স্বপ্নতাড়িত দালি

রুহিনা ফেরদৌস

দালির আঁকা দ্য পারসিস্টেন্স অব মেমোরি

দালি স্বপ্নতাড়িত ছিলেন, নাকি স্বপ্নকে তাড়া করে ফিরতেন কে জানে। ক্ষ্যাপাটে ছিলেন, সৃষ্টিশীলও। যেন খানিকটা আলাদা আদরে গড়া। চিত্রশিল্প, চলচ্চিত্র, ভাস্কর্য, গ্রাফিক ডিজাইন, কবিতা—সালভাদর দালি দখল নিয়েছেন সৃষ্টিশীল এতসব মাধ্যমে। তার তুলি ও কালিতে শিল্পচর্চার ইতিহাস সমৃদ্ধ হয় সুররিয়ালিজমের স্বপ্ন-জাগরণের জগৎ ঘিরে। 

স্বঘোষিত অতিআত্মম্মন্য দালি সুররিয়ালিজমের মন্ত্রণা পেয়েছিলেন সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্বের আলোকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর প্যারিসে বইছে নতুন উমেদ-আকাঙ্ক্ষার সুবাতাস। তাল মিলিয়ে সেরে উঠছে অর্থনৈতিক ক্ষত। ফরাসি কবি ও লেখক অঁদ্রে ব্র্যঁতোর হাত ধরে বিকশিত হচ্ছে সুররিয়ালিজমের মন্ত্রণা। 

১৯২০-এর দশক। বেশ কয়েকবার প্যারিসে আসেন দালি। যেখানে তার সাক্ষাৎ ঘটে পাবলো পিকাসোর সঙ্গে। দেখা পান স্বদেশী স্প্যানিশ চিত্রকর জোয়ান মিরো, ফরাসি কবি পল এলুয়ার্ড আর বেলজিয়ান শিল্পী রেনে ম্যাগ্রিটের। যারা দালিকে সুররিয়ালিজমের ঘোরগ্রস্ত জগতে প্রবেশ সূত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ওই সময় দালির নিজেরও কুড়ির কোঠায় পা। ‘লে অ্যানি ফল’-এর উৎকর্ষে প্যারিস পরিচিত হয়ে উঠছে শিল্প-সংগীত-চলচ্চিত্রের সমৃদ্ধ রাজধানী হিসেবে। দালি নিজেও নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন ইম্প্রেশনিজম, ফিউচারিজম আর কিউবিজমের ছন্দ-শৈলী-অভিব্যক্তি নিয়ে। আত্মজীবনী ‘দ্য সিক্রেট লাইফ অব সালভাদর দালি’ গ্রন্থে যে সময়ের সৌখিন বর্ণনা রয়েছে।

দালির বয়স যখন মাত্র ১৭, তখন তার মা মারা যান। পরের বছর মায়েরই বোনকে বিয়ে করেন তার বাবা। জীবনজুড়ে মায়ের জন্য অব্যক্ত এক আকুলতা বহন করে বেড়িয়েছেন, যা দালির শুরুর দিককার কাজ ‘দি এনিগমা অব ডিজায়ার, মাই মাদার, মাই মাদার, মাই মাদার’ (১৯২৯)-এ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার এ চিত্রকর্মগুলো যেন ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানের কাছে ঋণী।

১৯৩৬ সালে ‘লবস্টার টেলিফোন’ দিয়ে দালি ভিজ্যুয়াল আর্টের সুররিয়াল ধারণার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। দুটো ঠিক বিপরীত বস্তুর অপ্রত্যাশিত সংমিশ্রণ বা মিলন। তার মনে হয়েছিল এমন অসামঞ্জস্য দুটো বস্তুর মধ্যে যোগসূত্র তৈরির মাধ্যমে তিনি মানুষের গোপন বাসনাকে তুলে ধরেছেন। লবস্টার টেলিফোন রীতিমতো সুররিয়ালিস্ট আর্টের এক ধ্রুপদি উদাহরণ হয়ে ওঠে। 

১৯১৬ সালে বহুজাতিক পানীয় কোম্পানি কোকা-কোলা তাদের বোতলের নকশা করে অভিনেত্রী মে ওয়েস্টের দেহ গড়নের আদলে। লবস্টার টেলিফোনের পর তিরিশের দশকে অভিনেত্রী মে ওয়েস্টের ঠোঁটের আদলে দালি ডিজাইন করেন সোফার মতো দীর্ঘ আসনবিশেষ। ব্রিটিশ সুররিয়াল কবি এডওয়ার্ড জেমসের সঙ্গে সুররিয়াল বাড়ির অন্দরসজ্জার পরিকল্পনার সুবাদে ডিজাইন করেন ‘দ্য মে ওয়েস্ট লিপস সোফা’ (১৯৩৭), যা বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিখ্যাত আসবাবের মধ্যে একটি। এ অভিনেত্রীকে নিয়ে আরো একটি উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে তার ‘মে ওয়েস্ট ফেস’ নামে। 

দালি চিরকাল তার কার্যকৃতি দিয়ে আলোচিত। ১৯৩৯ সালে তিনি যখন ‘দি এনিগমা অব হিটলার’ আঁকেন, তা দেখে বন্ধুরা বিরক্ত হয়েছিলেন। শোনা যায়, হিটলারের প্রতি তার আবেগপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সুররিয়ালিস্ট দলের অন্যান্য সহকর্মীর সঙ্গে দালির সম্পর্ক ছিন্নে অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করে। 

অঁদ্রে ব্র্যঁতো তার সম্পর্কে বলেছিলেন, দালির জনপ্রিয় বিনোদনের অনুষঙ্গ হয়ে সুররিয়ালিজম আবেদন হারাচ্ছে। এটি সত্য যে দালির কাজের চাহিদা তৈরি হয়েছিল তখন থেকেই। ১৯৩৪ সালে মার্কিন মুলুকে গিয়ে দালি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ ডিজাইন করেন, অংশ নেন ‘হোয়াটস মাই লাইন’ নামের টিভি শোয়, সুগন্ধি ও লিপস্টিকের বিজ্ঞাপনও তৈরি করেন। 

চলচ্চিত্রকার আলফ্রেড হিচকক দালিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তার ‘স্পেলবাউন্ড’ ছবির স্বপ্নদৃশ্য তৈরির জন্য। দালির দেখানো ছবির সে দৃশ্যটি ছিল অবদমিত আকাঙ্ক্ষার মনস্তাত্ত্বিক ভিজ্যুয়াল ভাণ্ডার। যেমন চলচ্চিত্রকার লুই বুনুয়েলের সঙ্গে জুটি বেঁধে নির্মিত দালির ‘অ্যান আন্দালুসিয়ান ডগ’-এর গল্পের পটভূমি স্বপ্নের মতো এক একটি ক্রমানুসারে এগিয়ে যায়।

সহধর্মিণী এলেনা ইভানোভনা ডায়াকোনোভা, যিনি পরিচিত গালা নামে, দালির সাফল্যের নেপথ্যে অন্যতম সহযোগী ছিলেন। এ শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে ব্যবসায়ী-সংগ্রাহকদের সঙ্গে আলোচনা চালানো, তার লেখা সম্পাদনার মতো কাজগুলো দেখতেন গালা। শোনা যায়, দালির নিয়তি জানতে গালা ব্যবহার করতেন ট্যারো কার্ড। গালা হয়তো জেনে গিয়েছিলেন পরবর্তী সময়ে অ্যান্ডি ওরহলের পপ আর্ট, মেক্সিকোর ম্যুরালিস্ট মার্কস রায়া, ব্রিটিশ শিল্পী সারা লুকাস কিংবা চলচ্চিত্রকার ডেভিড লিঞ্চের কাজের মাধ্যমে দালির দর্শন আরো গতি পাবে।

সমসাময়িক শিল্পকে ঘিরে গড়ে ওঠা সেলিব্রিটি কালচার দালির রসবোধ ও প্রশ্রয়ের কাছে ঋণী। অঁদ্রে ব্র্যঁতো অবশ্য শিল্পের সঙ্গে বিনোদনের অঙ্গীভুক্তকরণ ঘিরে খানিকটা উদ্বিগ্ন ছিলেন। তবে সুররিয়ালিজমের ঐক্ষিক উপস্থাপনকে আকার দিয়েছেন দালি। ফরাসি কবি ও লেখক বন্ধু অ্যালোন বুসস্কের সঙ্গে দালির দীর্ঘ আলাপচারিতায় উঠে আসে এ শিল্পীর চিত্রকর্ম, চিন্তা, দর্শন, দিনযাপন, চলচ্চিত্র, আন্দোলন, বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে অনেক কিছু। অ্যালোন দালিকে যখন পেইন্টিং নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, দালির উত্তর ছিল অনেকটা এমন, আমার কাছে পেইন্টিং সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি আমার সামগ্রিক প্রতিভাকে মূল্য দিই। সবাই যেমনটা জানে, আমি নিজেকে কখনো অলংকার, কখনো ফুলশয্যা, কখনো ভীষণ কামনাতাড়িত কিংবা কখনো মরমিবাদী হিসেবে প্রকাশ করি। পেইন্টিং আমার অসীম প্রতিভার একটি অংশ। 

দালি মানে উল্টে যাওয়া লম্বা গোঁফ। দালি মানে পোষ্য বিড়াল ব্যাবু। দালি মানে রহস্য, পাগলামি আর প্রতিভায় মোড়া মানুষ। দালি মনে করতেন, তার গোঁফ তাকে লোকচক্ষু থেকে আড়াল করে রাখে। আত্মবিশ্বাসী দালি নিজেকে ‘জিনিয়াস’ বলতেন। ১৯১০ সালে তার বয়স যখন ছয়, আঁকলেন ‘ল্যান্ডস্কেপ নিয়ার ফিগারাস’। নয় বছর বয়সে আঁকেন ‘ভিলাবারট্রান’, যা তার সেরা চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে একটি। পরবর্তী সময়ে ‘দ্য পারসিস্ট্যান্স অব মেমোরি’, ‘দ্য গ্রেট মাস্টারবেটর’ তাকে সুররিয়ালিজমের অনন্য শিল্পী হিসেবে শিল্পবোদ্ধাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘দ্য বাস্কেট অব বেড, দ্য ফেস অব ওয়ার, টুনা ফিশিং, মেটামরফোসিস অব নার্সিসাস, দ্য বার্নিং জিরাফ, মর্ফোলজিক্যাল ইকো, স্টিল লাইফ মুভিং ফাস্টের মতো অসংখ্য বিখ্যাত চিত্রকর্ম দিয়ে দালি তার স্বপ্নকেই তাড়া করেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন