সাক্ষাৎকার

‘অসম্মতির মানচিত্র-আমার দীর্ঘকালীন প্রস্তুতি’

২৭ জানুয়ারি শুরু হওয়া ‘অসম্মতির মানচিত্র’ প্রদর্শনীটি চলবে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ছবি: সালাউদ্দিন পলাশ

দেড় মাস ধরে ঢাকার বেঙ্গল শিল্পালয়ে চলছে শিল্পী ঢালী আল মামুনের শিল্পকর্মের প্রদর্শনী ‘অসম্মতির মানচিত্র’। প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন তানজিম ওয়াহাব। ঔপনিবেশিক ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিনের গবেষণাকে শিল্পের বহুমাত্রিক মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন শিল্পী। তার কাজে টের পাওয়া যায় ইতিহাসের পুনঃপাঠ এবং প্রচলিত শিল্পশিক্ষা ও চর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস। ঢালী আল মামুনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রুহিনা ফেরদৌস

বিষয়বস্তু হিসেবে ঔপনিবেশিকতাকেই বেছে নিলেন কেন?

বেছে নিয়েছি কথাটা একদিকে সত্য, অন্যদিকে নয়। পরিমণ্ডল পরিস্থিতি আমাকে রকম একটি চিন্তার মধ্যে উপবিষ্ট করে। আমি যদি বর্তমানের বাস্তবতাকে দেখতে বা বুঝতে চাই, আমাকে অতীতের দিকে তাকাতে হবে। তাই আমি যখন কাজ করি তখন ইতিহাসনিবিষ্ট হয়ে পড়ি। আদিবাসী জনপদকে ঘিরে আমার একটি ইনস্টলেশন ছিলঅপাপবিদ্ধ জল!’ জলবিদ্যুৎ কেমন করে একটি জনপদের জীবনযাত্রাকে পাল্টে দেয়, তা খুঁজতে ইতিহাসের দিকে তাকাতে হয়েছে আমাকে।অসম্মতির মানচিত্র আমার দীর্ঘকালীন প্রস্তুতি। শিক্ষার্থী থাকাকাল থেকেই আমার মধ্যে -সম্পর্কিত জিজ্ঞাসা কাজ করত। বিদ্যায়তনিক শিক্ষা শেষের দিকে আমিপ্রসঙ্গ পত্রিকায়হীনম্মন্যতার পাচিল নামে একটি নিবন্ধ লিখি, যেটি ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার আমাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভার চাপিয়ে দিয়েছে; যে ভারগুলো আমরা এখন পর্যন্ত বহন করছি। এখন পর্যন্ত আমাদের শিল্পচর্চা থেকে শুরু করে সমস্ত জ্ঞানকাণ্ডে তার প্রভাব বিদ্যমান। সে ভারের বোঝা আমরা বহন করছি এখনো। জায়গা থেকে ঔপনিবেশিকতাকে নতুন করে পাঠ করা বা ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্য আমার মধ্যে ছিল। একটা কথা বলে রাখা ভালো, আমি শিল্পচর্চাকে শুধু নিরেট আবেগ কিংবা ইনটিউশন মনে করি না; এগুলো সূত্রপাত হতে পারে। কিন্তু শিল্পচর্চাও মূলত একটি জ্ঞানকাণ্ড।

আমাদের জনপদে ঔপনিবেশিকতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আপনার কাজের মাধ্যমে কোন প্রশ্নগুলো সামনে আনতে চেয়েছেন?

সভ্যকরণ বয়ান প্রকল্প জনপদের ঔপনিবেশিকতাকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলে বা গ্রাহ্যতা দেয়। অর্থাৎ আমরা সিভিলাইজড ছিলাম না। তারা আমাদের সভ্য করতে আসে। যা ভয়ানক বঞ্চনাএর পেছনে ছিল অন্য উদ্দেশ্য। ঠিক আজকে যেমন আমরা যথার্থ উন্নয়নশীল দেশ নই। আমাদের এখনো উন্নয়ন হতে বাকি আছে; এই মানদণ্ড আমাদের সবসময় অনুসরণ করতে হয়। ঠিক আমাদের জ্ঞানকাণ্ড, শিল্পচর্চা সমস্ত ক্ষেত্রে এটি রয়েছে। ফলে আমাদের সবসময় একটা নির্ভরশীলতা, অনুকরণ অনুসরণ করতে হয়। এই যে চিন্তাকাঠামো, যার সঙ্গে পরিমণ্ডলের সম্পর্ক বা প্রাসঙ্গিকতা ইত্যাদি প্রশ্ন; থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায় তা বোঝার চেষ্টায় ধরনের কাজ করার প্রতি আমি সচেষ্ট হই।

পেইন্টিংস, অ্যানিমেশন, ইনস্টলেশনের মাধ্যমে আপনি চিন্তাকে প্রকাশ করেছেন। তালপাতার সেপাই থেকে শুরু করে মানুষের মাথার খুলি, হেগেলের প্রতিকৃতি, জয়নুলের কাক-দুর্ভিক্ষের স্কেচ কিংবা পিকাসোর প্রাণী আপনার কাজের বিষয়বস্তুর সঙ্গে কেন কতটা সম্পর্কযুক্ত?

একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন। শিল্পচর্চায় আগে আমরা রঙ-রেখা-ফর্ম ব্যবহার করতাম একটা অবয়ব তৈরির জন্য। তাদের আলাদা কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু ক্রমাগতভাবে এসব উপাদান অর্থকারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। প্রদর্শনীতে আমার বেশির ভাগ শিল্পকর্মে চা নীল রঙের ব্যবহার লক্ষণীয়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের মসলা রেখেছি। ভাষাবিজ্ঞানের ভাষায় এদের সিগনিফায়ার বলতে পারি। উপাদানগুলো ইতিহাসের সাক্ষী, যা শিল্পের উপকরণ হিসেবে স্থান পেয়েছে। একই সঙ্গে তা অর্থকারক, অর্থনির্ণায়ক যোগাযোগ স্থাপনের সহযোগীও। রেললাইন ঔপনিবেশিকতার অন্যতম অনুষঙ্গ। উপনিবেশবাদীদের রেললাইন তৈরির নেপথ্যের উদ্দেশ্য কী? সত্যিই জনপদের যোগাযোগের জন্য নাকি সম্পদ আহরণের জন্য, তা ইতিহাসের পরিসংখ্যানই বলে দেবে। রেললাইন কুকুরের দেহের ওপর মানুষের মুখাকৃতি স্থাপনএটি পরস্পরের সঙ্গে তুলনা করা নয়, বরং দুইয়ে মিলে একটি তৃতীয় অর্থ নির্মাণ করে। অর্থাৎ কুকর প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে বিশেষ আচারণ রয়েছে, যেমন তারা অঞ্চলের সীমানা নির্ধারণ করে থাকে। ঠিক তদ্রূপ আচরণ উপনিবেশ স্থাপনকারীদের চিন্তার মধ্যে রয়েছে বলে আমার মনে হয়। বস্তুত এটি ভূখণ্ডবাদিতা। ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে অনেক জ্ঞানকাণ্ডের মতোই মানচিত্রবিদ্যাও গুরুত্বপূর্ণ। মানচিত্রকরণের মাধ্যমে উপমহাদেশে ভয়ানক সন্ত্রস্ত বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। ফলে ঔপনিবেশিকতাকে সামগ্রিকভাবে উদৃষ্ট করার মানচিত্রবিদ্যা, ভূখণ্ডবাদ ইত্যাদিকে বিশেষ ছিন্ন ব্যবস্থায় উপস্থাপনের চেষ্টা ছিল, যা একই সঙ্গে অর্থকারক, অর্থ উৎপাদক যোগাযোগ স্থাপনের সহযোগীও।

আমাদের যোগাযোগ এবং বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে ইমেজ বা দৃশ্যরূপ বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। যে দৃশ্যরূপ উপাখ্যান বা ফিকশনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেমন স্থাপত্যকলাকেফ্রোজেন মিউজিক বলা হয়। তদ্রূপ আমারও মনে হয় ইমেজও ফ্রোজেন ফিকশন। ২০০৮ সালে ঢাকা থিয়েটারেরনিমজ্জন নাটকের মঞ্চসজ্জার কাজ করতে গিয়ে খুব প্রাসঙ্গিকভাবে পাবলো পিকাসোর গোয়ের্নিকাকে অ্যানিমেট করে ব্যবহার করি। এটি করতে গিয়ে আমি দেখলাম গোয়ের্নিকা একটি উপাখ্যানে রূপান্তিত হয়েছে। কেননা একটি স্থির ইমেজ যখন চলমান হয়ে ওঠে তখন তা একই সঙ্গে উপাখ্যানেও রূপান্তরিত হয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই অসম্মতির মানচিত্রে অ্যানিমেশনের ব্যবহার।

প্রদর্শনীতে আরো বেশ কয়েকটি সেগমেন্ট রয়েছে। একজন চিত্রকর হিসেবে ভাষা বিন্যস্ততার মাধ্যমে কিছু বিষয় আমি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে করার চেষ্টা করেছি। মোগল মিনিয়েচারে মানুষ থাকার পরও প্রাণী, উদ্ভিদের সমউপস্থিতি লক্ষণীয়। এটি দিয়ে আমি উৎসাহিত হয়েছি। মানুষ ছাড়াও অন্যান্য অবজেক্টও এক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ। ঔপনিবেশিকতা আধুনিকতা আমাদের জায়গাগুলো থেকে বিচ্যুত করে। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছেকাঠের নৃপতি প্রদর্শনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কেননা প্রদর্শনীর অন্যান্য কাজ কোনো না কোনোভাবে ঔপনিবেশিক বাস্তবতাকে নির্দেশ করে। কিন্তু কাঠের নৃপতির মধ্যে প্রকারান্তরে মানসিক প্রতিরোধের লক্ষণ আমরা পাই। আমাদের নিম্নবর্গীয় মানুষেরা তালপাতা দিয়ে সেপাই তৈরি করে তা নিয়ে মকারি বা উপহাস করত। আমি তার অনুপ্রেরণায় ঔপনিবেশিক সময়ের লর্ড, সেনাপতি বা সৈনিকের পোশাক থেকে নমুনা গ্রহণ করে তা প্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপন করেছি। একে পাপেট্রি, স্কাল্পচার, পারফরমেটিভ পাপেট্রি বলা যেতে পারে।

ব্রিটিশ শিল্পী ডেমিয়েন হার্স্টফর দ্য লাভ অব গড শীর্ষক ভাস্কর্যে মাথার খুলিকে যেভাবে হীরা আচ্ছাদিত করে মহিমান্বিত করেছেন, আমি বিষয়টাকে ঠিক সেভাবে দেখিনি। বরং ডেমিয়েনকে প্রত্যুত্তরের বোধ থেকে কাজটি করি। ইন্ডিগো, চা পাতা, মসলা গার্মেন্ট ওয়েস্টেজ দিয়ে তৈরি খুলিতে প্রতিনিধিত্বশীল নানা প্রতীকী সংকেতের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছাপ আর মসলিন জামদানি নকশা জুড়ে দিয়েছি, যা বস্তুত একটি চিঠি। এটি কার খুলি আমরা জানি না, তবে হয়তো কোনো ঔপনিবেশিক কিংবা উপনিবেশবাদীর!

অ্যাটলাস অব ডিসেন্ট বা অসম্মতির মানচিত্র নামকরণ প্রসঙ্গে জানতে চাই।

সম্পূর্ণ ইতিহাসের ভেতরে যা ঘটেছে সে সম্পর্কে পরিপূর্ণরূপে আমি সম্মতিজ্ঞাপন করতে পারি না। যেমন কার্টিগ্রাফির মধ্যে ভায়োলেন্স আছে। অর্থাৎ রেডক্লিফ এসে কতগুলো লাইন দিয়ে গোটা অঞ্চলটাকে ভাগ করে ফেলল। এতে জনপদের সম্মতি আছে কি নেই, নাকি কিছু মানুষের সম্মতি আছে; এটা পুনর্বিবেচনা ইতিহাসকে পুনঃপাঠ করা জরুরি। বিদ্যাচর্চা থেকে উন্নয়নচিন্তা রকম অনেক জায়গা রয়েছে যেগুলোকে পুনঃপাঠ করা দরকার। যখনই আমরা সামনের দিকে এগোতে চাইব বারবারই আমাদের অতীতকে পাঠ করতে হবে। তবে আমি পুরো প্রদর্শনীজুড়ে কখনই কোনো সুনির্দিষ্ট অর্থ নির্মাণ করতে চাইনি। কারণ বাস্তবতা এত জটিল; একটি অন্যটির সঙ্গে মিশে আছে।

আমরা ঔপনিবেশিকতাকে পুঁজিবাদ থেকে আলাদা করে কীভাবে দেখব! আজকের যে বিশ্বায়ন, তা হয়তো ঔপনিবেশিকতারই একটি সম্প্রসারিত রূপ। সারাক্ষণই আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। প্রদর্শনীর একটি পেইন্টিংয়ের মধ্যে আমি দার্শনিক হেগেলের প্রতিকৃতি ব্যবহার করেছি। আফ্রিকা সম্পর্কে হেগেলের যে বয়ান তাও প্রকারান্তরে ঔপনিবেশিকতাকে গ্রাহ্যতা দিয়েছে। তিনি আফ্রিকা সম্পর্কে অনেকটা ধরনের মন্তব্য করেছেন, আফ্রিকা উপমহাদেশ ইতিহাসের অংশ হতে পারে না। কারণ তারা যথেষ্ট পরিণত নয়। তারা অনেকটাই প্রাণীর পর্যায়ে। দাসত্বই তাদের নিয়তি। অথচ বিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী শিল্পী পাবলো পিকাসোর অ্যাভিগননের রমণীরা বা Les Demoiselles d’Avignon যখন রচিত হয় তখন পশ্চিমের সমালোচকরা এটিকে আধুনিক শিল্পকলার মাইলস্টোন বলছেন, যার উৎসাহ প্রেরণা আফ্রিকার শিল্পকলা থেকে এসেছে। আফ্রিকার মতো অপরিণত উপমহাদেশের শিল্পকর্ম পিকাসোর মতো আধুনিক শিল্পীকে কীভাবে প্রাণিত করে? প্রশ্নগুলো আমার মধ্যে জারি হতে থাকে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন