দৃশ্যভাষ্যের চিত্রকর

জোহরা ঝুমু

রবীন্দ্রনাথের পেনস্কেচ — ছবি: ইন্টারনেট

বাংলা গল্প, কবিতা, উপন্যাস কিংবা নাটক—সবকিছুতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবাধ বিচরণ সবারই জানা। সে অর্থে শিল্পী রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি বহুল না হলেও শিল্পাঙ্গনে কিন্তু ব্যাপক সমাদৃত ও প্রশংসনীয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি আঁকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও শৈল্পিক পরিবেশ-পরিমণ্ডল তার নিত্যদিনের অনুষঙ্গেই ছিল। সাহিত্য অঙ্গনের সমস্ত প্রাপ্তি, সাফল্য ও স্বীকৃতি পাওয়ার পর যেন ফিরে তাকাতে চাইলেন নিজের ভেতর পানে। করতে চাইলেন নিজেকে স্বাধীন। তাই ছেলেমানুষি আঁকিবুঁকি দিয়েই শুরু করেছিলেন তার চিত্রকলার জগৎ। 

হঠাৎ দেখায় মনে হয় বার্ধক্যে উপনীত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিশুদের মতো আঁকিবুঁকিতে মেতে উঠেছেন। আপাতদৃষ্টিতে যা কিছু সহজ, আদতে ততটা খেলাচ্ছলে ছিল না মোটেও। প্রখ্যাত শিল্প তাত্ত্বিক ও শিল্প সমালোচক আনন্দ কে. কুমারস্বামী রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম নিয়ে বলেছেন, ‘childlike, not childish’. অর্থাৎ শিশুদের মতো নির্দ্বিধায় যেমন খুশি আঁকছে ঠিকই, কিন্তু শিশুদের মতো অনর্থক নয়। যার প্রমাণ মেলে তার কাজগুলোর দিকে সার্বিকভাবে চোখ ফেরালেই। প্রাতিষ্ঠানিক হাতেখড়ির জন্য রবীন্দ্রনাথের হয়তো বাস্তবধর্মী ছবি আঁকার দক্ষতা ছিল না; কিন্তু একটি ছবির শিল্পকর্ম হয়ে ওঠার অন্যান্য অনুষঙ্গ বেশ সচেতনভাবেই প্রকাশের প্রবণতা ছিল তার চিত্রকলায়। যেমন যথার্থ কম্পোজিশন বা বিন্যাসের দক্ষতা, শিল্পকর্মে গভীর ভাব ও বোধের উপস্থিতি, শিল্পবোধ ও শিল্পভাবনা এবং অভিব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ততা; যা দর্শকের কাছে নান্দনিক অভিজ্ঞতা নিয়ে হাজির হয়। 

শুরুতে কম্পোজিশনের কথাই ধরা যাক। কম্পোজিশন যেকোনো শিল্পকর্মের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আর এ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি মোটেও গুরুত্বহীন ছিল না রবীন্দ্রনাথের কাছে। নিছক ছেলেমানুষি আঁকাআঁকি হলে কম্পোজিশন তাঁর শিল্পকর্মে এতটা গুরুত্ব পেত না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় প্রতিটি চিত্রকর্মেই দেখা যায় আঁটসাঁট বিন্যাস। পুরোটা জুড়েই গড়নের যথাযথ প্রতিস্থাপন। নেগেটিভ স্পেসও যেন কাজেরই একটা অংশ। ব্যাপারটা অনেকটা ‘চোখ ভরে দেখা’র অনুভূতি দেয়। চিত্রকর্মে, ফর্মের বাইরের অংশকে সাধারণত নেগেটিভ স্পেস হিসেবে ধরা হয়। আর প্রতিটি চিত্রকর্মেই এ নেগেটিভ স্পেসকে সাবজেক্টের সঙ্গে সমার্থক করে ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার চিত্রকর্মের ক্ষেত্রে উতরে গেছেন যথেষ্ট মুন্সিয়ানার সঙ্গেই। 

নিজের শিল্পকর্মকে কোনোরূপ বাঁধাধরা নিয়ম কিংবা ঘরানায় ফেলতে চাননি তিনি। বরং উন্মুক্ত পাখির মতো জীবনসায়াহ্নে মুক্ত করতে চেয়েছেন নিজের অব্যক্ত সব অনুভূতিকে। এই চাওয়ার সর্বোচ্চ স্বাধীনতা তিনি উপভোগ করেছেন চিত্রকলায়, যা যেকোনো শিল্পীর জন্য পরম আরাধ্য। নিজের মতো আঁকা ছবির একটি উল্লেখযোগ্য দিক শিরোনামহীনতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অজস্র সাহিত্যকর্মের নাম নির্বাচন করেছেন নির্দ্বিধায়। এমনকি তারই হাত ধরে বাংলা সাহিত্য পেয়েছে অগুনতি নতুন শব্দ। এত শব্দের রচয়িতা হয়েও তিনি তার কোনো শিল্পকর্মের নামকরণ করেননি! এ শিরোনামহীনতা নিছক খেয়াল নয় কিন্তু! শিল্পী রবীন্দ্রনাথ তার চিত্রকর্মগুলোকে নামকরণের মাধ্যমে শব্দের বেড়াজালে আবদ্ধ করতে চাননি। এমনকি ফেলতেও চাননি নির্দিষ্ট চিন্তার সীমাবদ্ধতায়। উলটো চেয়েছেন দর্শকই ছবি দেখে তার নাম কিংবা অর্থ নিজের মতো করে নির্ধারণ করে নিক। ভাবা যায়? দর্শকের মাথায় ঢুকে ঘুরপাক খাওয়ার এ দুর্দান্ত ধারণা এসেছিল এমন এক চিত্রকরের হাত ধরে, যিনি আজও চিত্রশিল্পী হিসেবে সে অর্থে জনপ্রিয়তা লাভ করেননি। 

বিশেষ কোনো ধরনের পূর্বানুমান ছাড়াই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আঁকতে বসতেন। তারপর নিজেকে যেন পুরোপুরি সমর্পণ করে দিতেন কলমের স্বকীয়তার কাছে। তারই স্পষ্ট প্রমাণ যেন তার কাটাকুটি খেলায় মেতে ওঠা পেনস্কেচগুলো। এ স্কেচগুলোয় ডিরেকশনাল লাইনের ব্যবহার মুগ্ধকর। ভ্যান গঘের আঁকা ‘‌স্টারি নাইট’ চিত্রকর্মের আকাশ ও তারাগুলোর মতোই এ ডিরেকশনাল লাইনগুলোর ব্যবহার বেশ স্পষ্ট। এর প্রতিটি লাইনই আদতে তার কলমের স্ট্রোক! এ ডিরেকশনাল লাইনগুলো শুধু কন্ট্যুর ড্রয়িং হিসেবেই ব্যবহৃত হয়নি; বরং সেগুলোর ছোট-বড় ও হালকা-গাঢ় ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি ছবির ডাইমেনশন নির্মাণ করেছেন প্রতিনিয়ত।

 জীবনসায়াহ্নের শেষ ১৫ বছরের অধিকাংশ সময় তিনি কাটিয়েছেন ছবি এঁকে। অনেক দেরিতে আঁকা শুরু করলেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এঁকেছেন প্রায় ২ হাজার ৩০০ ছবি। এ ছবিগুলোকে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো এক. মুখাবয়ব বা পোর্ট্রেট, দুই. প্রাকৃতিক দৃশ্য বা ল্যান্ডস্কেপ ও তিন. অদ্ভুত প্রাণী। 

রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার সূত্রপাত হয় তার লেখার কাটাকুটির মাধ্যমে। প্রথমদিকের এ কাটাকুটিগুলোর নির্দিষ্ট কোনো আকার-আকৃতি ছিল না। পরবর্তী সময়ে এ কাটাকুটিগুলো চোখ-মুখের রেখা কিংবা অদ্ভুত প্রাণীর শরীর, পা, পাতার ইঙ্গিত দিতে শুরু করে। তারপর এল পূরবী পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি। এর শেষের কয়েক পাতা ভর্তি হলো আরো কাটাকুটিতে। আর আঁকলেন অদ্ভুত আকৃতি, প্রাণিজগতের কাল্পনিক জীব, এক প্রাণীর শরীরে অন্য প্রাণীর মাথা। সরাসরি বাস্তব প্রাণী নকল করছিলেন না দেখে সুবিধে হলো। ছবিগুলো দ্বিমাত্রিক বা ঘনত্ব বর্জিত হলেও কিয়োরিয়োস্কি বা ডিপ শেডিংয়ের বদৌলতে ভলিউমের আমেজ বহাল আছে সমানভাবে। এ ছবির প্রাণীদের উদ্ভট বলাটাও ঠিক যৌক্তিক ঠেকে না। বলা যায় অনেকটা সুকুমার রায়ের জগাখিচুড়ি প্রাণী। এক প্রাণীর অন্য প্রাণীর শরীর, কখনো মাথা বা পা নিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে নিজের মতো করেই। কোনো বিশেষ প্রাণী নয়, বরং ভাবখানা এমন যেন, প্রাণীত্বের ছবি আঁকাতেই তিনি মশগুল। এ প্রাণীদের ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে কিছুটা বায়োমর্ফিক আকারের ধাঁচ থাকলেও পুরোপুরি সে ছকে তিনি তার ছবিগুলোকে ফেলেননি। তাই বলা যায় পরাবাস্তববাদের প্রচ্ছন্ন প্রভাব থাকলেও সরাসরি সে ঘরানার অন্তর্ভুক্ত নয় চিত্রকর্মগুলো। 

রবীন্দ্র চিত্রকলার বিভাজন যা-ই হোক না কেন, তার সব ছবিতেই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ। তাই হুবহু না হলেও রবীন্দ্র চিত্রকলায় অভিব্যক্তিবাদের প্রভাব প্রকট। এ অভিব্যক্তিবাদের কথায় জার্মান অভিব্যক্তিবাদের উদাহরণই চলে আসে। জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের অন্যতম মূল বক্তব্য ছিল শিল্পীর অন্তর্হিত অনুভূতি, একান্ত ভাবনাকে ফুটিয়ে তোলা, ফর্মের ডিসটরশন ও চরিত্রের ইগজ্যাজারেশন এবং কিয়োরিয়োস্কি লাইটিং বা গভীর শেড। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২১-৩০ পর্যন্ত মোট তিনবার জার্মানি ভ্রমণ করেছেন। এ সময় জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের টগবগে সময় ছিল। ‘পূরবী’র রচনাকাল ১৯২৪-২৫ সাল; যেখান থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাটাকুটিগুলো ক্রমাগত ছবি হয়ে উঠছে। মূলত ১৯২৮ সাল থেকে পরবর্তী ১০-১২ বছরের আঁকা ছবিগুলোই বর্তমানে রবীন্দ্র চিত্রকলা হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। এ পর্যায়ে গুরুদেবের পোর্ট্রেটগুলোর দিকে চোখ ফেরানো যাক। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা মুখাবয়বগুলো বড় বেশিই ভাবলেশহীন মনে হয় প্রথম দেখায়। একটু ভালো করে তাকালে এ নির্নিমেষ চাহনির মধ্যে ফুটে ওঠে ভীষণ রকমের বিষণ্নতা। আয়নায় দাঁড়ালে মানুষ যেমন তার চর্মচক্ষু দিয়ে দেখে ভেতরের নিজেকে, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মের মুখাবয়বগুলোর দিকে তাকালে অনেকটা এমনই অনুভূতি হয়। মুখাবয়বগুলো যেন নিজেদের ভেতরকেই দেখছে। তাছাড়া তার কোনো পোর্ট্রেট সে অর্থে হুবহু অঙ্কিত হয়নি‌। কিছুটা ডিসটরশনের ছোঁয়া তার সব মুখাবয়বেই দেখা যায়। এ সবকিছুর মাধ্যমেই মুখগুলো যেন অকপটে প্রকাশ করছে একান্ত নিজের অনুভূতিকে। এই নিজের অনুভূতি মানে কিন্তু দর্শকের অনুভূতি। 

নিজের চিত্রকর্ম নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং বলেছেন, ‘people often ask me about the meaning of my pictures. I remain silent even as my pictures are. It is for them to express and not to explain.’ 

তার এ বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট যে তিনি চেয়েছিলেন তার শিল্পকর্ম নিজেরাই নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করবে স্বাধীনভাবে। তার ছবিগুলো তাই অনুকরণধর্মী ও বর্ণনামূলক নয়। বরং অনেক বেশিই ভাবাবেগ প্রকাশক, যা অভিব্যক্তিবাদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রায় সব ল্যান্ডস্কেচ এঁকেছেন শেষ বিকালের রোদের মায়ায়। গোধূলি আলোয় স্নান সেরে যেন পূতঃ হচ্ছে তার ছবির প্রকৃতিরা। সেখানে বিষণ্নতা নেই। আছে অবাধ অশেষ পবিত্র নিস্তব্ধতা। গভীর ও নিবিড়ভাবে তিনি প্রকৃতিকে অনুভব করতেন। আর অনুভবের সেই দেখাকেই তিনি এঁকেছেন অনবরত। প্রকৃতিকে আঁকার এ প্রক্রিয়াকে তিনি বলেছেন ‘a vast procession of form’ বা ‘ফর্মের দীর্ঘায়ত মিছিল’। 

 এ সময়ে অবশ্য শুধু জার্মান অভিব্যক্তিবাদই নয়, বরং আগে-পরে পুরো পৃথিবীর শিল্পাঙ্গন জুড়েই চলছিল নানা ইজমের উত্থান-পতন। এ দোলাচলের হাওয়া লেগেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকর্মেও। সে অর্থে নির্দিষ্ট কোনো ইজমে নাম না লেখালেও প্রকট ও প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল অনেক ঘরানারই। আর সব মিলেমিশে তার শিল্পকর্মগুলো হয়ে আছে কালোত্তীর্ণ। এমনকি নিজ পরিবারেই চলতে থাকা ‘নব্যবঙ্গীয় শিল্প আন্দোলনের’ জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণ ধারণাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তার শিল্পকর্মগুলো হয়ে ওঠে মানব অভিব্যক্তির অবারিত জানালা। তার লেখার মতো করেই বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথ নীরব থেকেই যেন আরো বেশি প্রকাশিত করে গেলেন তার শিল্পকর্মকে। 

জোহরা ঝুমু: লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন