ধ্রুপদি পারস্যের চার নকিব

আহমেদ দীন রুমি

ইস্কান্দারনামার মিনিয়েচার, কামাল উদ্দীন বেহযাদ ছবি: উইকিআর্ট

হেরাতের গভর্নর ছিলেন আট বছর। এবার রাজধানীর তাবরিজে ফেরার পথ ধরলেন যুবরাজ তামাস্প। সঙ্গে পণ্ডিত, কবি ও শিল্পীদের দল। তাদের মধ্যে একজনকে খুব আলাদাভাবেই চেনা যায়। উজ্জ্বল দৃষ্টি ও ঋজু শরীরের প্রবীণ কামাল উদ্দীন বেহযাদ। রাজকীয় কিতাবদার নিযুক্ত করা হলো তাকে। পাণ্ডুলিপির অলংকরণ ও চিত্র সংযোজনের দায়িত্ব। নতুন পৃষ্ঠপোষকতায় নিজের মুন্সিয়ানা মেলে ধরলেন বেহযাদ। অবশ্য খুব ভালো করেই জানেন, তাকে কী করতে হবে। হেরাতের রাজকীয় গ্রন্থশালায় প্রমাণ দিয়েছেন। সাফাভি যুগ তো শুরু হলো মাত্র, বেহযাদের শিল্পজীবন প্রবাদকেও ছাপিয়ে গেছে। তার তুলির আঁচড়কে তুলনা করা হয় যিশুর অলৌকিক ক্ষমতার সঙ্গে। 

‌তার আঁকা পাখি যেন হৃদয়কে করে সম্মোহিত

যিশুর বানানো সেই পাখিটির মতো, 

যেন নিমেষেই প্রাণ পেয়ে গেয়ে উঠবে গান।

বেহযাদের জন্ম খোরাসানে। ১৪৫৫ সালে। শৈশবেই হারিয়েছেন বাবা-মা। বেড়ে উঠেছেন বিখ্যাত চিত্রকর মিরাক নাক্কাশের অধীনে। হেরাত তখন তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক রাজধানী। বিশ্ববিজেতা তৈমুর লঙের ছেলে শাহরুখের পৃষ্ঠপোষকতায় জন্ম নিয়েছে স্বতন্ত্র শিল্প আন্দোলন। পরবর্তী সময়ে বায়সানগুর মির্জা ও সুলতান হুসাইন বায়কারার সময়ে লাভ করে অনন্য মাত্রা। মিরাক নাক্কাশ ছিলেন শিল্প আন্দোলনের প্রথম সারিতে। তার কাছেই চিত্রকলায় হাতেখড়ি বেহযাদের। প্রভাবিত হয়েছেন দরবারের গুরুত্বপূর্ণ চিত্রকর ও ভাষাবিদ মীর আলী শির নাভাইয়ের দ্বারাও। সুলতান হুসাইন বায়কারাই ১৪৮৬ সালে বেহযাদকে হেরাতের রাজকীয় কিতাবদার মনোনীত করেন। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। সুলতানের মৃত্যুর পর হেরাত দখল করে নেন শাহ ইসমাইল। প্রতিষ্ঠিত হয় পারস্যে সাফাভি শাসনের যুগ। শিল্পকলার ইতিহাস সেখানে হাজার বছর আগের। তবে তৈমুরীয় ও বিশেষ করে সাফাভি শাসন হয়ে ওঠে চিত্রকলার স্বর্ণ সময়। ১৫৩৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেহযাদ সাফাভি রাজধানী তাবরিজেই বসবাস করেছেন। 

নিজের সময়কে সংজ্ঞায়িত করেছেন বেহযাদ। রঙ সম্পর্কে ধারণার গভীরতা ও উপস্থাপনার মুন্সিয়ানা দিয়েছে স্বতন্ত্র স্থান। বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে আরো মানবিক। প্রথাগত ফ্রেম থেকে মিনিয়েচারকে মুক্তি দিয়েছেন তিনি। হাজির করেছেন ভিন্ন বাস্তবতায়। তার নজির পারসিক কবি সাদীর গুলিস্তাঁ ও বুস্তাঁর মিনিয়েচার। ১৪৯৪ সালে আঁকা ‘‌খাওয়ারনাক দুর্গ’-তে উঠে এসেছে বিকাশমান আধুনিকতার প্রতি ঝোঁক। এছাড়া ইয়াজদির জাফর-নামা, আত্তারের আল মানতিকুত ত্বায়ের ও নিজামির খামসার মিনিয়েচারে তার শৈল্পিক নিপুণতা পরাবাস্তব জগতে নিয়ে যায়। বিষয়বস্তুকে বিস্তারিতভাবে হাজির করা হেরাত ঘরানার চিত্রকর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বেহযাদ তাকে পরিণতি দিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী প্রজন্মের ওপর তার প্রভাব ছিল অবশ্যম্ভাবী। হেরাতের শায়েখজাদেহ ছিলেন তার ছাত্র, যার মাধ্যমে হেরাত ও তাবরিজ থেকে বুখারায় বিস্তৃত হয়েছে বেহযাদের তুলির জাদু। উসমানি ঐতিহাসিক মোস্তফা আলি বেহযাদ তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। চিত্রকর্ম ঠাঁই পেয়েছে মোগল সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের দরবারে। তার উত্তরাধিকার ছড়িয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে ছাত্রদের মধ্যে। কাসিম আলি, মীর সাঈদ আলি, আকা মিরাক ও মোজাফফর আলির তুলিতে ছিল বেহযাদের প্রত্যক্ষ প্রভাব। তাদের প্রত্যেকেই পারসিক চিত্রকলায় স্বতন্ত্র নক্ষত্রের মতোই উজ্জ্বল। পাটাতন তৈরি করেছেন চিত্রকর খাজা আব্দুস সামাদ, নাজিরি, আকা মিরাক, মীর মোসাব্বির, কাদিমি, খাজা আবদুল ওয়াহাব, হাসান নাক্কাশের উত্থানে। তাদের হাত ধরে কেবল পারসিক চিত্রকলায় রেনেসাঁ আসেনি, কেউ কেউ উসমানি কিংবা মোগল দরবারে গিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন সেখানকার ইতিহাস।  

বেহযাদ তাবরিজে আসার আগে থেকেই সেখানে বসবাস করেছেন সুলতান মুহাম্মদ। ১৪৯৫ থেকে ১৫২২ সাল পর্যন্ত তিনি চিত্রকলায় তুর্কি ধারা অনুসরণ করতেন। পশ্চিম ইরানে আক কুয়ুনলু ও কারা কুয়ুনলু শাসকদের অধীনে গড়ে উঠেছিল এ শিল্পপ্রবণতা। চরিত্র চিত্রণে গতিময়তা, বিষয়বস্তু নির্বাচনে খেয়ালিপনা ও উপস্থাপনার অদ্ভুত ঝোঁক বিদ্যমান এ ঘরানার চিত্রকর্মে। শাহ ইসমাইলের দরবারে থাকা অবস্থায় তার সৃষ্টিতেও এ গুণ দেখা যায়। তবে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে বেহযাদের আগমনের পর। সুলতান মুহম্মদের পরবর্তী চিত্রকর্মে তুর্কি ও হেরাত ঘরানার বৈশিষ্ট্য একীভূত হয়েছে। যেহেতু তিনি দীর্ঘদিন ছিলেন যুবরাজ তামাস্পের শিক্ষক। ফলে দরবারে তার প্রভাব সহজেই অনুমেয়। ১৫২০-৩৮ সাল পর্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন শাহনামার মিনিয়েচার তৈরিতে। বেহযাদের ছাত্র শায়েখজাদেহের সঙ্গে কাজ করেন দিওয়ানে হাফিজের মিনিয়েচারে। মীর আলী শির নাভাইয়ের দিওয়ানেও কাজ করেছেন সুলতান মুহম্মদ। শাহ তামাস্পের অনুরোধে চিত্ররূপ দেন নিজামীর খামসার। ক্যানভাসে মূর্ত হওয়া বিষয়বস্তু ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। রঙ নির্বাচন, গভীরতা ও ভারসম্য তাকে বেহযাদের পরবর্তী শ্রেষ্ঠ আসনে আসীন করেছে। সুলতান মুহম্মদের ছেলে ও ছাত্র মুহম্মদী। পিতার ভাবধারাকে পরিপূর্ণ রূপে বিকশিত করার প্রয়াস পান। 

পারসিক স্বর্ণযুগ গণ্য করা হয় শাহ আব্বাসের সময়কে। দরবারের গুরুত্বপূর্ণ রত্ন ছিলেন সাদিকি বেগ আফশার। তার জন্ম ১৫৩৩ সালে। পিতার মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন দুনিয়াবিমুখ দরবেশি জীবনযাপন করেছেন। ৩২ বছর বয়সে আকৃষ্ট হন শিল্পকলার প্রতি। একদিকে চলতে থাকে চিত্রাঙ্কন আর অন্যদিকে লেখালেখি। কবিতা প্রভাবিত ছিল মাহমুদ আবদুল বাকি ও মুহাম্মদ বিন সুলাইমান ফুজুলির দ্বারা। পূর্ববর্তী বিখ্যাত ৩৬০ জন কবি ও তাদের কাজ নিয়ে লিখেছেন তাজকিরাহ মাজমা’আল খাওয়াস। পারসিক চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য ও কায়দা-কানুন নিয়ে লেখা বই ‘‌কানুন আস-সুয়ার’। মিনিয়েচার অঙ্কনেও তার দক্ষতা ছিল অসামান্য। মোল্লা হোসাইন বিন আলীর লেখা ‘‌আনওয়ার-ই সুহায়লি’ অনেক আগে থেকেই ‘‌কালিলা ওয়া দিমনা’ নামে পরিচিত। বইটিতে ১০৭টি মিনিয়েচার পাওয়া যায় সাদিকি বেগের আঁকা। ১৬১০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সাফাভি দরবারের রাজকীয় কিতাবদার নিযুক্ত ছিলেন। দরবারি পৃষ্ঠপোষকতায় উপহার দেন অনেক সৃষ্টিকর্ম। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত শাহনামা, বর্তমানে ডাবলিনের চেস্টার বেটি লাইব্রেরিতে বিদ্যমান। 

আলি রেজা আব্বাসিকে মনে করা হয় পারসিক ধ্রুপদি যুগের শেষ শ্রেষ্ঠ চিত্রকর। তাবরিজে জন্মগ্রহণ করলেও কর্মক্ষেত্র ছিল কাজভিন ও ইসফাহান। পিতা আলী আসগর কাশানিও ছিলেন স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী। সাফাভি শাসক শাহ আব্বাসের আমলে ইসফাহানে ভবনে নকশা নিয়ে তার ব্যস্ততা ছিল বেশি। মুন্সিয়ানা ছিল নাস্তালিক ক্যালিগ্রাফিতে। ১৫৮৫ সালে কাজভিনে আসেন। যোগ দেন সাফাভি দরবারে। ১৬২৯ সালে শাহ আব্বাসের মৃত্যু পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন চিত্রকলার সঙ্গে। শাহের পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই নিজের আলি রেজা নামের সঙ্গে আব্বাসী শব্দ যোগ করেন। সম্রাটের জন্য চিত্রকর্মের একটা অ্যালবাম তৈরি করেন ‘‌কিরকাত নামা’ নামে, পরবর্তী প্রজন্মে যা প্রভাবশালী সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত। সাফাভি দরবার ইসফাহানে সরিয়ে নেয়া হলে আরো কর্মমুখী হয়ে ওঠেন রেজা আব্বাসী। সাদিকি বেগের পর তিনিই নিযুক্ত হন রাজগ্রন্থশালার কিতাবদার। তখন থেকে পরবর্তী দুই দশক ডুবে থেকেছেন শিল্পের মধ্যে। উপহার দিয়েছেন অনন্য সব সৃষ্টিকর্ম। ইমাম রেজার সমাধি ও ইসফাহানের মসজিদের লিপির নকশা করেছেন তিনি। ১৬০৪ সালে মসজিদে শেখ লুতফুল্লাহ ও ১৬১৭ সালে মসজিদে শাহের নকশাতে রেখেছেন অবদান। এতদিন চিত্রশিল্পীরা সৃষ্টিকর্মে খুব একটা স্বাক্ষর করতেন না। রেজা আব্বাসী এদিক থেকে ছিলেন অস্তিত্বচেতনাসম্পন্ন। চিত্রকর্মে কেবল নিজের স্বাক্ষর নয়, অঙ্কনের তারিখ ও সংশ্লিষ্ট তথ্যও লিখে দিতেন। ১৬৩১-৩২ সালে অঙ্কিত খসরু ও শিরিনের অন্তত ১৯টি মিনিয়েচার এঁকেছেন তিনি। তবে তার শ্রেষ্ঠ নির্মাণ মুরাক্কা, যা বিক্রি হয়েছে বিভিন্ন সময়। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে তিনি এঁকে দিতেন ছবি। পারসিক চিত্রকলার ইতিহাস এ প্রবণতাকে অভিনবই বলতে হবে। রেজা আব্বাসীর এ দরবারের বাইরে কেবল শিল্পী হিসেবে স্বতন্ত্র আবেদন সৃষ্টির ঝোঁক তার বিদ্রোহী রূপেরই প্রকাশ। অপেক্ষাকৃত কম রঙের ব্যবহার করলেও চিত্র হয়ে উঠেছে আরো বেশি বাস্তব ও মানবিক। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী হোক কিংবা নিজের, ক্যানভাসে মূর্ত হওয়া বিষয়বস্তু ছিল প্রেম ও তারুণ্য। তার তুলির আঁচড়ে এ আধুনিকতা পথ তৈরি করে দিয়েছে মইন মুসাব্বির ও মুহম্মদ শাফি আব্বাসির মতো চিত্রকরদের জন্য। আধুনিক পারসিক চিত্রকলায় নানা দিক থেকেই এসেছে পরিবর্তন। ইউরোপীয় প্রভাবে বদল ঘটেছে বিষয়বস্তু ও ধরনে। তবে ধ্রুপদি চিত্রকলার ওস্তাদরা এখনো কম্পাসের মতো পথনির্দেশ করে চলছেন পারসিক ঐতিহ্য, আধিপত্য ও স্বাতন্ত্র্যের।  

আহমেদ দীন রুমি: লেখক ও সাংবাদিক 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন