ল্যুভরে মোনালিসার সঙ্গে

রুহিনা ফেরদৌস

ল্যুভর মিউজিয়ামে মোনালিসার সামনে দর্শনাথীরা —ছবি: লেখক

রোম থেকে আল্পসের পথে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি যখন ফ্রান্সের উদ্দেশে যাত্রা করেন, তখন তার বয়স ৬৪। চলেছেন ঘোড়ায় টানা গাড়িতে। যাওয়ার আগে ঠিক করলেন, সঙ্গে নেবেন মোনালিসাকে। চিত্রকর্মটি রাখা হলো ঘোড়ার জিনের পেছন দিকে ঝোলানো ভারী থলিতে। লিওনার্দো চলেছেন ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের অনুরোধে। বড় অংকের পেনশন আর লোয়ারে অট্টালিকাসম বাড়ির প্রস্তাব দিয়ে রাজা তাকে রাজি করিয়েছেন।

গত বছরের মাঝামাঝি প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে পা রেখে প্রথম যে কথাটি মনে হয়েছিল, তা হচ্ছে শুরুটা করব মোনালিসা থেকে। ছবিটি আছে ল্যুভরের স্টেটস হলে। ম্যাপ দেখে দেখে হাঁটছি। গন্তব্যে পৌঁছতে লেভেল-১-এর ৭০৩ নম্বর কক্ষের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে থমকে গেলাম। দ্য উইংড ভিক্টোরি অব সামোথ্রেস। ল্যুভরের বিখ্যাত সিঁড়ি দ্য দারু স্টেয়ারকেসের চূড়ায় শোভা পাচ্ছে গ্রিক হেলেনিস্টিক শিল্পের এ মাস্টারপিস, যা দুর্লভ গ্রিক ভাস্কর্যের মধ্যে অন্যতম। ডানাওয়ালা মূর্তিটির মাথার অংশটির হদিস মেলেনি আর। দেবতাদের নৈবেদ্য হিসেবে নির্মিত বিজয়ের দেবী নাইকির প্রতিনিধিত্বকারী দ্য উইংড ভিক্টোরি অব সামোথ্রেসকে এজিয়ান সাগরের সামোথ্রেস দ্বীপ থেকে ১৮৬৩ সালে আবিষ্কার করেন প্রত্নতত্ত্ববিদ চার্লস চ্যাম্পেইসিউ। বিশাল ও মূর্ত এ ভাস্কর্যর সামনে দাঁড়িয়ে চোখে শুধু মুগ্ধতা ভর করে না, বুকের মধ্যে মুক্তির ঢেউ আছড়ে পড়ে। অসম্পূর্ণ হলেও ভাস্কর্যটি কী ভীষণ নিখুঁত ও নিপুণ। এমন চমৎকারভাবে দারু স্টেয়ারকেসের শীর্ষে এটিকে রাখার জন্য মনে মনে প্যারিসের শিল্পসমঝদারদের বাহবা দিয়ে মোনালিসার উদ্দেশ্যে পা বাড়াই। উনিশ শতকে স্থপতি হেক্টর লেফুয়েল নির্মিত ল্যুভরের ছয়টি বিশাল সিঁড়ির একটি দারু স্টেয়ারকেস। 

এরই মধ্যে জেনেছি ডেনন উইনিংয়ের ৭১১ নম্বর কক্ষে আছে মোনালিসা। একটু এগিয়ে যেতেই দিকনির্দেশনাও চোখে পড়ে। তবে দর্শনার্থীদের ভিড় যেদিকে প্রবহমান, সে দলে মিশে গিয়ে একসময় আবিষ্কার করবেন আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত ব্লু রুমে পৌঁছে গেছেন। স্টেটস হলকে ২০১৯ সালে রাঙানো হয় ডিপ মিড নাইট ব্লু রঙে। এ রুমের ভেনিসিয়ান মাস্টারপিসের লাল, হলুদ, কমলা ও সবুজ রঙের বিপরীতে ডিপ মিড নাইট ব্লু নাকি দারুণ মানিয়ে যায়। যদিও অনেক চিন্তা, নিরীক্ষা আর গবেষণা করেই বাছাই করা হয় এ রঙ।  

ঢুকেই মনে হলো ল্যুভরের সব দর্শনার্থী বোধহয় আজ এখানেই ভিড় করেছে। সর্পিল আকৃতির লাইনে দাঁড়িয়ে একটু একটু করে এগোচ্ছি মোনালিসার দিকে। কোলাহলে মুখর কক্ষে সবার উৎসাহ চোখে পড়ার মতো। ছবি তোলার অনুমতি আছে। দূর থেকেই ছবি তুলতে শুরু করেছে অনেকে। প্রায় মিনিট ২০ পর শেষমেশ দাঁড়ালাম মোনালিসার সামনে। অন্যান্য শিল্পকর্মকে কাছ থেকে দেখার অনুমতি থাকলেও মোনালিসা ব্যতিক্রম। ব্যারিকেড দেয়া। ব্যারিকেডের ভেতরে কমপক্ষে চারজন সতর্ক প্রহরী। কোনো দর্শনার্থীকে ১০-১৫ সেকেন্ডের বেশি দাঁড়াতে দিচ্ছেন না। তাড়া দিচ্ছেন। কোনোমতে যেন এক পলক দেখে চলে যেতে হবে! আমি ছবি তুলতে, দেখতে একটু বেশি সময় নিচ্ছি বলে একজন খুব কঠিন মুখোভঙ্গি করে অনাড়ি ইংরেজিতে বলে উঠলেন, ‘ইওর টাইম ইজ আপ, ইওর টাইম ইজ আপ।’

আমার চোখে অনুনয়। যতটা বড় ভেবেছিলাম, মোনালিসাকে ততটা বড় ক্যানভাসে আঁকেননি ভিঞ্চি। চারপাশের ছড়িয়ে পড়া গুঞ্জন উপেক্ষা করে, মোনালিসায় মনোযোগ দিতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না। কি অদ্ভুত শিল্প! আর হাসিটা! ভ্রু নেই! চিত্রকলার ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আমি! মানুষের আঁকা সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম! বলা হয় অন্যান্য অসমাপ্ত কাজের মতোই মোনালিসাকেও শেষ করতে পারেননি লিওনার্দো। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, যদি মোনালিসাকে লিওনার্দো তার মতো করে শেষ (পারফেক্ট) করে যেতেন, তাহলে এটি দেখতে কেমন হতো?

১৫০৩ সালে শুরু করলেও জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত মোনালিসাকে এঁকেছেন ভিঞ্চি। প্রায় ১৬ বছর ধরে একটি-দুটি করে তুলির টান দিয়েও তার কাছে মোনালিসা ছিল অসমাপ্ত এক শিল্প। লিওনার্দো এতটাই পারফেকশনিস্ট ছিলেন যে একটি স্কেচের অসংখ্য ভার্সন আঁকতেন। তার পরে তাতে রঙ-তুলির আঁচড় পড়ত। তিনি যেমন এঁকেছেন অনেক, তেমনি পুড়িয়েও ফেলেছেন অনেক ছবি। শিল্পী হিসেবে তার কনিষ্ঠপ্রায় রাফায়েল কিংবা মাইকেলেঞ্জেলোরা যখন ফ্লোরেন্স দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, লিওনার্দো তখন একের পর এক অসমাপ্ত কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে মাইকেলেঞ্জেলো যখন তার ডেভিড ভাস্কর্যের কাজ শেষ করে ফ্লোরেন্সে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছেন, লিওনার্দো তখন ফ্রান্সেস্কো দেল জিয়োকন্দোর কাছ থেকে কমিশনপ্রাপ্ত হয়েছেন তার স্ত্রী লিসা দেল জিয়োকন্দোর ছবি আঁকার জন্য। মোনালিসার শুরুটা ছিল এভাবে।

প্রহরীদের একজন এবার খানিকটা ক্ষেপে গিয়ে আমাকে বললেন, ‘‌তোমার শেষ হয়নি?’ আমি হাসিমুখে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভিঞ্চির সবচেয়ে সমৃদ্ধ সংগ্রহ কী তোমাদের? সে গর্বের হাসি হেসে জানাল, ‘‌Yes, the largest collection of da Vinci works in the world.

মোনালিসার ঠিক বিপরীতে দেয়ালজুড়ে আছে রেনেসাঁ যুগের আরেক খ্যাতনামা শিল্পী পাওলো ভেরোনিসের ‘দ্য ওয়েডিং ফিস্ট অ্যাট ক্যানা’। তিসিয়ানো কিংবা তিনতোরেত্তোর বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলো যেন বাড়তি প্রাপ্তি। তবে ছোট মোনালিসার বিপরীতে বিশাল আকৃতির দ্য ওয়েডিং ফিস্ট অ্যাট ক্যানা নির্বাচন যেন শূন্যতার মধ্যে ভারসাম্য টানারই প্রয়াস। তিসিয়ানোর পোস্টোরাল কনর্সাট, ওম্যান উইথ আ মিরর, ম্যান উইথ আ গ্লাভ কিংবা তিনতোরেত্তোর তেলরঙে আঁকা দ্য করনেশন অব দ্য ভার্জিন ভেনিসিয়ান রেনেসাঁ শিল্পীদের রঙ-তুলির অনন্যতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

৭১১ নম্বর কক্ষ থেকে বের হতে গিয়ে মনে পড়ছিল লিওনার্দোর জীবনীকার জর্জিও ভাসারির কথা। ভাসারি তার বইয়ে লিখেছেন, ‘মৃত্যুর সময় বিলাপরত লিওনার্দো বলেছেন, যেভাবে উচিত ছিল সেভাবে কাজ না করে তিনি তার শিল্পকর্মের মাধ্যমে স্রষ্টা ও মানবজাতির প্রতি অন্যায় করেছেন।’ স্বভাবগতভাবে অস্থিরমতি লিওনার্দো যদি তার মতো ‘পারফেক্ট’ করে মোনালিসাকে আঁকতেন, কেমন হতো মোনালিসা?

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন