গ্যালারি

নিজেকে দেখার কালে

ওয়াহিদ সুজন

‘‌করোনায় আত্মসন্ধান’ থেকে ছবি: কলাকেন্দ্র

একাকিত্ব অসহনীয় হতে পারে। আবার মানুষকে ‘‌নতুন’ চেনাতে পারে। যাকে বলে নিজেকে খুঁজে ফেরা বা সৌল সার্চিং। এই ‘‌খোঁজ’ অভিজ্ঞতা ও পরিপার্শ্বকে নতুনভাবে চেনাতে পারে। আত্মার নতুন খবর বা ইশারা দিতে পারে। অর্থ ও সম্ভাবনা বা নিরর্থকতা। একাকিত্বে আমরা ভেঙে পড়ি বা ঘুরে দাঁড়াই। করোনা, যা আমাদের একাকিত্বে বাধ্য করেছে। দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অনেক প্রশ্নের সামনে। নিজের সামনে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক বিপন্নতার মানুষ একা আবার যূথবদ্ধ। 

একজন শিল্পী হয়তো এ পরিস্থিতিকে আরো গুছিয়ে তুলে ধরতে পারেন। অন্যের অনুভূতির ভাষাও দিতে পারেন। ওয়াকিলুর রহমানের ‘করোনায় আত্মসন্ধান’ শিরোনামের স্থাপনা প্রদর্শনী এই একাত্মতার, ভাষাময়তার। যেখানে বস্তুরাজি কথা বলছে। কলাকেন্দ্রে সম্প্রতি শেষ হওয়া এই আয়োজনের কিউরেটর ছিলেন শার্মিলি রহমান। 

‘সারাদিন কাটিয়ে, ফেরার জায়গা, ঘর কিংবা আবাস আমার সবসময় ছিল। তবে এ জায়গাগুলােতে সারাদিন/রাত কবে একনাগাড়ে কাটিয়েছি—জানি না। অনেক দিন কাটাতে হবে জেনে, বুঝে এক নতুন সময় কাটাচ্ছি—নিজের সঙ্গে নিজের এমন শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক সঙ্গ কবে পেয়েছিলাম? তাছাড়া নিজের এই আবাসের পরিচয়, উচ্চতা, আকার, দেয়াল, দরজা, জানালা, বারান্দা, আলো, ছায়া, বাতাসে কবে দেখেছিলাম?’ এসব কথা ওয়াকিলুর রহমানের। তার কথার অর্থ হতে পারে; এই দেখাদেখি স্রেফ মানুষ আকারে নিজের মন বা আত্মার তালাশ নয়। বরং পরিপার্শ্বকে নিজের থেকে আলাদা না দেখার বাসনা রয়েছে। হ্যাঁ, নিছক সেলফ বা ইগো তো আমরা কাউকে দেখাতে পারি না! 

২০২০ সালের ২২ মার্চ থেকে ২৩ মে পর্যন্ত ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে শিল্পকর্ম নিয়ে হাজির ছিলেন ওয়াকিলুর। যেখানে ফর্ম ও ম্যাটার নিয়ে খেলেছেন তিনি। এর বছর তিনেক পর হাজির হলেন কলাকেন্দ্রের চার কিংবা পাঁচ কক্ষের গ্যালারিতে। ছোট ছোট কক্ষ, কিন্তু গল্পের সঙ্গে গল্পে তারা জড়িয়েছে। যেমনভাবে প্রতিটি গ্যালারিতে মশারি দিয়ে একটা জাল বুনেছেন শিল্পী। আর অবশ্যই মশারি এ দূষিত নগরে একটা রক্ষাকবচ।

লকডাউনকালে চাবি, মোবাইল চার্জার, সাবান, বাজারের ব্যাগ, জগ-গ্লাস, অগোছালো জামাকাপড়, আসবাবসহ রোজকার নজর না দেয়া জিনিসগুলো ওয়াকিলুরের সামনে নতুন রূপে হাজির হয়েছে। আরো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে তুচ্ছ জিনিসগুলো দেখার সুযোগ পেয়েছেন যিনি। এ বিশ্বের একান্ত বোঝাপড়ায় আমরা কখনো কখনো ভাবি, অণুগুলো মূলত বস্তুগুলোর প্রতিবিম্ব। এখানে প্রতিটি বস্তু সম্পর্ক, ভাবনা বা যাপন সূত্র নিয়ে হাজির। তারা কখনো এক রূপে হাজির থাকে না। বরং জ্ঞেয় ও জ্ঞাতার সম্পর্ক দিয়ে ধরা পড়ে। ওয়াকিলুর বস্তুর সেই সত্তাকে আমাদের সামনে তুলে ধরেন। যারা করোনার আগে ও পরে আলাদা হয়ে ধরা দিয়েছেন, যা মূলত ওয়াকিলুরের দেখার পরিপ্রেক্ষিত বদল। 

প্রতিটি স্থির বস্তুর মাঝে গতির যে আভাস আছে, করোনা তা যেন হিমায়িত করে রাখে। ছবিতে আলো-ছায়ার আসা-যাওয়া বা প্রদর্শনীতে ঠাঁই কাপ-পিরিচ বা শপিং ব্যাগ; সব সম্ভাবনাকে রহিত করে করোনার অনিশ্চিত পরিস্থিতি তুলে ধরে। এমন এক অবস্থায় আমরা কোথায় চালিত হই; তার চাপ রয়ে গেছে গ্যালারিজুড়ে। যেখানে সঙ্গোপনে দর্শকের মনে হাজির হয় নিজ অভিজ্ঞতা ও অভিঘাত।

স্থিরতা ও গতি নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কাজ ছিল ‘করোনায় আত্মসন্ধান’-এ। পুরো অন্ধকারে ঘরের মাঝে পড়ে আছে কয়েকটি খোলা-বন্ধ সুটকেস। তার ওপর প্রজেক্টরের মাধ্যমে পিছলে যাচ্ছে একের পর এক নদীর নাম। সুরেলা সব নাম। নদী মানে গতি ও প্রবহমানতা, যা সময়ের ধর্মও বটে। করোনার স্থবিরতার সঙ্গে বিপ্রতীপ এ মুহূর্তগুলো স্মৃতির সঙ্গে ভবিষ্যতের সম্পর্ক একসূত্রে গাঁথে। আবার আমরা ভ্রমণে যাব। আবার দেখা হবে প্রিয়জনের সঙ্গে। বৃক্ষ বা পাখির সঙ্গে। আর এই যাওয়া করোনার আগে ও পরের হিসাবে একদম আলাদাই হওয়ার কথা। না কি?

গ্যালারিতে সাজানোর ক্ষেত্রে মৌলিক কাঠামোর একটা বিন্যাস দেখা যায়। বাঁকা কাঠামোগুলো বা উল্টোভাবে থাকা চেয়ার আমাদের সরলরৈখিক দেখার জগৎকে বদল দিয়ে আলোর চলার ধরনে ফেরত নিচ্ছে। আবার অগোছালো জামাকাপড় পরিপাটিভাবে দেখার যে চল তার সঙ্গে বাইরের জীবনের সঙ্গে যে বিপরীত স্বভাব তা তুলে ধরে। প্রকৃতিতে আমাদের মাঝে মাঝে অগোছালো মনে হয়, কিন্তু সাজাতে গিয়ে ঘটে যাবতীয় বরবাদ। আছে খোলা বই। বই কি সেই মানুষটা, যে আত্মসন্ধানের জন্য নিজেকে নিজের সামনে তুলে ধরেছে। 

করোনা সারা বিশ্বে প্রভাব রেখেছে। এর অভিঘাত ঢাকায় অনুষ্ঠিত একাধিক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আয়োজনে আমরা দেখেছি। যার সর্বশেষটা বোধহয় ওয়াকিলুরের এই প্রদর্শনী। যতদূর মনে পড়ে বাকি কাজগুলো ছিল যৌথ। সেদিকে ওয়াকিলুরের অন্বেষণকে ভিড় থেকে আলাদা করা যায়। শ্রেণীকরণের সরলতা থেকে ব্যক্তির জটিল জগতে আমন্ত্রণ জানায় এ প্রদর্শনী।

একা ব্যক্তিকে দেখতে গিয়ে এ সময়ের বড় সত্যটিও ধরা দেয়। ডিজিটাল জগৎ কি মানুষকে নিঃসঙ্গ হতে দেয়। নাকি এক ধরনের ছদ্ম নিঃসঙ্গতা যাপনের মধ্য দিয়ে সামাজিকতার ভেতর বেঁচে থাকি। যা আবার সমাজ ধারণার একটা এক্সটেনশন মাত্র, সমাজ নয়। যেখানে আত্মসন্ধান একার থাকে না হয়তো; কখনো কখনো। তখন এমন পরিপ্রেক্ষিতগুলো একপাশে সরিয়ে হয়তো আরো নিবিড়ভাবে নিজেকে খুঁজতে হয়, যা অপ্রকাশ্য ও অদৃশ্য। মানুষের পক্ষে কি তা সম্ভব? অন্তত নাগরিক প্রচার সম্ভারের ভেতর একটু কঠিনতর। তাকেও বোধহয় প্রশ্ন করে ‘করোনায় আত্মসন্ধান’।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন