ক্যানভাসে রবির হৃদয়

ওয়াহিদ সুজন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা আত্মপ্রতিকৃতি — ছবি: টালেঞ্জ স্টোর

পশ্চিমা নিলাম সংস্থার ডাকে আজকাল কোটি কোটি টাকায় বিকোচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা চিত্রকর্ম। দেশের অনেক সৌখিন সংগ্রাহকের গ্যালারিতে আছে কবিগুরুর ছবি। বাঙালির কাছে এসব আঁকাআঁকির মূল্য স্বভাবতই আলাদা। চিত্রকর্ম হিসেবে মূল্যায়ন বা টাকায় এ মূল্য শনাক্ত হওয়ার নয়। তবে আন্তর্জাতিক নিলাম সংস্থার ডাক নোবেলজয়ীর ইমেজ ও বস্তুগত মূল্যের একটা ধারণা দিচ্ছে। এই ফাঁকে বলে রাখি, আমরা যদি রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ের খোঁজ করি, অবচেতনের কাছে যেতে চাই; তখন হয়তো চিত্রকর্ম সাহায্য করতে পারে, যার মূল্য একদম আলাদা।

প্রায় এক দশক আগে যখন শিলাইদহ কুঠিবাড়ি ভ্রমণে যাই, তখন আরো অনেক কিছুর মতো বিশ্বকবির আঁকা ছবি সম্পর্কে জানতে পারি। বিশেষ করে চামচের মতো অপ্রচলিত মাধ্যমে ছবি আঁকার চেষ্টা ও কালো রঙের সঙ্গে তার সখ্য ভাবিয়েছিল। যদিও ভেবেছি ‘আলোয় ভুবন ভরা’। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি আত্মপ্রতিকৃতি ও নারীর মুখ। আছে ‘অদ্ভুত’ নামের অচিন প্রাণীর ছবি। কালি ও কলম, তেলরঙ ছিল এসব ছবির মাধ্যম। আরো কিছু চিত্রকর্ম পরবর্তী সময়ে নওগাঁর পতিসর কাছারিবাড়িতে দেখতে পায়। যতদূর মনে পড়ে, সেখানেও ছিল নারীদের প্রতিকৃতি। সম্ভবত বাউলদের নিয়ে আঁকা ছবিও ছিল। 

দিগন্তজোড়া নদী, বিস্তৃত মাঠের নৈসর্গিক শিলাইদহে যারা যান, তারা রবীন্দ্রনাথকে কল্পনা করার সুযোগ পাবেন নানাভাবে। আমরা যে পথ ধরে হেঁটেছি, হয়তো কয়েক দশক আগে সেই পথে ঘোড়ায় চড়ে জমিদারি দেখতে গেছেন তিনি। কুঠিসংলগ্ন পুকুরে ভাসা বজরা অথবা কেউ যদি শিলাইদহ ঘাট থেকে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ওপারে যান, ‘জোসনা রাতে’ দৃশ্যটা কেমন হতে পারে সেই ভাবনা মাথায় আসতে পারে। আমরা যখন পদ্মা পাড়ি দিচ্ছিলাম, দিগন্তবিস্তৃত শূন্যতার ভেতর তন্ময় হয়ে ছিলাম। আমাদেরও মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ এই জলে ভেসেছিলেন। যদিও গ্রিক দার্শনিকের মতে, ‘একই স্রোতে দুবার ভাসা যায় না’। এটা সম্ভব নয় যে এসব দৃশ্য আমাদের আর রবির অনুভূতিকে একাকার করে দেবে। হ্যাঁ, ছবির বিষয়টা আরেকটু ঘনিষ্ঠ। কালের কঠিন পর্দা অতিক্রম করে সরাসরি কবির সঙ্গে, চিরন্তন আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ হতেও পারে। এসব চিত্রকর্মকে ‘সরল’ বলার যে চল আছে তাতে আশ্রয় করে বলা যায়, সরলতার চেয়ে উত্তম যোগাযোগ আর কী হতে পারে।

পুরোপুরি এমন নয় যে রবীন্দ্রনাথের তাবত খ্যাতি ও কীর্তির কারণে চিত্রকর্ম নিয়ে আলোচনা হয়। কিছুটা বটে হলেও তার আঁকাআঁকির স্বতন্ত্রতা নিয়ে অনেকদিন ধরে নানা বিশেষজ্ঞ মত চালু ছিল। লেখা হয়েছে ঢাউস আকারের বই। এমনকি প্যারিসের ব্যস্ত গ্যালারিতে অল্প সময়ে ব্যবস্থা করা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ক্যারিশমা শুধু নয়, রবীন্দ্রনাথের চিত্রগুণের নিশ্চয় কারণ রয়েছে। এখানে যে বিষয়টা বলতে চাই, রবীন্দ্রনাথের আর সব কীর্তি ছাপার হরফে আমরা দেখি। শুধু চিত্রটাই অবিকল সেইভাবে দেখি। তার কাটাকুটি ভরা খাতা; অন্যভাবে বললে শব্দ নিয়ে সংশয় বা দ্বিধার ভার আমরা দেখি না। অক্ষরের টানে মানসিক অভিঘাতের চিহ্ন আমরা দেখি না। কিন্তু চিত্রকর্মে সরাসরি তার হৃদয়ের দিকে তাকাতে পারি, যার প্রতিটি দাগ হৃদয় থেকে আসা। সাহিত্যকর্ম যতটা সচেতন সৃষ্টি হিসেবে আমরা দেখি চিত্রকর্ম আরো গভীরতম মনোজাগতিক অর্থ নিয়ে ধরা দেয়। সেই অর্থে ‘সত্য মাত্র সুন্দর’ এমন প্রচলিত কথার ভাঁজে চাপা পড়ে যাওয়া জীবনের বিষণ্ন সত্য ও ভীতিগুলো ছবিতে উঠে এসেছে। 

রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য চারপাশের বাস্তবতা ও তার সম্ভাবনা ঘিরে, যা আমরা সহজে কল্পনা করতে পারি। যা দেখেছেন তার বিশ্লেষণ, পুনর্নির্মাণ ও মূল্যায়ন করেছেন; সচরাচর লেখালেখি বিষয়টি এমনই হবে। কিন্তু চিত্রশিল্পে এর বদলে নতুন বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন হন, তা-ই তুলে ধরেন। কেন যেন মনে হয়, এখানে কাজ করেছে তার অল্টারইগো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকাআঁকির স্বভাব পুরোপুরি বিকশিত হয় জীবনের শেষবেলায়, বয়স যখন ৬৩ বছর। অর্থাৎ চিন্তার দিক থেকে তিনি শুধু পরিণতই নন, রীতিমতো ভাবাদর্শ আকারে প্রতিনিধিত্ব করছেন বাংলায়। খ্যাতি পেয়েছেন আন্তর্জাতিক স্তরেও। পেয়েছেন নোবেল। ঘোরাঘুরিও হয়েছে বিস্তর। আর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে এঁকে ফেলেন দুই হাজারের বেশি চিত্রকর্ম। 

তিনি যে পারিবারিক ঐতিহ্য ও বিশ্বসংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য অংশে নিজেকে যুক্ত করেছেন সেখানে চিত্রকলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রথম দিকে তার চিত্রকর্মকে স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে অনেক সমালোচকরা উল্লেখ করেছেন, প্রায় ‘প্রভাবরহিত’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন বড় একটা সময়জুড়ে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রভাবগুলো বিশদভাবে চিহ্নিত হয়েছে, তা সত্ত্বেও ভাবনা ও আঙ্গিকের দিক দিয়ে বিশিষ্ট হয়ে আছেন। 

রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবিতে আমরা যা দেখি; নর-নারীর মুখ, জীব-জন্তুর প্রতিকৃতি, প্রকৃতির পটভূমিকায় মানুষের রূপক চিত্র, আলংকারিক ও প্রাকৃতিক দৃশ্য। নিজেরসহ বহু পোর্ট্রেট এঁকেছেন। এসব ছবিতে বাংলার কোনো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ধরে পড়ে না। তার বদলে তার কল্পনায় আসা বিষয়াদি ‍উঠে আসে। এক চিঠিতে রানী চন্দকে বলেছিলেন, ‘আমি যখন ছবি আঁকতে শুরু করি তখন নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম। গাছ ও তার শাখা আর লতাপাতায় আমি নানা রকমের অদ্ভুত জীব-জন্তুর মূর্তি দেখতে শুরু করলাম। এসব আমি আগে কখনো দেখিনি।’ 

সব মিলিয়ে পাঠক যখন চিত্রকলার দর্শক হন, কিছুটা ধাঁধাঁ তো তৈরি হয়। লাবণ্য, বিনোদিনী, আশালতা বা সুচরিতাদের আমরা খুঁজে বেড়াই। যদিও তার নায়িকারা তত স্পষ্টভাবে ছবিতে ধরা দেন না। তবে সবচেয়ে বেশি যাকে খুঁজতে চাই, তিনি তো স্বনামেই আছেন; কাদম্বরী দেবী। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছবিতে সরাসরি নিজেকে হাজির করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেসব ছবিতে ভেতরের আমিকে নানাভাবে ভেঙেছেন। তবু কি সেই রবি ধরা পড়েছেন, যিনি লিখেছেন, ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তায় সকল খানে’।

ওয়াহিদ সুজন: সাংবাদিক ও লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন