যে সলিলে কাটছি সাঁতার

সালভাদর দালি

সালভাদর দালি ছবি: ফিলিপ হালসম্যান, উইকি আর্ট

পরাবাস্তববাদীরা ঠিক শিল্পী নন, বিজ্ঞানীও নন। সামান্য মনোযোগ দিলে যে কেউ বিষয়টা ঠাহর করতে পারবে। তারা বরং স্টার্জন মাছ থেকে পাওয়া ক্যাভিয়ার। খাদ্যটিতে একদিকে যেমন আভিজাত্য মিশে রয়েছে, অন্যদিকে রয়েছে স্বাদ। হাল আমলে যুক্তিকে অতিক্রম করে যুক্তিহীনতায় জড়িয়ে থাকা অনেকাংশেই তার সঙ্গে তুলনীয়। ক্যাভিয়ার কেবল স্টার্জনের অভিজ্ঞতা নয়, পরাবাস্তববাদীদের অভিজ্ঞতাও। আমরা পরাবাস্তববাদীরা স্টার্জনের মতো মাংসাশী। দুই ধরনের পানিতে সাঁতার কেটে বেড়াই, শিল্পের শীতল আর বিজ্ঞানের উত্তপ্ত পানি। খানিকটা তাপমাত্রার কারণে আর খানিকটা স্রোতের বিপরীতে সাঁতারের প্রবণতা থেকে। ফলে চিত্রকলার দিক দিয়ে পরাবাস্তববাদী হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা ও আবিষ্কার বেশ জটিল। যদিও একটা বিষয় নিশ্চিত, ‌আমি সব ধরনের সহজিয়া প্রবণতাকে ঘৃণা করি।        

সত্যটা পরিষ্কার। শত্রু, বন্ধু ও সাধারণ মানুষ আমার আঁকা ছবির অর্থ অনুধাবন করতে পারে না। বুঝতে পারে না লুকিয়ে রাখা তাৎপর্য। পারবেই- বা কেমন করে? আমি নিজেই তো আমার চিত্রকর্মের অর্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু আঁকার সময় অর্থ না বোঝার মানে এটা নয় যে, আদতে তার কোনো অর্থ নেই। বরং সত্যটা ঠিক বিপরীত। অর্থাৎ চিত্রকর্মের অর্থ এতটাই গভীর, জটিল, ভারসাম্যপূর্ণ ও অনিচ্ছাকৃত যে সেখানে যৌক্তিক চিন্তার সাধারণ বিশ্লেষণ ব্যর্থ হয়ে পড়ে। আমার চিত্রকর্মগুলোকে স্থানিক অবস্থানে রেখে ব্যাখ্যার জন্য বিশেষভাবে ভাবতে হবে। সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য রূপে বৈজ্ঞানিক সঠিকতা ও নৈর্ব্যক্তিকতা অর্জন করা জরুরি। তবে সব ধরনের বিশ্লেষণই মূলত পরতসিদ্ধ, যেখানে চিত্রকর্মটিই শুধু ঘটমান বিষয়বস্তু। চিত্রকর্ম নিয়ে আমার একমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা নির্ভুল আবেগের মাধ্যমে মূর্ত হয়ে ওঠা যুক্তিহীন ছবিটিকে বাস্তবে রূপদান করা। কল্পনার দুনিয়া ও যুক্তিহীনতার দুনিয়া নৈর্ব্যক্তিকভাবে স্পষ্ট ও স্থির, টেকসই ও আশ্বস্ত করার মতো। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ তার সহজ যোগাযোগ। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষ যুক্তিহীন সে দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়। সে অনুভূতি নিহিত থাকে চিত্রকর্মে প্রকাশিত অর্থ ও বিষয়ের গভীরে। আত্মানুসন্ধানী ও অপ্রতিরোধ্য শিল্পের সৃষ্ট মায়াবাদ, কায়দাপূর্ণ উপস্থাপন ও বিশ্লেষণধর্মী বর্ণনাও মহিমান্বিত হয়ে উঠতে পারে তখন। অবশ্য যুক্তিহীনতার মধ্য দিয়ে তাকে যথাযথভাবে হাজির করতে হবে, যেন বাহ্য বাস্তবতাকে প্রকাশ করে। দিয়েগো ভেলাস্কিজ ও ইউহান্না ভারমিয়ারের মুন্সিয়ানা এক্ষেত্রে যথার্থ উদাহরণ। তারা যুক্তিহীন চিন্তা ও অজ্ঞাত কল্পনার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন দৃশ্যমান বাস্তবতাকে।

মুহূর্তের স্থিরচিত্র ও রঙকে হাতে সুসংহত করা সহজ নয়। চিত্রকর্মে মূর্ত হয়ে ওঠা সে যুক্তিহীনতা দুর্দান্ত, বেহিসেবি, অনাবিষ্কৃত, ক্ষীণ। যেন সব ধরনের ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। যেন তাকে সরলীকরণ করা যাবে না কোনো ধরনের স্বজ্ঞা কিংবা বৌদ্ধিক পদ্ধতি দ্বারা। মূর্ত যুক্তিহীনতার মধ্য দিয়ে নির্মিত ছবিগুলো যথাযথভাবেই অজ্ঞাত। পরাবাস্তবতার প্রথম আমলে এমন একটা যুক্তিহীনতাই হাজির করতে চেয়েছেন চিত্রবোদ্ধারা। পরাবাস্তব বিষয়বস্তুকে করে তুলেছেন পরোক্ষ ও সুগ্রাহী। যুক্তিহীনতার পদ্ধতিগত অভিযাত্রায় বিবর্তিত হয়ে সামনে এনেছেন নতুন কোনো পরাবাস্তব ধারা। অবচেতন মনের কার্যকলাপ, স্বপ্ন ও স্বপ্নের মতো পরাবাস্তব বিষয়বস্তুর সঙ্গে বিভিন্ন প্রতীক, সহজাত প্রবৃত্তি, ঘুম ও জাগরণের মধ্যবর্তী অবস্থাগুলো অবিবর্ধনশীল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংগঠিত হয়েছে। তার পরও অঙ্কিত ছবিতে দুই ধরনের মুশকিল থাকে। প্রথমত, আঁকার পর তারা আর অপরিচিত ছবি থাকে না। কারণ মনঃসমীক্ষার আঙিনায় নেমে আসার পর তাদের খুব সহজেই বিদ্যমান যৌক্তিক বাক্যাবলিতে সরলীকরণ করা যায়। তখন একটা ধাঁধার জন্ম নেয়, যা খুব কম মানুষেরই দৃষ্টি এড়াতে পারে। দ্বিতীয়ত, চিত্রকর্মের অপার্থিব ও কাল্পনিক চরিত্র আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণতা দেয় না। এমনকি ব্র্যঁতোর ‌ভেরিফিকেশন তত্ত্ব দিয়েও কোনো রকম সীমারেখা নির্ণয় করা অসম্ভব হয়। পরাবাস্তব চিত্রকর্ম যেন শত সম্ভাবনার দিকে ঝুঁকে থাকে। ঝুঁকে থাকে বিষয়গত ও ভৌত অস্তিত্বের দিকে। যারা তাত্ত্বিক বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন, এমন মানুষ চিত্রকর্মে হাজির থাকা ‌কাব্যিক পলায়ন-কে ভুল বুঝতে পারেন। তারা বিশ্বাস করে বসতে পারেন আমাদের বিস্ময়কর অতীন্দ্রিয়বাদ ও নান্দনিকতার প্রতি অন্ধবিশ্বাসকে। ফলে আমি আমার জায়গা থেকে মনে করি, পরীক্ষামূলক যাত্রার ইতি ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হবে আমাদের অগম্য, অবোধ্য আত্মীকরণ ও অভ্যন্তরীণ ক্ষত। যদিও বর্তমান যুগ পরিচিত হতে থাকবে দীর্ঘ সময়ে সৃষ্টি হওয়া নানা ধরনের পরাবাস্তব চিত্রকর্মের সঙ্গে। মূর্ত যুক্তিহীনতার মধ্য দিয়ে নতুন করে সৃষ্ট ছবি ঝুঁকবে বাস্তব ও কায়িক সম্ভাব্যতার দিকে। তারা অতিক্রম করে যাবে মনঃসমীক্ষণের দুনিয়া। ছাড়িয়ে যাবে অপার্থিবকে হাজির করার প্রবণতাকে।

পরাবাস্তব চিত্রকর্ম উপস্থাপন করে বিবর্ধনশীল ও উৎপাদনমুখী চরিত্র। পল এলুয়ার ও ব্র্যঁতো চেষ্টা করেছেন অনুকৃত শিল্প তৈরির। ব্র্যঁতোর সাম্প্রতিক কার্যক্রম কবিতাকে ঘিরে, রেনে ম্যাগ্রিটের সর্বশেষ নোঙর ছবিতে, পিকাসোর সর্বশেষ আশ্রয় ভাস্কর্য আর সালভাদর দালির তাত্ত্বিক ও চিত্রণের কার্যক্রম একটা সত্যকে উন্মোচন করে। সত্যটি হলো বর্তমান বাস্তবতাকে মূর্তায়নের প্রয়োজনীয়তা। নৈতিক ও পদ্ধতিগত উপায়ে নৈর্ব্যক্তিক ও যৌক্তিক অভিজ্ঞতার অচেনা দুনিয়াকে সবার সম্মুখে হাজির করা। বিপরীতে স্বপ্নের স্মৃতি, অপার্থিব ও অসম্ভব ছবিগুলো নিখাদ সুগ্রাহী অবস্থায় রয়েছে, যা শুধু বর্ণনাই করা যেতে পারে। বিষয়বস্তুর জন্য এটা যেন শরীরী হাজিরা। এমন যুক্তিহীনতার মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেকে আঘাত করে বারবার। ১৯২৯ সালের দিকে আমি মনোযোগ নিবদ্ধ করেছিলাম প্যারানয়েডের ওপর।  এটা এমন এক ক্ষমতার ভিত্তিতে পরীক্ষামূলক পদ্ধতির সম্ভাব্যতা যাচাই, যা প্রভাবিত করে পদ্ধতিগত সম্মিলনকে। পরবর্তী সময়ে এটিই পরিণত হয় সাময়িক উন্মাদনার সংশ্লেষণে। নাম পায় ‌প্যারানয়েড-ক্রিটিক্যাল অ্যাক্টিভিটি। কোনো কিছু ব্যাখ্যা করার সঙ্গে জড়িত পদ্ধতিগত কাঠামো। প্যারানয়েড-ক্রিটিক্যাল-অ্যাক্টিভিটি হলো যুক্তিহীন জ্ঞানের স্বতঃস্ফূর্ত পদ্ধতি, যাকে দ্বিধাগ্রস্ত ঘটনায় নির্ভর করে ব্যাখ্যা করা হয়। সক্রিয় ও পদ্ধতিগত উপাদান এখানে অপরিচিত। ফলে চিন্তার ক্ষেত্রে পূর্বধারণা তৈরি হয় না। কোনো ধরনের বুদ্ধিবৃদ্ধিক হস্তক্ষেপও নেই। শিল্পের এমন কাঠামো দ্বিধাগ্রস্ত ঘটনাবলিকেই নির্দেশ করে, আর যেকোনো দ্বিধাগ্রস্ত ঘটনাই কোনো না কোনো দিক থেকে প্যারানয়েডের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এমনকি যেটা খুব তাৎক্ষণিক ও অল্প সময়ের জন্য ঘটে, সেটিও। পদ্ধতিগত কাঠামো সেখানে উপস্থাপিত হয় কেবল। তাত্ত্বিক চিন্তাগুলো কাজ করে চিত্রকর্মের রঙকে বের করে আনার পথ হিসেবে। তার সঙ্গে মিলে তৈরি হয় ভারসম্য। প্যারানয়েডে বিশ্লেষণী কার্যক্রম নৈর্ব্যক্তিক আলোয় প্রত্যাবর্তনের অনুমোদন দেয়। ফলে এটি একটি নৈর্ব্যক্তিক সুযোগের জন্য সংগঠিত ও উৎপাদনমুখী শক্তি। সেখানে পরাবাস্তব ছবি ও ঘটনাগুলো পৃথক হিসেবে বিবেচিত হয় না। বরং পরস্পর-সম্পর্কিত একটি পদ্ধতিগত ও গুরুত্বপূর্ণ ভারসাম্যকে নির্দেশ করে। পরোক্ষ, পক্ষপাতহীনতা, নান্দনিকতা ও যুক্তিহীন ঘটনাবলির বিপরীতে সক্রিয়, পদ্ধতিগত ও সুসংহত হওয়াকে বিবেচনা করা হয় গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে।

পরাবাস্তব চিত্রকর্মের পদ্ধতিগত ব্যাখ্যা অনেক ক্ষেত্রেই বিচ্ছিন্ন ও আত্মনিমগ্নতায় পূর্ণ। প্রাত্যহিক জীবনের পরাবাস্তব ঘটনাগুলোর মধ্যে স্বপ্নদোষ, বিকৃত স্মৃতি, স্বপ্ন, দিবাস্বপ্ন, তন্দ্রা, কাঁপুনি, ঘুমহীনতা, দৃষ্টিভ্রম, মুহূর্তের ভুল, মানসিক বিকার প্রভৃতি প্রধান। আরো হাজারো বিষয় আছে, যা যুক্তিহীন দুনিয়ার প্রতিনিধিত্ব করে। রাজনৈতিক সমস্যা, স্থবির ছবি কিংবা স্বভাব সেখানে তৈরি করে ঝুঁকিপ্রবণ চিন্তাধারা। সে প্রবণতায় চিন্তার শরীরায়ন অস্তিত্বশীল। দার্শনিক হেরাক্লিটাস যখন কাঁদতেন, তখন এটাই বুঝিয়েছেন। গ্রিকরা এভাবেই বুঝেছিল তাদের মনস্তাত্ত্বিক দেবতাদের। ফলে তারা একটা দুর্বোধ্য ও বিপর্যয়ী আবেগকে স্পষ্ট বিশ্লেষণী শারীরবিদ্যায় রূপান্তর করতে পেরেছেন। বর্তমানে পদার্থবিদ্যা হলো চিন্তার নতুন জ্যামিতি। গ্রিকদের জন্য স্থান ছিল দূরত্বমাত্র। বর্তমানে স্থান হয়ে গেছে অবিশ্বাস্য, ব্যক্তিগত ও পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। গ্রিকরা তাদের ইউক্লিডীয় মনস্তত্ত্ব ও অনুভূতিকে ফুটিয়ে তুলেছেন ভাস্কর্যে। হাল আমলে আইনস্টাইন দাঁড় করিয়েছেন সময় ও স্থান নিয়ে আলোচনা। সালভাদর দালির সৃষ্টিকর্ম সে সময় ও স্থানকেই ব্যবহার করা হয়েছে। আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি শিল্পের অগ্রযাত্রায় যেকোনো অঘটন ঘটে যাওয়ার আগেই। পাঠকদের সম্মান জানাই এমন তাত্ত্বিক আলোচনায় আগ্রহ দেখানোর জন্য। যে তাত্ত্বিকতায় যে কেউ বন্য ও নরখেকো হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতে পারে। সুপ্ত রয়েছে তীক্ষ্ণ রক্তক্ষয় ও যুক্তিহীনতা, যা গ্রাস করে নেবে আমাদের সবাইকে।

‌কনভারসেশনস উইথ দালি থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর

আহমেদ দীন রুমি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন