![](https://bonikbarta.net/uploads/news_image/news_337372_1.png?t=1720458935)
পৃথিবীর অন্যতম উর্বরভূমি এই বাংলাদেশ। কৃষিভিত্তিক এ অঞ্চলের প্রধান ভাব সহজ মানুষ, মাটির মানুষ; যা আস্বাদিত হয়েছে গান-গল্পে-চিত্রে। লোকজ বাংলার সরলতা ও আধিভৌতিক কল্পনা তার চিত্রকলার সারবস্তু। সে ধারাবাহিকতা বাহিত আছে আধুনিক শিল্প ও মননে।
গত শতকে বাঙালি যখন জাতিভিত্তিক স্বাধিকারে উন্মুখ হয়েছে তখন তার সামনে এ শিল্পচৈতন্য হয়েছে যূথবদ্ধতার উপলক্ষ। আমাদের মাস্টার পেইন্টারদের আঁকাআঁকিতে যখন আমরা চোখ বোলাই, স্পষ্ট অনুভব করি যে মাটি ও মাটির মানুষের কাছাকাছি আছি। হাল দুনিয়ার সঙ্গে ঐতিহ্যিক প্রভাবকে তারা নতুন ছাঁচে গড়েছেন।
এখনকার পহেলা বৈশাখ উদযাপন থেকে এ অঞ্চলের লোকজ ঐতিহ্যের ধারণা পাওয়া যায়। প্রাচীন বাংলার পটচিত্র, দেয়াল অঙ্কন, সরাচিত্র, ঘটচিত্র, আলপনা বা বিভিন্ন টোটেমের অনুকৃতি। মঙ্গল শোভাযাত্রা হোক বা পোশাকের নকশা বা গ্রাফিতিতে। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ঘাঁটলে পাল আমল পর্যন্ত একটা স্পষ্ট চিত্র আমরা পাই। এর আগের শিল্পকলার নমুনাও বিক্ষিপ্ত। সেই বিক্ষিপ্ত নমুনায় আমরা টেরাকোটার কাজ দেখি। ফুল-পাতা থেকে পশু-পাখি, নর-নারী, দেব-দেবী ও কাল্পনিক গল্পগাথা। তবে বৃহৎ বাংলার চিত্রকলার সর্বপ্রাচীন প্রামাণিক নিদর্শন পাল আমলের তালপাতার পুঁথি ও কাঠের প্রচ্ছদে আঁকা বৌদ্ধ ধর্মের অনুচিত্রগুলো, যা পালচিত্র নামে এখনো সমাদৃত। টেরাকোটা বা তালপাতার চিত্রে গল্প থাকলেও সবচেয়ে বেশি স্থায়িত্ব পেয়েছে পটচিত্র, যা একান্ত লোকজ শ্রেণীর আবিষ্কার। পটচিত্রের সঙ্গে আনুষঙ্গিক গল্প বলা হতো মুখে মুখে। বাংলায় প্রিন্টিং টেকনোলজি সহজলভ্য হওয়ার আগে বিভিন্ন পুরাণ থেকে গাথা মানুষের মুখে মুখে প্রচার হতো। টিকে ছিল হাজার বছর। পটচিত্র সেই গল্পের ভিন্নতর সাক্ষী।
ঔপনিবেশিক
আমলে ১৮৫৪ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় গভর্নমেন্ট কলেজ
অব আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট। আর্ট স্কুলটি পুরো বাংলায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এখনকার শিল্পীরা প্রথমবার শিল্পকলাকে ডিসিপ্লিন আকারে অধ্যয়নের সুযোগ পান। স্বভাবতই প্রথাসিদ্ধ রীতির সঙ্গে শিল্পীদের মানিয়ে নিতে হয়েছে। তখনই দেশীয় রীতির সংশ্লেষণে নতুন নতুন ধারা আবির্ভূত হয়। পূর্ব বাংলা থেকে যাওয়া শিক্ষার্থীরা শুধু শিল্পাচ্ছন্ন মন নিয়ে হাজির
হননি, হাজির হন শিক্ষা উন্নয়নের
আলো না পাওয়া জনগোষ্ঠীর
প্রতিনিধি আকারে, যাদের রয়েছে সমৃদ্ধ শিল্প ঐতিহ্য। আমাদের এ আলোচনা সেই
সংশ্লেষণের ক্ষুদ্র বিবরণ।
দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা দিয়ে তাক লাগিয়ে দেন এ আর্ট স্কুলের জয়নুল আবেদিন। আধুনিক এ চিত্রমালায় মানবসৃষ্ট ট্র্যাজেডির সবল বয়ান পাওয়া যায়। পরিপ্রেক্ষিতকে গৌণ করে মোটা তুলি ও স্পেস ব্যবহারের দৃঢ়তা এর প্রধান দিক। পরবর্তী সময়ে পাইন্যার মা, প্রসাধন ও গুণটানাসহ প্রভৃতি চিত্রে লোকশৈলীর সঙ্গে জ্যামিতিক বিন্যাসের সংশ্লেষ ঘটান। লোকজ শিল্পকলার প্রতি জয়নুলের সেই টান আজীবন ছিল। তিনি লোকধারাকে বিকশিত করার উদ্যোগ হিসেবে সোনারগাঁয় প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন।
পটচিত্রের
কারিগরদের অভিধা ‘পটুয়া’ নিজের
করে নিয়েছেন আরেক শিল্প কামরুল হাসান। লোকজ চিত্রকলা, পুতুল, ভাস্কর্য, কারুকলা ছিল তার অনুপ্রেরণা। তিন কন্যা, গুণটানার মতো ছবির নারী উঠে এসেছেন ঐতিহ্যবাহী পুতুল থেকে। ভরাট দেহ, দীর্ঘ গ্রীবা বা চোখ-নাক
লোকজ মোটিফ মনে করিয়ে দেবে। আবার কিউবিজমের সফল সংশ্লেষণ ঘটিয়েছেন।
সফিউদ্দীন আহমেদের সমকালে এ অঞ্চলে ছাপচিত্র ছিল সর্বাধুনিক টেকনিক। তার কাজে প্রধান হয়ে উঠেছে পানি, মাছ ও নৌকা ও প্রতীকায়িত চোখ, বাংলার জনজীবন ও লোকগানে যার আলাদা অর্থ আছে। আধাবিমূর্ত জ্যামিতিক ফর্মের সঙ্গে মিলিয়েছেন লোকজ মোটিফ। জ্যামিতিক আকৃতির অনুষঙ্গ পাওয়া যায় কাইয়ুম চৌধুরীর মোটা দাগের নকশাপ্রধান ছবিতে। পুতুল, পাখা, হাঁড়ি, শীতলপাটি, কাঁথার ব্যবহার লক্ষণীয়।
লোকজ গল্পকে শিল্পচর্চার বিষয় করে তুলেছেন আবদুস শাকুর। মৈমনসিংহ গীতিকার মহুয়া, মলুয়া, কমলা, রূপবতী, চন্দ্রাবতী, কাজলরেখা, জয়চন্দ্র, নদের চাঁদ ইত্যাদি চরিত্র এসেছে তার তুলিতে। চরিত্র অনুসারে লোকশিল্প থেকে ধার করেছেন নকশা, রঙ ও বিন্দু। যুক্ত করেছেন গীতিকার পদ ও উদ্ধৃতির ক্যালিগ্রাফি।
অন্যদিকে রশিদ চৌধুরীর হাত ধরে উপমহাদেশে ট্যাপেস্ট্রির নবযুগের সূচনা হয়। পাশ্চাত্যে প্রশিক্ষণ নেয়া এ শিল্পীর বেড়ে ওঠা বাংলার গ্রামীণ পরিবেশে। ফলে ট্যাপেস্ট্রির ঢঙ তার কাছে অপরিচিত ছিল না। সুতা, পাট ও রেশম ব্যবহার করে ঐতিহ্যবাহী তাঁতের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
বাংলার ঐতিহ্য ও মৃত্তিকাসংলগ্ন জনপদ থেকে উত্থান এসএম সুলতানের। বাংলার মানুষকে বলশালী ও কর্তৃত্বপরায়ণরূপে হাজির করেন তিনি। এ রূপান্তর শুধু শারীরিক নয়, সমাজের অন্তর্গত সাম্য চেতনার আবির্ভাব। চারা রোপণ, ভূমি কর্ষণ, মাছ ধরা, ফসল তোলার মতো গ্রামীণ দৃশ্যের ভেতর যোগ করেছেন সাধারণ মানুষের ভাবকল্পনা।
লোকজ শিল্পকলা ও তার পেছনে রয়েছে নানা ধরনের বিশ্বাস। আধুনিককালের শিল্পীদের জন্য এ ধরনের মোটিফ আত্মস্থ করা চ্যালেঞ্জেরই। শুধু অনুকৃতি বা শৈলী আকারে দেখলে চলে না, শিল্পের প্রতিটি আঙ্গিকই সপ্রাণ ও অর্থবহ। ফলে এক ধরনের পর্যালোচনার মাধ্যমে গেছে এসব অনুষঙ্গ, যাকে স্থানিক ও কালিক আবহ থেকে মুক্ত করতে সচেতন ছিলেন তারা। আর পুরো সফরে আধুনিক শিল্পীরা ঐতিহ্যনিষ্ঠতা ও আত্মপরিচয়ের সবল দিকটি উন্মোচন করেন।
লেখক: সাংবাদিক