বিষাদে বিকারে ভ্যান গঘ

আহমেদ দীন রুমি

সন্ধ্যা নামে। অথচ চিহ্ন নেই তার। দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরে সবাইকে। উৎকণ্ঠা মিথ্যা হয় না। তিনি ফেরেন পেটে হাত দিয়ে। ক্লান্ত শরীরটা কোনো রকমে টেনে হাঁটছেন। জানতে চাওয়া হয় কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা।না বাচক জবাব দেন। দ্রুত চলে যান রুমে। পেছনে অনুসরণ করলে তাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখা যায়। ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। বুকের বামপাশে নিচের দিকে ভয়ানক ক্ষত। স্বীকার করেন নিজেই নিজেকে গুলি করার কথা। ডাক্তার ডাকা হয়। কিন্তু আটকে রাখা যায়নি। দুদিনের মাথায় পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। এভাবে একরাশ রহস্য রেখে চলে গেলেন ভ্যান গঘ। ভিনসেন্ট ওয়েলহেম ভ্যান গঘ। আত্মহত্যা করলেন আর্টের ইতিহাসে উজ্জ্বল তারাদের একটি। অবশ্য আত্মহত্যা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তার সূত্র দেখা যায় ঠিক আগের বছর। ১৮৮৯ সালের জানুয়ারিতে হাসপাতাল থেকে ফেরেন মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে। নিজের কান কেউ নিজে কাটে না। অথচ তিনি কেটে ফেলেছেন বাম কানটা। সে অবস্থাতেই আঁকেন অদ্ভুত এক চিত্রকর্ম। একটা কাঠের টেবিলে রাখা মেডিকেল বই, মোম আর চারটি পেঁয়াজ। পেঁয়াজগুলো শুকিয়ে চুপসে গেছে। তবু গজিয়ে উঠতে থাকা সরু পাতায় জীবনের চিহ্ন। চিত্রকর্মের নামস্টিল লাইফ পেঁয়াজগুলো যেন ভ্যান গঘেরই প্রতিকৃতি। তার মতো করেই মরতে মরতে বেঁচে রয়েছে। রহস্যময় মানুষটার জন্ম ১৮৫৩ সালের ৩০ মার্চ। দক্ষিণ নেদারল্যান্ডসের নর্থ ব্রাবান্টে। শিল্পের সঙ্গে কয়েক পুরুষ ধরে সম্পর্ক। হয়তো আর্টের ডিলার হিসেবেই দেখতে চেয়েছে পরিবার। কিন্তু ভ্যান গঘ বেড়ে উঠলেন অন্তর্মুখী হিসেবে। ঘরে মা আর গভর্নেসের কাছে পড়াশোনায় হাতেখড়ি। ১৮৬০ সালে গ্রামের স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা। কিন্তু সৃষ্টিশীল মানুষের এক অসুখ। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা মনে ধরে না। ১৮৬৪ সালে বোর্ডিংয়ে দেয়া হলে তা প্রমাণিত হয় আরো একবার। চলতে থাকে নিঃসঙ্গতার সঙ্গে বসবাস। চাইলেও ঘরে ফেরা হয় না। বছর দুই পরে দেয়া হয় মিডল স্কুলে। কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিলেন বোধ হয়। ১৮৬৯ সালে আর্ট ডিলারের পেশায় নেমে চলে যান লন্ডনে। বেশ পয়সাকড়িও কামান তখন। খুব দ্রুত সে পেশায় ইস্তফা দিতে হয়। বড় রকমের ধাক্কা আসে তরুণী ইউজিনের কাছ থেকে। ভালোবাসাটা একপক্ষীয় ছিল তার। তারপর আর কী করেননি! শিক্ষকতা, চার্চ পরিদর্শকের সহকারী, বইয়ের দোকানি কিংবা পুরোদস্তুর ধার্মিক। কোনোটাই সন্তুষ্ট করতে পারেনি তার তৃষ্ণার্ত মনকে। একটু স্থিরতা চেয়েছিলেন খালাতো বোন করনেলিয়া কিংবা মদ্যপ পতিতা মারিয়ার কাছে। প্রথমজন তাকে প্রত্যাখ্যান করে, দ্বিতীয়জন করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা। যেখানেই যাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছেন, তার সামনেই তৈরি হয়েছে বাধা। মানসিক অস্থিরতা প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনাকেও ব্যর্থ করেছে বারবার। ক্রমে দূরত্ব তৈরি হয়েছে চারপাশের সঙ্গে।

শিল্পী হিসেবে তার ক্যারিয়ার মাত্র ১০ বছর, ১৮৮০-৯০ সাল পর্যন্ত। ১৮৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে নুয়েনেনে ফিরে পোক্তভাবে শুরু হয় আঁকাআঁকি। প্রায় ২০০ চিত্রকর্ম উপহার দিয়েছেন সময়েই। তখনো সময় নিজেকে তৈরি করার। জীবনের শেষ তিন বছরই মূলত স্বর্ণসময়। সংক্ষিপ্ত সময়ের সৃষ্টিকর্ম অনেক শিল্পীর সারা জীবনের কর্মকে ছাপিয়ে গেছে। কল্পনার নিজস্বতা চিত্রণে অভিনবত্ব তাকে নিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। সময়েই আঁকেন ওয়ার্ন আউট, স্কাল অব স্কেলেটন উইথ বার্নিং সিগারেট স্টিল লাইফ উইথ ওপেন বাইবেল। রঙের আতিশয্য না থাকলেও দৃশ্যমান হয় স্বাতন্ত্র্যের ঝোঁক। ১৮৮৫ সালে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান বাবা। পরের বছরই প্যারিসে গিয়ে ভাই থিয়োর কাছে থাকতে শুরু করেন তিনি। চার বছরের ছোট ভাই থিয়ো আর্টের ডিলার। বাট্রেস হয়ে ছিলেন অস্থিরচিত্ত ভাইয়ের জীবনে। প্যারিস থাকার সময় পরিবর্তন আসে ভ্যান গঘের চিত্রকর্মে। ভিউ ফ্রম ভিনসেন্ট স্টুডিও, পোর্ট্রেট অব পেরে টাঙুই, ইন দ্য ক্যাফে মন্তমার্ত্রে তাদের মধ্যে তার উদাহরণ। তবে শিল্পী সত্তার পরিণত রূপ প্রকাশিত হয় দক্ষিণ ফ্রান্সের আর্লে। মাত্র ১২ মাস সেখানে অবস্থান করেন ভ্যান গঘ। সে সময়েই অবিশ্বাস্য ১৮৭টি চিত্রকর্ম বেরিয়ে আসে তার হাত থেকে। এর মধ্যে দ্য সাওয়ার উইথ সেটিং সানও রয়েছে। ভ্যান গঘ কিন্তু ক্রমেই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছিলেন নিজের ওপর। ফরাসি চিত্রকর গঁগার সঙ্গে সাময়িক বন্ধুত্ব হলেও টেকেনি। সময়েই ঘটে সে কানকাণ্ড। ক্রমে তাকে দখল করে নিতে থাকে হ্যালুসিনেশন। যে মানসিক জটিলতা তাকে আত্মবিধ্বংসী পথে ঠেলে দিয়েছে, সে অস্থিরতাতেই স্থাপিত হয়েছে সৃষ্টিশীলতা। সেখান থেকে অনুপ্রেরণা এসেছে অদ্ভুত সব রঙের ব্যবহারে। একদিকে প্রকৃতি ছিল তার চিত্রের মুখ্য বিষয়। আকাশকে পেছনে রেখে ফুলে ভরা গাছ, সূর্যের আলো কিংবা মেঘেদের ছোটাছুটি অদ্ভুত রঙের মিশেলে আঁকতেন ক্যানভাসে। ঈষৎ মেটে হলুদ, নীল লালচে বেগুনির মূর্ছনায় একাকার ক্যানভাসের আসমান জমিন। তার প্রমাণ অরচার্ড ইন ব্লসম উইথ টু ফিগার্স, দ্য পার্সোনেজ গার্ডেন এট নুয়েনেন ইন স্প্রিং, ফিসিং ইন স্প্রিং হোয়াইট অরচার্ড। অন্যদিকে তুলে আনতেন ব্যক্তি সত্তার নিঃসঙ্গতা হতাশা। এট এটার্নিটি গেট, পিজনার্স রাউন্ড আর সেলফ পোর্ট্রেটগুলোই তার সেরা উদাহরণ। ১৮৯০ সালের ২৭ জুলাই পেটে গুলি নিয়ে ফেরেন ভ্যান গঘ। মৃত্যুবরণ করেন দুদিন পরেই। ঠোঁটে উচ্চারিত শেষ কথা ছিল, ‘এসব বেদনারা রবে চিরকাল। তার বেদনা আদতেই কেউ বোঝেনি। কিন্তু তিনি অমরত্ব নিশ্চিত করে ফেলেছেন সৃষ্টিকর্মে। ২০ শতকের আভাঁগার্দ শিল্প আন্দোলনের ভিত তৈরি হয়েছে তার মাধ্যমে। তারদ্য স্টারি নাইট দিকনির্দেশনা দিয়েছে উত্তর প্রজন্মের শিল্পীদের মনে মগজে। তাকে সম্মান দেখিয়ে মাতৃভূমিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ভ্যান গঘ মিউজিয়াম।

(নিবন্ধটি ৩০ মার্চ ভ্যান গঘের জন্মদিন উপলক্ষে লেখা। ওপরের ছবির শিরোনাম: সেলফ  পোর্ট্রেইট -, ভ্যাগ গঘ মিউজিয়াম)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন