শুধু আবাসনই সরবরাহ করছে না, একই সঙ্গে ৪০ লাখ মানুষের অন্নের জোগান দিচ্ছে, সৃষ্টি করছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা, যা প্রকারান্তরে দেশের উন্নয়নে শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের আবাসন খাতে কখনই শ্রমিক অসন্তোষ দেখা যায়নি। আবাসন শিল্পের কয়েকটি অবদান উল্লেখ করতে বললে আমরা বলবজাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। বাসস্থান সরবরাহের মাধ্যমে দেশের আবাসন সমস্যার সমাধান করছে। কর্মসংস্থানসহ উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে। লিংকেজ শিল্প বিকাশে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখছে। পরিবেশ সমৃদ্ধ ঝুঁকিমুক্ত অবকাঠামো বিনির্মাণ হচ্ছে। সরকারের রাজস্ব উপার্জন বাড়ছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশীদারত্ব পালন করছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের আবাসন শিল্প নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন। বিগত সময়ে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, আকাশচুম্বী জমির মূল্য জমির অপ্রতুলতা, দেশের অভ্যন্তরে নতুন গ্যাস সংযোগ প্রাপ্তিতে সাময়িক স্থগিত থাকা এবং নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে খাতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল। শেয়ারবাজারের ধসের কারণেও খাতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। রিহ্যাব আয়োজিত আবাসন খাতের সবচেয়ে বড় আয়োজন রিহ্যাব উইন্টার ফেয়ারএরপর দেশের আবাসন খাত কিছুটা নাজুক অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে দেশের আবাসন খাত মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পতিত হয়েছে। এছাড়া ফেয়ারে বিপুলসংখ্যক ক্রেতা গৃহায়ন শিল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রদর্শন করলেও খাতে পর্যাপ্ত আর্থিক কোনো প্রবাহ না থাকায় সফল হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অবস্থায় সরকারের আর পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সংকটের উত্তরণ অসম্ভব। সমগ্র গৃহায়ন খাতের বিক্রয় পরিমাণ প্রায় ৬০ শতাংশ কমেছে। একই সঙ্গে উদ্যোক্তাদের নতুন প্রকল্প গ্রহণের হার ৭৫ শতাংশ কমেছে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে খাতে প্রচণ্ড পরিমাণ তারল্য সংকটসহ মূলধন ব্যয় জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। মুহূর্তে যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তবে দেশের গৃহায়ন শিল্পের মারাত্মক অপূরণীয় ক্ষতি হবে। প্রকারান্তরে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। অবস্থা থেকে সার্বিক উত্তরণের লক্ষ্যে আসন্ন জাতীয় বাজেট ২০২৩-২৪ দেশের গৃহায়ন শিল্প রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন