বিশ্লেষণ

অতিরিক্ত পুঁজিবাদী মনোভাব খাদ্য সংকটকে ত্বরান্বিত করছে

ড. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া

এসডিজি বা টেকসই উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করা। খাদ্যদ্রবের মজুদ, সরবরাহ ও চাহিদার হিসাব আমলে নিলে সে লক্ষ্য অর্জন অধরাই থেকে যাবে বলে আপাতত মনে হচ্ছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, দুর্ভিক্ষ থেকে মাত্র এক ধাপ দূরে রয়েছে এমন লোকের সংখ্যা ২০১৯ সালে ছিল ১৩ দশমিক ৫০ কোটি, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ দশমিক ৫ কোটিতে।

বিশ্বের প্রায় ৮৩ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত্রি যাপন করে এবং প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের কিনারায় অবস্থান করছে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা, অর্থাৎ যারা খাদ্যের পরিমাণ বা গুণমানের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হয়েছে, বর্তমানে তাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩৮ কোটিতে।

তবে খাদ্য সংকটের তীব্রতা পৃথিবীর সব প্রান্তে এক নয়। দরিদ্র ও সংঘাতপীড়িত অঞ্চলগুলোতে খাদ্য সংকটের ভয়াবহতা অনেক বেশি। আসছে দিনগুলোতেও এসব অঞ্চলে খাদ্য ঘাটতি তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত দেশগুলো রয়েছে। যেমন আফগানিস্তান, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া ও ইয়েমেন সবচেয়ে বেশি খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এ দেশগুলোর প্রায় ১০ লাখ লোক অতিমাত্রায় ক্ষুধার সম্মুখীন। এছাড়া কঙ্গো, হাইতি, কেনিয়ার খাদ্য সংকট ক্রমেই অবনতিশীল এবং তাদের অবস্থাও উদ্বেগজনক।

যদিও সাম্প্রতিক খাদ্য সংকটের জন্য প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট অনেক কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে, যেমন জলবায়ুর পরিবর্তন, জাতিগত সংঘাত এবং কভিড-পরবর্তী বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, পুঁজিবাদের ক্রমবর্ধমান উত্থান খাদ্য সংকটকে আরো প্রকট করে তুলছে। কৃষি উপকরণের ওপর পুঁজিপতিদের একচ্ছত্র অধিপত্য, খাদ্যশস্য উৎপাদন এবং বণ্টনে পুঁজিবাদের লোভনীয় থাবা বিশ্বের খাদ্য সংকটকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলছে।

কৃষির করপোরেটাইজেশনের শুরুটা ১৯৬০-এর দশক থেকে। তথাকথিত ‘‌সবুজ বিপ্লব’ নামে মুনাফাভোগী পুঁজিবাদী করপোরেট প্রতিষ্ঠান কৃষির ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। ইউএস এইড এবং ফোর্ড ফাউন্ডেশন মিলে ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সবুজ বিপ্লবের শুরু করে কৃষিতে রাসায়নিকের ব্যবহার এবং নিবিড় শস্য প্রজনন বিস্তারের মাধ্যমে। সার, কীটনাশক এবং প্রচুর ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্চফলনশীল জাতের হাইব্রিড শস্যের আবাদের প্রতি জোর দেয়া হয়। এ উচ্চফলনশীল ফসলের জন্য অনেক বেশি পানির প্রয়োজন। খাল, বিল, জলাশয়ে একসময় সঞ্চিত পানির পরিমাণ ছিল বেশি। তাই হাইব্রিড শস্যের উৎপাদনও ছিল আশানুরূপ। জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তন, কৃষিজমির ওপর বাড়তি জনসংখ্যার চাপ, প্রাকৃতিকভাবে সঞ্চিত পানির উৎসের হ্রাস উচ্চফলনশীল শস্যের উৎপাদন ব্যাহত করে অনেকটাই। শুরুতে সমবায় সমিতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গভীর ও অগভীর নলকূপের সাহায্যে সেচের ব্যবস্থা করলেও এসব নলকূপের মালিকানা একসময় চলে যায় সমাজের পুঁজিপতিদের মতো মহাজন-শ্রেণীর লোকের হাতে। প্রান্তিক চাষী পুঁজিপতিদের মাধ্যমে শোষণের শিকার হয়।

অন্যদিকে বড় আকারের কৃষি কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে ‘সম্পদের সদ্ব্যবহার’ নীতি কৃষিকে ব্যয়বহুল করে তোলে। ছোট কৃষক, যাদের প্রয়োজনীয় মূলধন নেই, ক্রমেই ঝুঁকতে থাকেন ঋণের দিকে।

যেহেতু মূলধারার লগ্নি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণের প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করতে অধিকাংশ কৃষকই অপারগ, তারা মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে কৃষিকাজে বিনিয়োগ করে। ফলে কৃষিকাজের ব্যয় বেড়ে যায় অনেক গুণ। অন্যদিকে ফড়িয়া বা আড়তদার হিসেবে এক ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী পুঁজিপতিদের উত্থান হয় সমাজে যারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ফসলের দামকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ দুইয়ের দুষ্টচক্রে ছোট আকারের কৃষি কার্যক্রম লোকসানে মুখ থুবড়ে পড়ে।

অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো সরকারি প্রচেষ্টায় ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষিকে প্রত্যক্ষ সহায়তা করেছিল গত শতকের শেষ দশক পর্যন্ত। কিন্তু মুনাফালোভী করপোরেট প্রতিষ্ঠান সেই বন্দোবস্তকে ক্রমেই বিলুপ্ত করছে। বহুজাতিক উন্নয়ন সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মাধ্যমে পুঁজিপতিরা কৃষিতে রাষ্ট্রীয় সহায়তা তুলে নিতে দরিদ্র দেশগুলোকে একরকম বাধ্য করে। এসব সংস্থার চাপিয়ে দেয়া বিভিন্ন নীতির প্রধান লক্ষ্যই ছিল কৃষির ভর্তুকি এবং অন্যান্য সহায়তার অবসায়ন। বিশেষ করে ১৯৭৯ সালের ‘অয়েল শক’-পরবর্তী সময়ে লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে ঋণ সংকট দেখা দিলে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রবর্তিত কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি বা ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’-এর আওতায় দরিদ্র দেশগুলোকে পাবলিক সেক্টর বেসরকারীকরণ এবং কল্যাণ সহায়তা কমাতে বাধ্য করে। ঋণের দায়ে জর্জরিত কৃষক নগদ আয় বাড়ানোর নিমিত্তে দেশজ ফসলের উৎপাদন বাদ দিয়ে অর্থকরী ফসল উৎপাদনে উৎসাহী হয়। ফলস্বরূপ ফসলের বৈচিত্র্য এবং খাদ্য উৎপাদনের ভারসাম্যতা নষ্ট হয়। কৃষকের খাদ্যের সুরক্ষা হয়ে ওঠে আরো ঝুঁকিপূর্ণ।

অন্যদিকে কৃষিতে বড় কোম্পানির আধিপত্য বাড়তে থাকে ক্রমবর্ধমান হারে। হাল আমলের প্রযুক্তি যেমন বিগ ডাটা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অল্প সংখ্যক বড় কোম্পানি বৈশ্বিক খাদ্যশৃঙ্খলে আধিপত্য বিস্তার করেছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক বীজ বাজারের ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে দুটি কোম্পানি, ২৫ বছর আগেও এ বাজার ছিল ১০টি কোম্পানির দখলে।

বীজের ওপর ‘সম্পদের অধিকার’ প্রতিষ্ঠার নামে কোম্পানিগুলো ‘জেনেটিক্যালি মডিফায়েড’ বা বীজের জিনগত রূপান্তর করে বীজগুলো বাজারে ছাড়ছে। এ বীজ সংগ্রহ করে পরের বছর ব্যবহার করা যায় না। অর্থাৎ প্রতি বছরই কৃষককে নতুন করে বীজ কিনে চাষ করতে হবে। এ ধারা চলতে থাকলে বীজের নিয়ন্ত্রণ সহসাই চলে যাবে বহুজাতিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের হাতে।

কৃষিপণ্যের ব্যবসাও একইভাবে কেন্দ্রীভূত। ২০২০ সালের হিসাব মতে, অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের কৃষিপণ্যের বাজার কুক্ষিগত রয়েছে ১০ প্রতিষ্ঠানের হাতে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘‌কারগিল’ এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ কৃষিপণ্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, ২০২০ সালে যার বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার। তার পরই রয়েছে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ‘‌কফকো’, যার বার্ষিক বিক্রয় ছিল ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। অনুরূপভাবে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ‘‌সিনজেনটা’ কৃষি রাসায়নিকের বৈশ্বিক বাজারের প্রায় এক-চতুর্থাংশ একাই নিয়ন্ত্রণ করে।

আক্ষরিক অর্থে বিশ্বে খাদ্য সংকট বিরাজ করলেও বর্তমান খাদ্য ঘাটতি উৎপাদনস্বল্পতা নয় বরং ক্রয়ক্ষমতার সংকট। বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট যত প্রকট, খাদ্যের মজুদ তত কম নয়। খাদ্যদ্রব্যের বাণিজ্যিক সরবরাহ এবং বণ্টন গুটি কয়েক কোম্পানির হাতে কুক্ষিগত। খাদ্যের মূল্যের ওপর তাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে তাদের কাছে কতটা শস্য আছে সেই তথ্য সঠিক সময়ে পাওয়া যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবে। এছাড়া সময়মতো স্টক ছেড়ে দিতে বাধ্য করার রাজনৈতিক এবং সামাজিক কোনো সমঝোতা নেই রাষ্ট্রীয় এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। এসব বাণিজ্যিক এবং ভাড়াটিয়া শ্রেণীর (রেন্টিয়ার ক্লাস) উত্থান, যারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানবিক দুর্বলতাকে পুঁজি করে অতিরিক্ত মুনাফা করে, তা বিশ্বব্যাপী চলমান খাদ্য সংকটে আরেকটি মাত্রা যোগ করেছে। চারটি বহুজাতিক কোম্পানি আর্চার-ড্যানিয়েলস-মিডল্যান্ড, বুঞ্জ, কারগিল এবং লুই ড্রেফাস, যা সম্মিলিতভাবে ABCD নামে পরিচিত, বিশ্বব্যাপী শস্য বাণিজ্যের ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। কভিডের সময়ও এ চার কোম্পানি রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করেছে। খাদ্যপণ্য সরবরাহকারী জায়ান্টরা এমন একটি সময়ে অভাবনীয় মুনাফা করছে যখন বিশ্বের জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ চরম ক্ষুধায় দিনাতিপাত করছে, যদিও এ কোম্পানিগুলোর উচিত ছিল করোনা-পরবর্তী ক্ষুধার সংকট রোধ করে এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

পৃথিবী নামক আমাদের এ গ্রহে ৭৯০ কোটি মানুষের বসবাস। ২০৫০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে আনুমানিক ৯৭০ কোটিতে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং। আর তাই খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য প্রকৃতির ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা সমীচীন হবে না। কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং প্রয়োজনীয় রাসায়নিকের ব্যবহার, উন্নত অবকাঠামো এবং পরিবহন ব্যবস্থার সাহায্যে খাদ্য সংগ্রহ, মজুদ, সরবরাহ এবং বণ্টন খাদ্যের নিরাপত্তাকে ত্বরান্বিত করবে। কিন্তু খাদ্যশস্য উৎপাদন থেকে শুরু করে কৃষি উপকরণের সর্বস্তরে বেনিয়াদের একক আধিপত্য খাদ্যনিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করবে। পুঁজিপতিদের অতি বস্তুবাদী মনোভাব এবং অতিরিক্ত মুনাফার আকাঙ্ক্ষা বিশ্বের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে এক চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে।

প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্বলতার অজুহাতে খাদ্যশস্যের মজুদ এবং অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধিসহ অনৈতিক/অমানবিক কার্যকলাপ বন্ধ না হলে চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত উৎপাদন খাদ্যনিরাপত্তা বৃদ্ধি করবে না। সুতরাং খাদ্য সংকট এড়াতে অর্থনৈতিক জীবনের সব ক্ষেত্রে নৈতিক অনুশীলন জরুরি। মানুষের অসহায়তার অজুহাতে অযৌক্তিক মুনাফা করে এমন কোম্পানিগুলোকে উচ্চ করের আওতায় আনা যেতে পারে। আর এ কর থেকে প্রাপ্ত অর্থ টেকসই খাদ্য ব্যবস্থা তৈরি করতে সাহায্য করে এমন সব কাজে ব্যয় করা যেতে পারে। যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা খাদ্যনিরাপত্তায় কাজ করে যাচ্ছে, যেমন ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন, সেসব প্রতিষ্ঠানে এ কর থেকে প্রাপ্ত অর্থ অনুদান হিসেবে দিলে প্রান্তিক মানুষের খাদ্যের নিশ্চয়তা বাড়বে।

ড. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া: সহযোগী অধ্যাপক, নিজওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ওমান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন