স্বতঃসংঘটিত এনথ্রোপোসিন?

ঢালী আল মামুনের ‘অ্যাটলাস অব ডিসেন্ট’

ড. এবাদুর রহমান

২৭ জানুয়ারি শুরু হওয়া ‘অসম্মতির মানচিত্র’ প্রদর্শনীটি চলবে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত। ছবি: সালাউদ্দিন পলাশ

আমাদের হননকাল, আমাদের দিঙচক্রবাল বিস্তৃত হত্যাপ্রান্তরের হদিস বা হকিকত ইতিহাস-এ লিপিবদ্ধ নয়। আমাদের অশ্রু, শোনিত ও হাহাকার, মহাফেজখানা ও দলিলে, নির্ণীত, নিরূপিত ও নিষ্পন্ন নয়। তা নয়। আর, আমাদের যে বার বার হত্যা ও লুণ্ঠন করা হয়েছে, তার নথিকে কি আদৌ ইতিহাস বলা যাবে? 

হেগেল তো বলেন নি। সাবঅল্টার্ন স্টাডির পণ্ডিত রণজিৎ গুহ, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া, তাঁর চারটি বিখ্যাত বক্তৃতাতে বিশদ করেছেন, হেগেলের চিন্তায়, আমরা কী রূপে ইতিহাসবিচ্যুত, ইতিহাসবহির্ভূত ও ইতিহাসবঞ্চিতের স্থলাভিষিক্ত হয়েছি।

আচ্ছা, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও কি বলেন নি, ‘‌সাহেবেরা যদি পাখি মারিতে যান, তাহারও ইতিহাস লিখিত হয়, কিন্তু বাঙ্গালার ইতিহাস নাই?’

তাহলে, এই জন্যই কি, এই জনপদের মুহ্যমান মানুষ ইতিহাসস্থিত হতে পারছে না বলেই কি, একই রকম বঞ্চনার ইতিহাস ফিরে ফিরে এসে আমাদেরকে আরো অসহায়, আরো আতুর, আরো অবলম্বনহীন করে দিচ্ছে?

সম্পূরক প্রশ্ন আসে, আমরা আধুনিকতা বা উত্তর-ঔপনিবেশিকতার কোন অভিজ্ঞানে অটল হলে, ইতিহাসের পঠন—একটা বোধের প্রক্ষেপ, বা, শুধুই তথ্য, সারণি, বিবরণী ও ব্যবহারিকতার বাইরে এসে—আমাদের চেতনায়, আমাদের যাপনে, আমাদের মুক্তির উদযাপনে গ্রেফতার হবে? নাকি মুজলুমের ইতিহাস একটা গনগনে আগুনে পাহাড়, দিনানুদৈনিকতার আটপৌরে স্তরেই জেগে থাকে যার জ্বালামুখ, বিস্ফোরণের অতন্দ্র অপেক্ষায়?

এতাদৃক আবজাব ভাবি, যখন শিল্পী ঢালী আল মামুনের আনতব্রজ কাঠামো, বেঙ্গল শিল্পালয়ের প্রবেশমুখ থেকে এগিয়ে এসে, মৃদু সম্ভাষণ জানিয়ে, আমাকে হুব্বা করে দেন। তিনি আমার সাথে Atlas of Dissent দেখতে, দেহলি ছাড়িয়ে কক্ষে প্রবেশ করেন না—এটা তাঁর বড়প্পন ও শরিফানা যে তিনি তাঁর উপস্থিতি আমার প্রদর্শনী দেখার অভিজ্ঞতায় আরোপ করতে নারাজি হয়েছেন।

এহিনে এলান থাক যে আমার পূর্ব-প্রবংশের শিল্পীদের মধ্যে আমি তরুণ ঘোষ ও ঢালী আল মামুনের সাথে চিন্তার বিশেষ কুটুম্বিতা মেহসুস করি। প্রদর্শনী দেখার আগেই, Atlas of Dissent রুব্রিকটিই আমাকে উদ্দীপিত করেছিল। কেন? —উত্তর দেবার আগে বলুন তো ঔপনিবেশিকতার প্রধান চারটি ঠাঁই কি? আপনি বলবেন, জমিন, জবান, জিসম আর মেহনত—তাই-ই তো? আর ঔপনিবেশিকতা যে সবচেয়ে জরুরি বর্গটি এই চিহ্নিতকরণে যোগ করা যায়, তা হলো কালপ্রবাহ বা সময়। 

ঔপনিবেশিত মনে বেড়ি পরাতে বা ভাবদাস্যতা নির্মাণ করতে ঔপনিবেশিক শক্তি, মুজলুমের কালগণনা বা সময়ের সিয়াসতকে নির্মূল করে এক নূতন ক্রনোপলিটিকস (cronopolitics)-এর সূচনা করে। যে সহিংসতা দিয়ে আমাদের কৃষ্টি, কৃষি ও কালচারের সাথে সংযোগহীন গ্রিনিচ সময়কে মান সময় হিসেবে গ্রহণ করানো হয়েছে, তা হতে পারে, ভাবদাস্যতা তৈরির খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যায়। আমার মনে হয়েছিল, শিল্পী যেহেতু, map বা cartograph না বলে, Atlas বলছেন—যার অর্থ প্রায় কখনোই শুধু একটি মানচিত্র নয় বরং একাধিক মানচিত্রের সংগ্রহ—তখন তিনি নিশ্চয়ই ঔপনিবেশিকতার সবগুলো সাইট (site) বা একাধিক সাইটকে প্রশ্ন ও তদন্ত করবেন। 

তার পরই দেখলাম, Atlas of Dissent-এর অনুবাদ করা হয়েছে, ‘অসম্মতির মানচিত্র।’ 

এই অনুবাদ কি শিল্পী অনুমোদিত? Atlas যেমন একটিই মানচিত্র নয় তেমনি Dissent কি শুধুই অসম্মতি, নাকি ভিন্নমতও বা কখনো এবং বেশির ভাগ সময় শুধুই ভিন্নমত? যাক, আমি ইংরেজির মাস্টারমশাই নই। কিন্তু Atlas of Dissent-এর অনুবাদে বা ভিন্ন বাংলা নামে যে অর্থ ও অর্থবিষয়ক সংস্কারের প্রতিসরণ হলো, তাতে কি দর্শকরা কোন নূতন পথনির্দেশ পেলেন, শিল্পীর উদ্দেশ্য ও অভিজ্ঞানের? শিল্পী যে দিশায় আমাদের নিতে চাচ্ছেন সেই অভিমুখের? কোন নূতন বৈশিষ্ট্য বা তাৎপর্য যোগ হলো? আমার মনটা ভরে গেল অস্বস্তিতে। 

দর্শকের আরেকটা স্বস্তিনাশক হবে বারবার মাথা তোলা একটি প্রশ্ন: Atlas of Dissent কি আসলেই আলাদা আলাদা ড্রয়িং, পেইন্টিং, ইনস্টলেশন ইত্যাদির সন্নিবেশে ঘনিয়ে ওঠা একটি ভার্নিসাজ বা প্রদর্শনী, না, Atlas of Dissent পুরো ঘটনাটি একটিই ইনস্টলেশন?

এই যে প্রশ্ন প্রাণিত হলো, তাকে ঘিরে দুই-একটা কথা বলতে চাই: এক. Atlas of Dissent-এ শিল্পী যতটা বস্তুগত, ততটাই আত্মগত। তিনি Atlas of Dissent-এর ভাববিগ্রহের সাথে সংঘর্ষে যাচ্ছেন; বিভিন্ন অবজেক্ট-এর ওপর ভর করে, একটিই প্রশ্ন করছেন; বারবার করছেন; একটিই প্রশ্ন কয়েকভাবে করছেন। 

কখনো স্বগতোক্তি করছেন; নিজের সাথে নিজের একটি আলাপ, অন্তর্লীনভাবে, Atlas of Dissent-এর প্রতিটি শিল্পসামগ্রীকে আলতোভাবে মুড়ে আছে; প্রতিটি শিল্পসামগ্রীকে দৃঢ়ভাবে জুড়ে রেখেছে; প্রায় প্রতিটি শিল্পসামগ্রী আবার একে অপরের সাথে সংলাপ করছে, কখনো মৃদু ঝগড়া করছে; কোনো শিল্পসামগ্রী একটু ইনকোনগ্রুয়াস,—কনভার্সেশনে নাই।

দুই. কিন্তু ঢালী আল মামুনের প্রশ্ন করার ভাষা কী? তাঁর আলাপকে আন্ডারলাইন করে কোন জ্ঞানকাণ্ড? ইউরোপীয় আলোকায়ন ও বুদ্ধিবাদের যে ধারা থেকে আধুনিকতা, আধুনিকতাবাদ ইত্যাদির জন্ম হয়েছে, আমাদের মনে রাখতে হবে, সেই ধারাই ঔপনিবেশিকতার উদ্গাতা; আলোকায়নের জ্ঞানকাণ্ড মূল যে জ্ঞানতাত্ত্বিক অপারেশন সম্পাদন করে তা হচ্ছে ঔপনিবেশিকতাকে আলম্বন করা ও কায়েম রাখা। আলোকায়নের জ্ঞানকাণ্ডের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হচ্ছে নিজেকে সমালোচনা ও আক্রমণ করার জন্য স্পেসও নিজের কাণ্ডের একটি শাখায় ধারণ করা। 

Atlas of Dissent-ও আধুনিকতার দৌত্যে, আলোকায়নের জ্ঞানকাণ্ডে বেড়ে ওঠা নন্দনে শেকড় রেখেই শুধু নয়, পশ্চিমের গেইজ (Gaze )-এ দেখা ইতিহাসের পটভূমিতে, প্রশ্ন করে। 

কিন্তু এমনই কি নয় আধুনিক শিক্ষিত যেকোনো শিল্পীর ভবিতব্য?

এমনই কি নয় যেকোনো শিক্ষিত মানুষের "ইতিহাসের পুনঃপাঠের একমাত্র খোলা পথ? ইদানীন্তনীন "আর্ট-এ এই ক্লিশেই তো ভূরি ভূরি নজরে আসে, তাই না?

পল্লবগ্রাহিতার কোনো তনুমধ্য উপরিতল থেকে তেমন মনে হতেই পারে, কিন্তু, এই প্রবণতার বিপরীতে হওয়া আফ্রিকা বা দূর-পূর্বের বিপুল কর্মযজ্ঞের উদাহরণ না টেনেও বলা যায়,

যে কঠিন প্রশ্নগুলো ঢালী আল মামুন করতে চাচ্ছেন, সেই প্রশ্নগুলোর ওপর ভর করে, আলোকায়নের জ্ঞানকাণ্ডের বাইরে এসে, গভীর তদন্তের দীর্ঘ পশ্চাৎপট রয়েছে, আমাদের মাটিতেই। 

সে সম্পর্কে দ্রুত কিছু বলার আগে, আরেকবার ইটিরেট করি, এই প্রদর্শনীর সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, Atlas of Dissent উন্মুক্ত করে, আমাদের এই মুহূর্তের পোস্ট-কলোনিয়াল চিন্তার একটি প্রধান প্রবণতা: ঢালী আল মামুন শুধুই ইউরোপীয় জ্ঞানকাণ্ডস্বীকৃত সমালোচনা বা প্রশ্নকেই—এটাকে আমরা খুব জেনোরিসিটির সাথে তাঁর "অসম্মতি" বা "ভিন্নমত" বলে কবুল করছি—পরিবেশনার নানা উপাচারে বিনিয়োজিত করেন। 

এখন, শিল্প-চিন্তার, শিল্প-গবেষণার এবং বিশেষ করে ইতিহাস অবিনির্মাণের ও বিউপনিবেশকরণের উদাহরণ হিসেবে প্রশ্ন ওঠে,—নিম্নবর্গ, অন্তজ বা দলিতরা, ঔপনিবেশিকতা নিয়ে, কি ইউরোপ-অভিন্ন মতই দেন? জ্যোতি বা ফুলে, আম্বেদকর-গান্ধী বিতর্ক, পেরিয়ার এবং দ্রাবিড় আন্দোলন থেকে মণ্ডল কমিশনোত্তর নানা দিকবদল থেকে আমাদের কিছুই শিখবার নেই? এমনকি গত শতাব্দীর ছয় এবং সাতের দশকে এই উপমহাদেশের শিল্পের সংগ্রামী চিন্তা ও কৃতির কি প্রচণ্ড দিকবদল হচ্ছে মহারাষ্ট্রে দলিত প্যান্থারস এবং কর্ণাটকে ‘‌দলিত সংঘর্ষ সমিতি’ ইত্যাদির কর্মকাণ্ডে, প্রচণ্ডভাবে হয়েছে নন-ক্যানোনিকাল স্বতন্ত্র ইতিহাসের খোঁজ—যেমন তেলুগু দলিত গবেষকদের গুরাজাদা আপ্পারাওদের মতো অনেককে এক্ষেত্রে স্মরণে আনি—এসবের কোনো আসর আমাদের বিউপনিবেশকরণের মাসায়েল-মাসআলায় অনুভূত হবে না, এখনো?

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে রাখা যে ভারতবর্ষে, ও বিশেষত বাংলায়, উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন ও ঔপনিবেশিক ভাবদাস্যতা ভাঙার মূল ভরকেন্দ্র ছিল ভিন্নমত প্রকাশের বাহন—সংবাদপত্র। আলীমুল্লাহ সম্পাদিত ‍‘সমাচার সভারাজেন্দ্র’, রজব আলী সম্পাদিত ‘জগদুদ্দীপক ভাস্কর’ কিংবা সৈয়দ আবদুর রহিম সম্পাদিত ‘বালারঞ্জিকা’, মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত ‘আজিজন নেহার’, ‘মোহাম্মদী আখবার’ ও আনিসউদ্দীন আহাম্মদ সম্পাদিত ‘পারিলবার্ত্তাবহ’ তো বের হচ্ছিলই, কিন্তু প্যারিস থেকে জামাল উদ্দিন আফগানীর বাংলা আগমন, তার ওজস্বী বক্তৃতা ও বিপ্লবী ভাবধারা বাংলার উপনিবেশবিরোধী সনাতনপন্থীদের সাথে জিহাদপন্থী ও ফরায়েজিদের সমঝোতার ক্ষেত্র রচনা করে। জামাল উদ্দিন আফগানী ও মিসরীয় মোহাম্মদ আবদুহু যৌথভাবে প্যারিস থেকে ‘আল উরওয়াতুল উসকা’ নামধেয় একটি পত্রিকা বের করতেন, যা ভারতবর্ষের মুসলিম সমাজকে অচিরেই এমন অনেক পত্রিকা বের করতে উদ্বুদ্ধ করে যেগুলার কাটতি তুর্কি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। 

ছবি: সালাউদ্দিন পলাশ

মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি, মাদ্রাসা লিটারারি অ্যান্ড ডিবেটিং ক্লাব, ১৮৭৮ ঈসায়ীর, ১২ মে, সৈয়দ আমীর আলী ও সৈয়দ আমীর হোসেনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন’, ঢাকা মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দীর ‘সমাজ সম্মিলনী সভা’ ও ঢাকা, হুগলী ও চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে যে আলোকিত আলেমরা গণজাগরণের নিয়ত বুকে নিয়ে, বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিলেন, তাঁরাই সংবাদপত্র/পামফ্লেটকে বা তীব্র উপনিবেশবিরোধী অসম্মতি ও ভিন্নমতকে উইপনাইজড করেন। এসব কিছুর প্রতিসর্জন, উল্লিখন না করে বা পূর্বসূত্র না রেখে কীভাবে হতে পারে এই অঞ্চলে উপনিবেশ, উপনিবেশবিরোধিতা বা Dissent-সংক্রান্ত জ্ঞানবোধিনী তত্ত্বপ্রস্থান, তত্ত্বপ্রস্থানের পাঠ, বিশ্লেষণ ও তথ্যের সংস্থান, সংশ্লেষ, নূতন ধরনের ইতিহাস ব্যবহার বা শিল্পের উদ্বোধন—তা আমার বোধগম্যতার অত্যন্ত অতীত। 

তাছাড়া এ রকম প্রদর্শনীতে কিউরেটর ও শিল্পীর গবেষণা ও যৌথতার প্রশ্ন আসে। 

শিল্পীর ভাষাকে বিস্তৃত করা বা যুগপৎ দ্বান্দ্বিকতা ও নূতন অর্থ উৎপাদনের সম্পর্কে আনা সম্ভব—প্রদর্শনী-কিউরেটিং-এর ভাষার সুপ্রযুক্ত প্রয়োগে; শিল্পীর প্রশ্ন ও আলাপকে তাত্ত্বিকতায়, অসংসৃষ্টি ও অনুভূতির অস্ত্রানিনিতে তলব করে। 

আমার ধারণা, Atlas of Dissent-এর সমূহ সম্ভাবনা ছিল এই পথে অগ্রসৃত হবার। 

Atlas of Dissent-এর কেন্দ্রে স্থাপিত, রেললাইনে হাইব্রিড জানোয়ার খচিত, ক্রূর, শীতল ক্রোধ ও আইরোনির দ্যোতক শিল্পকর্মটি একদিকে যেমন কোম্পানি শাসন আর মহারানীর শাসনের আলাদা উপসর্গ ডিপ্লয় করতে পারত, একইভাবে সম্ভব ছিল Dissent-এর প্রতীচীন কণ্ঠের বাইরের বিরুদ্ধ স্বর এই কাজটিকে ঘিরে, এক সূত্রে, বুনে তোলা। এই বুননের রঙ ও রূপ Atlas of Dissent-এই টুকরো টুকরোভাবে স্পষ্ট, কিন্তু, অনাম্নী হয়ে আছে: এই বুননের রং ও রূপকে এক কথায়, এনথ্রোপোসিন-এর সূত্রে একতাবদ্ধ করা সম্ভবপর ছিল। 

আমাদের ভুল ধারণা আছে যে তত্ত্ব প্রেস্ক্রিপটিভ; তত্ত্ব প্রেসক্রিপশন দেয় আর্ট বা কালচারের সৃষ্টি কেমন হবে বা হওয়া উচিত এই ব্যাপারে—একেবারেই ভুল কথা;

সত্য বরং উল্টো: তত্ত্ব জীবন ও জীবন্ত কৃতি বুঝতে সাহায্য করে। বিশেষত ঔপনিবেশিকতা যে জ্ঞানকে মুছে ফেলেছে, পুঁজি যে জীবনকে ইরেজার-এর নিচে রেখে অদৃশ্য করেছে, তাকে দৃশ্যমান করে গ্রেফতার করতেই তত্ত্বের আবির্ভাব হতে পারে। 

পরন্তু, ঢালী আল মামুন তাঁর অঙ্কনের অনাদর্শায়িত শরীর, সাহেবদের উর্দি, কোম্পানির লোগো বসানো ডেমিয়েন হার্স্ট-এর খুলি, নৃত্যপর তালপাতার সেপাই, ইত্যাদি ইত্যাদি কাজ ও অনন্যসাধারণ রেললাইন + হাইব্রিড জানোয়ারের কেন্দ্রীয় স্থাপনায়, যে ‘‌অবদমিতের জ্ঞান’ বা মিশেল ফুকো কথিত সাবজুগেটেড নলেজ পুরে দিয়ে বিস্তৃত ও বিচ্ছিন্ন অনেকানেক ক্ষেত্রসমীক্ষা উন্মুক্ত করেছেন, প্রাণ ও প্রকৃতির ওপর ঔপনিবেশিক পুঁজির দাপটের যে হালনাগাদ আলাপটি ঢালী আল মামুন করতে চাচ্ছেন, আমার ধারণা, তাদের একসূত্রে আনতে সমর্থ হওয়া শুধু নয়, তাদের সবচেয়ে জরুরি সূচিমুখটি, আমাদের এই সময়ে, এনথ্রোপোসিন-এর প্রেক্ষণীতেই বের হয়ে আসা সম্ভব।

সম্পাদক-নির্দিষ্ট শব্দসীমা পার হয়ে গিয়েছে, তার পরেও বলছি, এ রকম জরুরি একটি প্রদর্শনীর গ্রন্থনা বা গৃহায়ণে, বেঙ্গল শিল্পালয় কর্তৃপক্ষ আরেকটু যত্নবান কি হতে পারতেন না?

কিউরেটিং-সংক্রান্ত অব্যবস্থাপনা, অ্যানিমেশনগুলোর উৎকেন্দ্রিক সংস্থান ও দৃশ্যমানতা বা কক্ষের বীভৎস আলোকায়ন নিয়ে কিছু না বললাম; কিন্তু বাঁধানো ছবিগুলোতে উন্নত মিউজিয়াম-গ্রেড গ্লাস নেই কেন? আর্ট হ্যান্ডলাররা কেন ব্যবহার করেন না উপযুক্ত হাতমোজা?...যাক, এত ছোট ছোট কথা বলতেও লজ্জা লাগে। 

ড. এবাদুর রহমান, কালচারাল থিওরিস্ট, কিউরেটর ও ফিল্মমেকার। তাঁর গবেষণার বিষয় মিডিয়া আর্কিওলজি, আর্ট হিস্টোরি এবং সিনেমা স্টাডিজ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন