তেল ও পাথরের লড়াই

আন্দালিব রাশদী

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ,মাইকেলেঞ্জেলো

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯) আসলে পুরু ব্রাশ আর তেলরঙের কারিগর আর মাইকেলেঞ্জেলো (১৪৭৫-১৫৬৪) হাতুড়ি-বাটাল আর পাথরের কারুকার। দা ভিঞ্চির ২৩ বছর পর তারই শহর ইতালির ফ্লোরেন্সে মাইকেলেঞ্জেলোর জন্ম। বয়সের হিসাবে তার তুলনায় খোকাই তো। দা ভিঞ্চি তখন খ্যাতির তুঙ্গে, মাইকেলেঞ্জেলো কেবল হাজির হয়েছেন খ্যাতির সর্পিল দরজায়। এমনিতেই এক প্রজন্ম পরের বালক, মেজাজে মর্জিতেও বিস্তর তফাত।

স্টেফানি স্টোরি অয়েল অ্যান্ড মার্বেল নামের একটি উপন্যাসে দা ভিঞ্চি ও তরুণ মাইকেলেঞ্জেলো দুজনকেই দাঁড় করিয়েছেন। দুজনই লালন করছেন বিদ্বেষ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা। দুজন যখন প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হলেন এমন একটি দৃশ্য উপন্যাস থেকে অনূদিত:

তিনি জীবনে যত কুৎসিত মানুষ দেখেছেন তাদের একজন তার সামনে দাঁড়িয়ে। আগন্তুক তরুণ মাথায় কালো চুল, কিন্তু ধুলোবালিতে মাখামাখি। নাকটা থেতলানো। সপ্তাহ ধরে ধোয়ামোছার ধারেকাছে নেই চাষাভূষাদের এমন পোশাক তার গায়ে, শরীরেও রক্তাক্ত আঁচড় ও থেত্লানোর দাগ দেখেই মনে হয় শুঁড়িখানার মারামারিতে কিছুক্ষণ আগে মার খেয়ে এসেছেন। ছেঁড়া চামড়ার একটা ব্যাগ হাতে আঁকড়ে আছেন, তাতে কাজের সব হাতিয়ার আর পকেটে একটি স্কেচবুক। তিনি একজন শিল্পী। 

লিওনার্দো অবাক হলেন, কিন্তু তার পোশাকের যে হাল তাতে সফল কেউ বলে মনে হয় না। এসব অনাহূত অতিথিরা তার আজকের সান্ধ্য পার্টিটার বারোটা বাজাতে চাচ্ছে নাকি?

লিওনার্দো বলে উঠলেন, ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ অনুগ্রহ করে অন্ধকার রাতের বেলায় জন্ম নেয়া একটি শিশুকে স্বাগত জানাবেন।

জনতা হেসে ওঠে। তরুণ লজ্জা পেলেন। মাথা নুইয়ে বুকের কাছে দুই হাত আড়াআড়ি করে সামনে এগিয়ে এলেন, নিজের সঙ্গে যেমন অন্যদের সঙ্গেও তার অস্বস্তি; তবু বললেন, ‘ওস্তাদ লিওনার্দো, আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়া সম্মানের ব্যাপার। আপনার সেবায় নিয়োজিত আমি একজন ভাস্কর। ভূমিধসের সময় বড় পাথর যেমন নেমে আসে তিনিও ঠিক সেভাবেই বলে গেলেন।

বাবা তুমি যে কী তা তোমার কথায়ই বোঝা যাচ্ছে। যারা পাথর কাটে তারাও এসব দাবি করে বসে। এখন বসো, স্কেচ করা শুরু করে দাও। ওস্তাদদের ছবি অনুসরণ ও অনুকরণ করতে থাকো।

লিওনার্দো তাকে আর পাত্তা না দিয়ে তার হাতের কাজে মন দিলেন। সন্ধ্যাটা কীভাবে যাজকদের কাছে উপস্থাপন করবেন তাই ভাবছেন। হয়তো একান্তে তার কাজ দেখার জন্য পরের দিন আসার আমন্ত্রণ জানাতে পারেন কিংবা রোববারের সার্ভিসে নিজেই যোগ দিতে পারেন। তার কাজ নিয়ে নোটারির বাধা ডিঙাতে তাকে কিছু একটা করতে হবে।

স্কেচবুক হাতে ভাস্কর তোত্লাতে তোত্লাতে তাকে বললেন, আমি কি আপনাকে আমার কিছু কাজ দেখাতে পারি? কাজের জন্য আপনার অনুমোদন পাওয়াটা আমার জন্য একটা বড় ব্যাপার হবে।

ভাস্কর তাকে এত বিরক্ত করছেন কেন। এ তো দেখছি আরেক ফ্লোরেন্টাইন দা ভিঞ্চির বন্ধুত্ব ও অনুমোদনের জন্য মরিয়া হয়ে আছে। এ কেমন রাত। যে করে হোক, ব্যাটা তুমি বিনা নিমন্ত্রণে আমার স্টুডিওতে এসেছো, আমার অতিথিদের কাছ থেকে আমাকে সরিয়ে রাখছ?

ভাস্কর হতভম্ব হলেন। তিনি এসব ঠাট্টা-মশকরা বুঝতে পারছেন না। সে সময় সুবেশ এক ব্যক্তি এগিয়ে এলেন। তিনি স্থানীয় শিল্পী, স্টাইলিস্ট এ ব্যক্তি লিওনার্দোর চেনা ফ্রান্সেসকো গ্রানাচ্চি। অভিভাবদন করে মাথা নুইয়ে তিনি বললেন, ‘ওস্তাদ এই আমার বন্ধু মাইকেলেঞ্জেলো বুনারোতি।’

‘বুনারোতি’ দা ভিঞ্চি বিড়বিড় করলেন, ‘আমি তোমার কথা শুনেছি।’ শিশুসুলভ প্রত্যাশায় ভাস্করের চক্ষু বিস্ফারিত হলো, ‘জি স্যার।’ তিনি বললেন, ‘বেটা তুমি কে আমাকে বললে না কেন? আমি তো মিলান পর্যন্ত সর্বত্র তোমার কথাই শুনেছি। দরবারের সবাই বলেছেন। এমনকি ডিউক এসফ্রোজাও বলেছেন।’

তরুন ভাস্কর লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন। তিনি থুতনি উঁচু করলেন। লিওনার্দো তার দৃষ্টির মানে বুঝতে পারলেন। এটা অহংকারের দৃষ্টি। অন্য মানুষের অহংকার দেখতে দেখতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘এই শিল্পী তার প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ এবং উজ্জ্বলতম বরফ-মানুষের ভাস্কর।’

বরফ-মানুষ শুনে অতিথিরা খিলখিল করে হেসে উঠলেন। ভাস্করের অভিব্যক্তি ম্লান হয়ে গেল। গ্রানাচ্চি হাত ধরে লিওনার্দোকে টানলেন, যেন আর বাড়াবাড়ি না করেন।

ভাস্কর বালক তখন কী করবেন? তাকে ঘুষি মারবেন? বেশ একটু এগোলেন। লিওনার্দোর সঙ্গে ভালো একটা লড়াই হতে পারে। ‘তরুণ বুকারোতি যে বরফ-মানুষ মেডিসির জন্য বানিয়েছিল নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। আমি দুর্ভাগ্যবশত সেখানে ছিলাম না। বালক, বরফ নিয়ে তোমার বিখ্যাত গল্পের কথা শুনিয়ে আমাদের আমোদিত করো। বরফ কি খুব ঠাণ্ডা ছিল?’ ভাস্করের মুখমণ্ডল ফ্যাকাসে সাদা হয়ে গেল। একবার তিনি বরফের ভাস্কর্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

‘স্নো আর্টের মতো এমন হাস্যকর অন্য কিছুর কথা শোনা যায় না, যেখানে শিল্পী তার শিল্পকর্মকে পরিত্যাগ করার আগে শিল্পকর্মই তাকে পরিত্যাগ করে।’

ভাস্কর বললেন, ‘এখন ভ্যাটিকানের প্রদর্শনীতে থাকা আমার আঁকা ‘পিয়েতা’র কথা শুনে থাকতে পারেন।’

তিনি কথাটি যেন ছুরির মতো লিওনার্দোর গলার দিকে নিক্ষেপ করলেন।

লিওনার্দো বললেন, ‘আরে সেটা তো মিলানের গোব্বোর আঁকা।’ লিওনার্দো শিল্পী সালাইর দিকে তাকিয়ে তার সম্মতির কথা শুনতে চাইলেন। সালাই মাথা নাড়লেন, ওস্তাদ ঠিকই বলেছেন। মাইকেলেঞ্জেলো এবার দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘না পিয়েতা আমার।’ ‘আমাকে বলুন আপনি পিয়েতা দেখেছেন কিনা?

লিওনার্দো কাঁধ উঁচিয়ে ভাস্করের দিকে ফিরে বললেন, ‘না শেষবার আমি যখন রোমে ছিলাম অযৌক্তিক ভাস্কর্য দেখার সময় আমার হয়নি।’

ভাস্কর চাপ দিলেন, ‘আপনি কী শুনেছেন বলুন।

‘তোমার মেরি প্রকৃতিতে প্রাপ্ত মেরির মতো নয়, আকারে জিসাসের তিন গুণ আর তারুণ্যে দ্বিগুণ।’

লিওনার্দো তরুণ ভাস্করকে ঠাট্টা করেই যাচ্ছেন, ‘তুমি কি জানো মায়েরা তাদের ছেলেদের চেয়ে আকারে ছোট এবং বয়সে বুড়ো হয়ে থাকে। আজকালকার স্কুলগুলো ছাত্রদের কী শেখায়?

তার কথায় জনতা হেসে ওঠে।

ভাস্কর বললেন, ‘একজন সতী নারী তার যৌবন ও সৌন্দর্য সবসময়ই ধরে রাখেন।’ লিওনার্দো কি তরুণের চোখের কোনায় অশ্রুবিন্দু লক্ষ করেছেন? তিনি তার দর্শকদের বললেন, চলো আমরা টিনকে স্বর্ণ বানাই। এটাই আলকেমির আবিষ্কার।

মাইকেলেঞ্জেলো থামার নন, বললেন, ‘দেহ হচ্ছে আত্মার প্রতিবিম্ব। একজন মানুষের নৈতিক শক্তি যত বেশি তিনি তত সুন্দর।’

লিওনার্দো বললেন, ‘আমি যে তোমার চেয়ে বেশি নৈতিক শক্তির অধিকারী সেটা প্রমাণ করার জন্য ধন্যবাদ।’

অতিথিরা হেসে উঠলেন।

লিওনার্দো ভাস্করের ঘাড়ে হাত দিয়ে বললেন, ‘শোনো বেটা একবার সমুদ্রের এক বিন্দু পানির বাতাসে উড়ে বেড়ানোর ইচ্ছে হয়েছিল। কাজেই আগুনের সাহায্যে বাষ্পীভূত হয়ে গেল। যখন আরো ওপরে উঠল, শীতল হলো এবং জমে গেল। তারপর বৃষ্টি হয়ে আকাশ থেকে পড়ল। তপ্ত মাটি এটাকে শুষে নিল এবং দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখল। এটা তার লোভ ও অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষার শাস্তি। তুমি সেই পানির ফোঁটার মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষার রোগে ভুগছো হে বালক। আমি তোমার পিয়েতা দেখিনি। কিন্তু তোমার দৃষ্টি তো দেখছি। তুমি এখনো ওস্তাদ হয়ে উঠতে পারোনি। কাজেই বসে পড়ো, আমার কাজ দেখে দেখে স্কেচ করো, হয়তো তুমি কিছু শিখতে পারবে।’

মাইকেলেঞ্জেলো বলে উঠলেন, ‘হারামজাদা বাস্টার্ড।’

উপস্থিত জনতা এটা শুনে বিচলিত হয়ে বিড়বিড় শুরু করল। লিওনার্দো নিশ্বাস নিলেন এবং তরুণের সঙ্গে সদাচরণের সিদ্ধান্ত নিলেন। বললেন, ‘বেটা তুমি ঠিক বলেছো। আমি সত্যিই বাস্টার্ড, এক অবৈধ পুত্র। কিন্তু আমি আমার এই অবৈধতার জন্য কৃতজ্ঞ ও ঋণী।’ তিনি ভাস্তরের বাদামি চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকলেন, ‘আমি যদি বৈধ দম্পতির বৈধ সন্তান হতাম, বৈধ পিতা থাকত তাহলে বৈধ ক্লাসরুমে বৈধ শিক্ষা গ্রহণের জন্য বৈধ মানুষের তৈরি করা বৈধ তথ্য মুখস্থ করতে হতো। তার বদলে আমি প্রকৃতি থেকে শিখতে বাধ্য হয়েছি। আমার চোখ, আমার ভাবনা, আমার অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বড় শিক্ষক। আমার জারজ হিসেবে জন্মগ্রহণ করাটা লজ্জার হতে পারে, কিন্তু তা কি আমাকে আহাম্মক বানিয়েছে?

(ঈষৎ সংক্ষিপ্ত অনুবাদ)

মাইকেলেঞ্জেলো যেমন দা ভিঞ্চির সহানুভূতি পাননি, দা ভিঞ্চিও পাননি মাইকেলেঞ্জেলোর স্বীকৃতি। তিনি দা ভিঞ্চিকে যাচ্ছেতাই বলে নাকচ করে দিয়েছেন। দুজনই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পী। দুজন দুই ধরনের।

পেইন্টিং হচ্ছে কবিতা, যা যতটা না অনুভব করা যায় তার চেয়ে বেশি দেখা যায় আর কবিতা হচ্ছে পেইন্টিং, যা দেখার বদলে অনুভব করা যায়। কথাটি লিওনার্দো দা ভিঞ্চির। দা ভিঞ্চি কবিতাও লিখতেন, তার পক্ষে এ অনুধাবন যথার্থ। তিনি তিন ধরনের মানুষ আবিষ্কার করেছেন: যারা দেখেন, দেখানো হলে যারা দেখেন এবং যারা দেখেন না। দা ভিঞ্চির একটি দার্শনিকী উপলব্ধি: আমি ভেবেছিলাম আমি বাঁচতে শিখেছি, আসলে আমি মরার শিক্ষা নিচ্ছিলাম।

রেনেসাঁ মানব বলতে যা বোঝানো হয় এর সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ দা ভিঞ্চি। ইতালির এ মনিষী একাধারে চিত্রশিল্পী, স্থপতি, ভাস্কর, সংগীতশিল্পী, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, গণিতবিদ, আবিষ্কারক, মানবদেহ বিজ্ঞানী, ভূতত্ত্ববিদ, মানচিত্র-বিশারদ, জীববিজ্ঞানী, কবি ও লেখক। 

লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মতো শিল্পী বলেছেন, ‘আমি ঈশ্বর ও মানবজাতির মনে কষ্ট দিয়েছি। কারণ আমার কাজের গুণগত মান যা হওয়া উচিত ছিল সে স্তরে পৌঁছেনি।’

ইতালির ভরা রেনেসাঁর প্রধান স্রষ্টাদের একজন মাইকেলেঞ্জেলো সেরা ভাস্কর, চিত্রশিল্পী ও কবি, জীবদ্দশায় দেশের সর্বশ্রেষ্ট শিল্পী। ইউরোপীয় শিল্পকলায় অন্যতম প্রধান প্রভাব তারই শিল্পকর্মের। তার প্রায় সব সৃষ্টিই মৌলিক। ডেভিড সম্পর্কে তিনি বলেছেন: আমার মনের মধ্যে ডেভিডের অবয়ব সৃষ্টি করি এবং পাথর কাটতে কাটতে যা কিছু ডেভিড নয় সবই ছেঁটে ফেলে দিই।

তারই কথা: আমি পাথরের ভেতর দেবদূতের দেখা পাই এবং তাকে পাথরের ভেতর থেকে মুক্ত না করা পর্যন্ত পাথর কাটতে থাকি। পেইন্টিং সম্পর্কে তিনি বলেন: ছবি হাত দিয়ে নয়, মগজ দিয়ে আঁকে; ভাস্কর্যে বাদ দিতে হয় আর পেইন্টিংয়ে যোগ করতে হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন