পর্যালোচনা

অর্থমন্ত্রী কি রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে গেলেন?

ড. মইনুল ইসলাম

গত ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর শীর্ষ ২০ জন ঋণখেলাপির নামের তালিকা প্রকাশ করেছেন। নামগুলো গত ২৫ জানুয়ারি দেশের সব পত্রপত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে। এ ২০ জন শীর্ষ ঋণখেলাপিকে প্রদত্ত মোট ঋণের পরিমাণ ১৯,২৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, যার মধ্যে ১৬,৫৮৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ। সংসদে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে মোট ৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫ জন ঋণখেলাপি রয়েছেন। শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির এক নম্বরে থাকা প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ১,৬৪০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা আর ২০ নম্বরের খেলাপি ঋণ ৫৪১ কোটি ২০ লাখ টাকা। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহল সঙ্গে সঙ্গে এ তালিকা প্রত্যাখ্যান করে অভিযোগ তুলেছে, অর্থমন্ত্রীর তালিকায় বাংলাদেশের ‘রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি’ হিসেবে কুখ্যাত একজনের নামও খুঁজে পাওয়া যায়নি। গত ২৫ জানুয়ারি দেশের ইংরেজি দৈনিক দি ডেইলি স্টার প্রথম পৃষ্ঠার হেডলাইন করেছে, ‘নিয়মিতভাবে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া কুখ্যাত ঋণখেলাপিদের তালিকায় পাওয়া যাচ্ছে না।’

২০১০ সালে প্রকাশিত আমার সাড়া জাগানো গবেষণা-গ্রন্থ ‘আ প্রোফাইল অব ব্যাংক লোন ডিফল্ট ইন দ্য প্রাইভেট সেক্টর ইন বাংলাদেশ’-এই ‘হেবিচুয়াল ডিফল্টারস’দের আমি ‘উইলফুল ডিফল্টারস’ আখ্যায়িত করেছি, যার বাংলা অর্থ হলো ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’। এর মানে, এ রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিরা রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে এতই প্রভাবশালী যে তারা ব্যাংকের ঋণ ফেরত না দিলেও ব্যাংক-কর্তৃপক্ষ, সরকার বা দেশের বিচার ব্যবস্থা তাদের শাস্তি দিতে পারছে না। এ-সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে বছরের পর বছর ঋণখেলাপি হয়ে বহাল তবিয়তে তারা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা গৃহীত ঋণের বড় অংশই বিদেশে পাচার করে ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপাতি কিনে তাদের পরিবারের প্রায় সবাইকে বিদেশে অভিবাসী করে ফেলেছে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া ১৯৯৭ সালে ১ কোটি টাকার বেশি ঋণগ্রস্ত যে ২ হাজার ১১৭ জন ঋণখেলাপির তালিকা সংসদে পেশ করেছিলেন ওই তালিকার বৃহত্তর এক হাজার ঋণখেলাপি থেকে ১২৫টি নমুনা বাছাই করে আমরা গবেষণাটি পরিচালনা করেছিলাম। আমি তখন ডেপুটেশনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের ডিরেক্টর জেনারেল। ১৯৯৯ সালের মে মাসে গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল নিয়ে আমরা একটি জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে খেলাপি ঋণ নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আমাদের গবেষণার ফলাফল নিয়ে বিরোধী দল বিএনপিকে সংসদে তুলোধুনা করেছিলেন। অনেকদিন গবেষণা বন্ধ রাখার পর ‘রিসার্চ মেথডলজি’ পরিবর্তন করে ‘কেস স্টাডি মেথড’ ব্যবহার করে আমরা দীর্ঘ বিলম্বের পর গবেষণাটি সম্পন্ন করে ২০১০ সালে বই হিসেবে প্রকাশ করি। বইটি অতি দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। ওই বইয়ের সপ্তম অধ্যায়ে বাংলাদেশের শীর্ষ ৩১ জন ঋণখেলাপির কেস স্টাডি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যাদের আমি ১২ বছর ধরে মনিটর করে যাচ্ছি। আমার জানামতে ওই ৩১ জন ঋণখেলাপির মধ্যে ছয়জন ছাড়া অন্যরা হয় এখনো ঋণখেলাপি রয়ে গেছেন অথবা ঋণখেলাপি থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। তাদের একজনের নামও অর্থমন্ত্রী কর্তৃক সংসদে পেশ করা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। (বলা বাহুল্য, খেলাপি  ঋণ সমস্যাটিকে আমি এক যুগ ধরে গভীরভাবে স্টাডি করে চলেছি)। অর্থমন্ত্রী কর্তৃক এবার উপস্থাপিত ২০ জন ঋণখেলাপির মধ্যে অর্ধেক চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠান, যেগুলো খেলাপি ঋণের কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তালিকার মধ্যে ঢাকার কয়েকশ রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের একটিকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি, যাদের প্রতিটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রকাশিত এ ২০টি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি বলে দেশের ব্যাংকিং সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা সবারই জানা আছে। দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, সরকারের প্রদত্ত সুযোগ নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান খেলাপি ঋণের ২ শতাংশ ফেরত দিয়ে হয়তো তাদের নাম ১০ বছরের জন্য ঋণখেলাপি তালিকা থেকে উধাও করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও বলেছেন, সরকারের প্রদত্ত রিশিডিলিংয়ের নিয়ম শিথিল করার সুযোগ নিয়ে এবং ঋণ ফেরত দেয়ার নীতিকে উদার করায় হয়তো এ ধরনের অপকর্মের হোতারা (ডেলিংকোয়েন্ট বোরোয়ার্স) পার পেয়ে গেছেন!

মুস্তফা কামাল ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলার যে নীতিগুলো একের পর এক গ্রহণ করেছিলেন তার তালিকাটি দেখুন:

১. ২০১২ সাল থেকে প্রচলিত তিন ধরনের শ্রেণীকরণের নিয়ম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক খাতের অনাদায়ী ঋণ শ্রেণীকরণের নতুন নিয়ম চালু করেছিল: এক. নির্দিষ্ট মেয়াদের তিন মাস পর যেসব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হতো সেগুলোকে ‘সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণ’ শ্রেণীকরণ করা হতো, নতুন নিয়মে তিন মাসের পরিবর্তে সময়টা ছয় মাস করা হয়েছে; দুই. নির্দিষ্ট মেয়াদের ছয় মাসের বেশি যেসব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হতো সেগুলোকে ‘ডাউটফুল ঋণ’ বলা হতো, নতুন নিয়মে নয় মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে ‘ডাউটফুল’ শ্রেণীকরণ হবে এবং তিন. আগের নিয়মে নয় মাসের বেশি কোনো ঋণ খেলাপি হলে ‘মন্দঋণ’ শ্রেণীকরণ করা হতো, এখন এক বছর বা তার বেশি সময়ের জন্যে ঋণ অনাদায়ী হলে ‘মন্দঋণ’ বা ‘লস’ শ্রেণীকরণ করা হবে। ২০১২ সালের নিয়মটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ছিল, কিন্তু অর্থমন্ত্রীর চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক পুরনো শ্রেণীকরণ পদ্ধতিতে ফিরে গেল।

২. এরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক মন্দঋণ ‘রাইট অফ’ বা অবলোপনের নিয়মনীতি অনেকখানি শিথিল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করল: আগের নিয়মে যেখানে পাঁচ বছরের খেলাপি মন্দঋণ ‘রাইট অফ’ করার যোগ্য বিবেচিত হতো সে ক্ষেত্রে নতুন নিয়মে দুই বা তিন বছরের মন্দঋণও ‘রাইট অফ’ করায় কোনো বাধা থাকবে না। পাঠকদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, মন্দঋণ ‘রাইট অফ’ বা অবলোপন করার মানে হলো ওই অবলোপনকৃত মন্দঋণের হিসাবটা ব্যাংকের মূল ব্যালান্স শিট থেকে অপসারণ করে আরেকটি লেজারে হিসাবটা সংরক্ষণ করা। ‘রাইট অফ’ করার দুটো শর্ত হলো: (১) ওই ঋণ সুদাসলে আদায়ের জন্যে ব্যাংক মামলা দায়ের করবে, (২) যে পরিমাণ ঋণ ‘রাইট অফ’ করা হয় তার সমপরিমাণ অর্থ ‘প্রভিশনিং’ বা ‘সঞ্চিতি’ করতেই হবে। প্রভিশনিং মানে হলো ওই পরিমাণ অর্থ অন্য কাউকে ঋণ দেয়া যাবে না। রাইট অফ করার ফলে ব্যাংকের ক্লাসিফায়েড লোনের পরিমাণ ঠিক অতটুকু কম দেখানো যাবে। অতএব, নতুন নিয়ম চালু করে ক্লাসিফায়েড লোন কমানোর হাতিয়ার ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দেয়া হলো। আর একটা সুবিধা ঘোষিত হলো, মামলা করার বাধ্যবাধকতার জন্য আগে যে সর্বনিম্ন সীমা (ফ্লোর) ছিল ৫০ হাজার টাকা সেটা বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা।

৩. তারপর ২৫ মার্চ ২০১৯ তারিখে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, মাত্র ২ শতাংশ খেলাপি ঋণ প্রথম কিস্তিতে শোধ করলে ঋণখেলাপিকে ১০ বছর সময় দেয়া হবে, যার মধ্যে তিন মাসের কিস্তিতে মাত্র ৭ শতাংশ সুদে বাকি ঋণ শোধ করা যাবে। (পরে তিনি বললেন সুদের হার ৯ শতাংশ হবে)।

৪. এরপর ৭ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে তিনি বললেন, ‘আমি খেলাপি ঋণের জন্যে ব্যবসায়ীদের কীভাবে জেলে পাঠাব?’ দুর্নীতির দায়ে যদি দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী জেল খাটেন তাহলে ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ ব্যবসায়ীরা আইন মোতাবেক শাস্তি পেলে তার প্রাণ কাঁদবে কেন? ঋণ খেলাপি ব্যবসায়ীরা কি আইনের ঊর্ধ্বে?

৫. ২৮ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে তিনি সংসদে বললেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন কার্যকর করার মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের মাফ করার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।

৬. সর্বশেষ যে ১৫ জন খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে ২০১৫ সালে মন্দঋণ রিস্ট্রাকচারিংয়ের সুযোগ দেয়া হয়েছিল তাদের শর্ত দেয়া হয়েছিল যে ওই সুবিধা গ্রহণ করলে আর কখনো নতুন করে ঋণ রিশিডিউলিংয়ের সুযোগ পাওয়া যাবে না। কিন্তু ১৫ জনের মধ্যে মাত্র চারজন ওই শর্ত মেনে সুযোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিল। বাকি ১১ জনকে আর রিশিডিউলিং সুযোগ দেয়া হবে না বলা হলেও অর্থমন্ত্রীর চাপের কাছে নতি স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের আবারো ঋণ রিশিডিউল করার অনুমতি দিয়েছিল।

উপরের পদক্ষেপগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, দায়িত্ব নেয়ার শুরু থেকেই বর্তমান অর্থমন্ত্রী ঋণখেলাপিদের অস্বাভাবিক রকম ছাড় দিতে শুরু করেছিলেন। চার বছর ধরে তিনি তার এই ঋণখেলাপি-প্রীতি অব্যাহত রেখেছেন আরো অনেক নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে। ২০১৯ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্লাসিফায়েড লোনের যে হিসাব প্রকাশ করল তাতে মাত্র ৯৫ হাজার কোটি টাকায় নেমে গেল ক্লাসিফায়েড লোন। বলা হলো, নতুন পদক্ষেপগুলোর কারণে খেলাপি ঋণ কমে গেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এ দাবির প্রতিবাদে ব্যাখ্যাসহ জানাল, ওই পর্যায়ে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আইএমএফের উল্লিখিত পরিমাণে যেহেতু রাইট অফ করা মন্দঋণ অন্তর্ভুক্ত ছিল না তাই প্রকৃত খেলাপি ঋণ তখনই ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি হওয়ার কথা। এরপর যখন ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারী আঘাত হানল তখন আর কোনো ঋণগ্রহীতাকে খেলাপি ঘোষণা না করার নীতি গ্রহণ করল সরকার। আড়াই বছর পর গত সেপ্টেম্বরের শেষের হিসাব প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ওই সময় ক্লাসিফায়েড লোন ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আমার ধারণা, এখন দেশে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ হয়তো ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থমন্ত্রী তার চার বছরের মেয়াদে সফলভাবে তার ‘রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি’ বন্ধুদের খেলাপি ঋণকে কার্পেটের নিচে লুকিয়ে ফেলা সত্ত্বেও দেশের ব্যাংকগুলোতে হু হু করে তা বেড়ে চলেছে। এটাই হলো দুঃখজনক বাস্তবতা। তার প্রদত্ত তালিকার ২০ জন ‘শীর্ষ ঋণখেলাপি’ শীর্ষে স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়। ‘আসল রাঘববোয়ালরা’ এখনো আড়ালেই থেকে গেল, যা দুঃখজনক।  

       

ড. মইনুল ইসলাম: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন