কংগ্রেস এখন জিএসপির সম্ভাব্য পুনঃঅনুমোদন নিয়ে আলোচনা করছে

ছবি: মার্কিন দূতাবাস ঢাকা

মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাণিজ্যবিষয়ক প্রতিনিধির দপ্তরের (ইউএসটিআর) দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ভারপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ব্রেন্ডন লিঞ্চ। ২০ মে থেকে চারদিনের এক সফর শেষে গতকালই ঢাকা ত্যাগ করেছেন তিনি। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, শ্রম অধিকার পরিস্থিতি, মেধাস্বত্বসহ নানা বিষয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বদরুল আলম

২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম চুক্তির (টিকফা) আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার অগ্রগতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

বাণিজ্য বাধা কমিয়ে আনা ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের উপায় খুঁজে বের করার একটি কার্যকর প্রক্রিয়া হলো টিকফা। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ওয়াশিংটনে টিকফা কাউন্সিলের ষষ্ঠ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে, এমন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কৃষিপণ্যের বাজারে প্রবেশাধিকারসহ আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল শ্রম অধিকার, বাণিজ্যের কারিগরি বাধা, ডিজিটাল বাণিজ্য নীতি, মেধাসম্পদ সুরক্ষা ও প্রয়োগ এবং বিনিয়োগ পরিবেশে প্রভাব ফেলে এমন নীতি। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ উভয়ই শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্কের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছে। এ কারণে ২০২১ সালে পণ্য বাণিজ্য ১০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। আমরা তখন সম্মত হয়েছিলাম যে টেকসই ও কারিগরি কার্যক্রমের মাধ্যমে ভবিষ্যতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ানোর জন্য টিকফার ব্যবহার আমরা অব্যাহত রাখব।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (জিএসপি) সুবিধা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা বিষয়ে আপনার অনুমান কী?

আপনারা জানেন, শ্রম অধিকার লঙ্ঘন, ত্রুটিপূর্ণ শ্রমিক অধিকার ও অনিরাপদ কাজের পরিবেশের কারণে ২০১৩ সালে জিএসপিতে প্রবেশাধিকার হারায় বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কর্মীদের অধিকার, বিশেষ করে সংগঠনের স্বাধীনতা এবং সম্মিলিত দরকষাকষির অধিকারকে এগিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।

জিএসপি প্রোগ্রামের মেয়াদ ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। এটি আবার কার্যকর করতে হলে মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন। আবার জিএসপির অনুমোদন দেয়া হলে এতে পুনঃপ্রবেশের জন্য বাংলাদেশকে দেখাতে হবে যে তারা জিএসপিতে কংগ্রেসের যোগ করা নতুনগুলো যোগ্যতার সব শর্ত পূরণ করছে। বিষয়টি একটি ব্যাপক আন্তঃপ্রতিষ্ঠান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পর্যালোচনা করা হবে এবং বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় যোগ্যতার মানদণ্ড পূরণ করছে কিনা তা নির্ধারণ করবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কংগ্রেস এখন জিএসপির সম্ভাব্য পুনঃঅনুমোদন নিয়ে আলোচনা করছে।

তাজরীন ও রানা প্লাজার ঘটনা বিবেচনায় বাংলাদেশের শিল্প খাতে কর্মপরিবেশ উন্নয়ন বিষয়ে আপনার মতামত কী?

আন্তর্জাতিক শ্রমমান মেনে চলার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা স্বীকার করি যে রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশ গত ১০ বছরে রফতানিমুখী পোশাক কারখানায় অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তায় অনেক উন্নতির পাশাপাশি কর্মী ব্যবস্থাপনা নিরাপত্তা কমিটি গঠন ও প্রশিক্ষণে অগ্রগতি অর্জন করেছে।

বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পোশাক রফতানিকারক দেশ। কিন্তু এ কারণে অনেক প্রত্যাশা ও বাধ্যবাধকতাও চলে এসেছে। এর মধ্যে ভালো মানের পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি রয়েছে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকারী ও মর্যাদাপূর্ণ নিরাপদ কাজের পরিবেশও। পরিদর্শনকৃত সব কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকির পূর্ণ প্রতিকার নিশ্চিত করাসহ এখনো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কাজ শেষ করা প্রয়োজন।

শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য আরো কাজ করা দরকার, যাতে তারা প্রতিক্রিয়ার ভয় ছাড়াই ইউনিয়ন গঠন করতে পারে এবং সম্মিলিতভাবে দরকষাকষি করতে পারে। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে শুধু পোশাক খাতে নয়, সমগ্র অর্থনীতিতে শ্রমিক অধিকারের অগ্রগতিতে সফল দেখতে চায়। এর অর্থ হলো শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার এবং ভালো মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের জন্য সম্মিলিতভাবে দরকষাকষির অধিকার নিশ্চিত করা, বিশেষ করে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে।

আমরা বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের জায়গাগুলো সম্পর্কে আরো জানতে চাই।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক অধিকার নিয়ে অগ্রগতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। টিকফার পাশাপাশি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে শ্রম অ্যাটাশের নেতৃত্বে উভয় দেশ একটি ইউএস-বাংলাদেশ লেবার ওয়ার্কিং গ্রুপ চালু করেছে, যেটি অগ্রাধিকারমূলক শ্রম সমস্যা সমাধানের জন্য নিবিড়ভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশে একজন লেবার অ্যাটাশে মোতায়েনের মধ্য দিয়েই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে মার্কিন সরকার শ্রমের ক্ষেত্রে এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত বাণিজ্যে অগ্রগতি দেখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আমরা শ্রম আইন সংস্কার, ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন, শ্রম পরিদর্শনের প্রায়োগিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ইউনিয়নবিরোধী বৈষম্য এবং অন্যায্য শ্রম অনুশীলনের কাজগুলোকে মোকাবেলা করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার রোডম্যাপের অগ্রগতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। বাংলাদেশে আমরা বিশেষ করে শ্রম আইনের অগ্রগতি দেখতে চাই এবং আশা করি আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনতে আইনের সংশোধনীগুলো শিগগিরই চূড়ান্ত হবে।

অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলো মার্কিন তুলায় উৎপাদিত পোশাক যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ দাবি করে আসছে। এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা আছে কি?

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের অগ্রাধিকারমূলক সুযোগ প্রদানকারী বিভিন্ন কার্যক্রমকে অনুমোদন দেয়ার দায়িত্ব মার্কিন কংগ্রেসের। এ মুহূর্তে আমরা জানি না, মার্কিন কংগ্রেস বাংলাদেশকে বিশেষভাবে কোনো অগ্রাধিকারমূলক সুযোগ কার্যক্রমের আওতায় আনার কথা বিবেচনা করছে কিনা।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানিতে বিদ্যমান জটিলতা নিরসনে কী করা উচিত? তুলা পরিশোধনসংক্রান্ত সর্বশেষ নীতি কী?

আমি জানাতে পেরে আনন্দিত যে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের পর বাংলাদেশ মার্কিন তুলার ক্ষেত্রে ফিউমিগেশনের প্রয়োজনীয়তা দূর করেছে। এ নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ উভয়েরই উপকার হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তুলা আমদানিকারক। বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় বৃহত্তম আরএমজি শিল্পও এখানে অবস্থিত। মার্কিন তুলার ফিউমিগেশনের বাধ্যবাধকতা অপসারণ হলে অপ্রয়োজনীয় খরচ দূর হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশী তৈরি পোশাক শিল্প সেক্টরের উল্লেখযোগ্য সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আমাদের দুই দেশ কীভাবে সমৃদ্ধি বাড়াতে এবং বাণিজ্য বাধা দূর করতে সহযোগিতা করতে পারে তার একটি বড় উদাহরণ এটি।

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাড়াতে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ বিষয়ে আপনার সুপারিশ কী?

আরো বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য বাংলাদেশ বেশকিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোথায় বিনিয়োগ করতে হবে তা নির্ধারণ করার সময় যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা স্বচ্ছ ও অনুমানযোগ্য নীতিনির্ধারণমূলক পরিবেশের প্রত্যাশা করেন। আরো দক্ষ ও সুরক্ষিত অধিকারসংবলিত কর্মী বাহিনী এবং একটি স্বচ্ছ নীতিনির্ধারণী পরিবেশ তৈরি করলে আরো অনেক কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে। 

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগে মেধাস্বত্ব ও এ-সংক্রান্ত প্রভাব বিষয়ে কোনো উদ্বেগ আছে কি?

বিনিয়োগের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশের সুবিধার্থে মেধাভিত্তিক সম্পদের অধিকার তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ককে মূল্য দেয়, এ দেশে মেধাসম্পদের অধিকার এবং বিনিয়োগের ওপর এর প্রভাব নিয়ে আমাদের উদ্বেগ রয়েছে। আমরা গঠনমূলক আলোচনা এবং উদ্ভাবন, সৃজনশীলতা ও বিনিয়োগের সুরক্ষাদাতা একটি শক্তিশালী কাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমে এ উদ্বেগের সমাধান করতে পারি।

বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ মূলত জ্বালানি খাতকেন্দ্রিক। বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগকে বহুমুখী করতে কী করা উচিত?

বাংলাদেশের জ্বালানি খাতকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন করার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, বিশেষ করে নতুন ধরনের জ্বালানি, যার মধ্যে রয়েছে নবায়নযোগ্য ও টেকসই জ্বালানি। পাশাপাশি রয়েছে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, যা জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় সহায়তা করবে। আমরা অন্যান্য আন্তর্জাতিক বাজারে যা শুনি এবং দেখি তার ভিত্তিতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য বাংলাদেশের একটি স্বচ্ছ ও অনুমানযোগ্য নীতিনির্ধারণী পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশী বেসরকারি খাতে কী ধরনের ব্যবসায়িক চর্চা আশা করে যা যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হতে পারে?

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশী বেসরকারি খাতকে টেকসই ও সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ অনুশীলনসহ শক্তিশালী করপোরেট গভর্ন্যান্স ও দায়িত্বশীল ব্যবসায়িক আচরণে উৎসাহিত করে। কারণ বিষয়গুলো বিনিয়োগকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। স্বচ্ছতা, মেধাসম্পদের অধিকার রক্ষা, বিনিয়োগকারীদের প্রতি ন্যায্য ও বৈষম্যহীন আচরণকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে সরকারি নীতিমালাও হয়ে উঠতে পারে বিনিয়োগ আকর্ষণের মূল চাবিকাঠি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন