গ্রাহকের সঞ্চয়ের কারণেই ব্যবসায়িক মডেলে বড় পরিবর্তন এসেছে

মো. কায়সার হামিদ

বাংলাদেশের অবকাঠামোগত সামগ্রিক উন্নয়ন এবং বিশাল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক সেবা খাতের আওতাভুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৯ সালে যাত্রা করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স। অগ্রযাত্রার অংশ হিসেবে ২৩ বছর ধরে নিত্যনতুন সেবা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের পাশে ছিল প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠালগ্নে নাম বিডি ফাইন্যান্স হলেও ২০২১ সালে রিব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে প্রতিষ্ঠান।

২৩ বছরের যাত্রায় বাংলাদেশ ফাইন্যান্স তার ব্যবসার ধরনে এনেছে আমূল পরিবর্তন! ব্যাংকনির্ভর ডিপোজিটের পরিবর্তে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে সেগমেন্টভিত্তিক আমানত সংগ্রহ নিয়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে মাসিক ভিত্তিতে হাজার টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অংকের ছোট ছোট আমানত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন ব্যাংকনির্ভরতা কমেছে তেমনি গ্রাহক আমানত সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে এসেছে গতিশীলতা।

আমরা মূলত দুটো জায়গায় প্রাধান্য দিয়ে কাজ করি। একটা হলো ফান্ডিং মিক্সে কাস্টমার ডিপোজিটের পরিমাণ বাড়ানো, প্রতিনিয়ত এবং ছোট ছোট ডিপোজিট নেয়ার জন্য একটি সেলস মডেল রিলেশনশিপ বেজ বিজনেস মডেল তৈরি করা, যেখানে ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের একটি নতুন ধারণা নিয়ে এসেছি। গ্রাহকদের বীমাসেবা, পুঁজিবাজারের ব্যবসার সুযোগ এবং আর্থিক খাতের অন্যান্য সুবিধা দেয়ার জন্য ওয়েলথ ম্যানেজমেন্ট কনসেপ্ট কাজ করে। এক কথায় অর্থবাজারের সব সুবিধা এক ছাতার নিচে নিয়ে এসেছি। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের বর্তমান পর্ষদের সহযোগিতায় আগামী তিন-চার বছরে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সকে একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব।

বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ প্রান্তিক পর্যায়ের। জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবা খাতে অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স চালু করেছে মাসিক আমানত, এককালীন আমানত, মেয়াদি আমানত ডিজিটাল ঋণসেবা প্রদান। ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাদের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন ঋণ সুবিধার পাশাপাশি গ্রাহকের নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাদের মাঝে সঞ্চয়ের মনোভাব তৈরি করা এবং সঞ্চয়ে আগ্রহী করার জন্য ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি প্রোগ্রাম চালু করেছে।

গ্রাহকদের শুধু অর্থ বা সম্পদের সুরক্ষা নয়; সঙ্গে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়েও বাংলাদেশ ফাইন্যান্স প্রডাক্ট চালু করেছে, যার নামবাংলাদেশ ফাইন্যান্স সুরক্ষা মহামারীজনিত কারণে মানুষের নিবিড় স্বাস্থ্যসচেতনতায় গ্রাহকদের সেবা দেয়ার পরিকল্পনা থেকে পণ্যটির ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে স্বাস্থ্য সুবিধাগুলো টেলিমেডিসিন, স্বাস্থ্য জীবন বীমা, কভিড-১৯ সুরক্ষা সুবিধা, ডায়াগনস্টিক, মেডিসিনে ছাড়সহ ডাক্তারের অ্যাপয়ন্টমেন্ট পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সেবার পাশাপাশি সঞ্চয়ের নিমিত্তেই প্রডাক্টটি আনা হয়েছে।

এর বাইরে নারী উন্নয়ন সামগ্রিক অর্থনীতিক সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স চালু করেছেবিজয় এই প্লাটফর্মে নারী উদ্যোক্তার কাছ থেকে ডিপোজিট সংগ্রহ এবং ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের একটি বিশেষ টিম কাজ করছে। তাদের আমানতের সুরক্ষা মুনাফার জন্য যেমন ভালো অফার রয়েছে, তেমনি বিনা জামানতে মাত্র চারদিনে শতাংশ সুদে রয়েছে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের সুবিধা। এছাড়া সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর জন্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের আছে রিলেশনশিপ ম্যানেজারভিত্তিক বিশেষায়িত কাস্টমাইজড সেবা।

শুধু কি তাই, বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যবাংলাদেশ ফাইন্যান্স রিটায়ারমেন্ট প্ল্যাননামে নতুন এক প্রডাক্টের যাত্রা করেছে গত বছর। প্রডাক্টের আওতায় পেনশনের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন বেসরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরা তাদের আয়ের বা সঞ্চয়ের একটি সুবিধাজনক অংক জমা করতে পারবেন। ১০ বছর মেয়াদি রিটায়ারমেন্ট প্ল্যানেমেয়াদ শেষে মুনাফাসহ মাসে মাসে জমা দেয়ার কিস্তির সমপরিমাণ টাকা পেতে থাকবেন। এমনকি স্কিম গ্রহণকারী সুবিধা পাবেন হোম, কার বা পারসোনাল লোনের।

শুধু তা- নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে পশুপালনে কৃষকের হাতে দেয়া হচ্ছে ঋণ, ব্যবস্থা করা হচ্ছে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের। ক্ষুদ্র মুদি দোকানির হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে মূলধনের পর্যাপ্ত টাকা। যেটা আগেই বলেছিলাম, সিএমএসএমই উদ্যোক্তার কাছ থেকে মাসিক ভিত্তিতে হাজার টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অংকের ছোট ছোট আমানত সংগ্রহ করা হচ্ছে। মূলত তাদের আমানতকে গুরুত্ববহ করতে ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি প্রোগ্রামের অধীনে এসব আমানতের বিপরীতে ঋণ সুবিধার বিভিন্ন প্যাকেজের আওতায় এনে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী ইসলামিক ব্যাংকিং সেবার বিষয়ে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ফাইন্যান্স চালু করেছে সম্পূর্ণ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং সেবাবাংলাদেশ ফাইন্যান্স ইসলামিক এত সম্ভাবনার ইসলামী অর্থনীতি নিয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স যা করছে তার ব্যাখ্যায় প্রথমেই বলে নেয়া দরকার, দেশে প্রচলিত ধারার নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেড সর্বপ্রথম ইসলামিক ফাইন্যান্সিং কার্যক্রম শুরু করে ২০২২ সালে। জানুয়ারি, ২০২২- বাংলাদেশ ব্যাংকের চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়ে পরদিন জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের ছয়টি শাখায় একযোগে ইসলামিক উইং কার্যক্রম শুরু হয়। যাত্রার এক বছরে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ইসলামিকের অর্জন অনেক; পাশাপাশি যেতে হবে বহুদূর!

গত এক বছরে দেশসেরা স্কলারদের সমন্বয়ে গঠিত আমাদের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির অনুমোদনক্রমে ইসলামিক ডিপোজিট ইনভেস্টমেন্টের উদ্ভাবনী সব প্রডাক্ট ডিজাইন করা হয়েছে এবং তদনুযায়ী ডিপোজিট সংগ্রহ ইনভেস্টমেন্ট প্রদানের কার্যক্রম চলছে। এরই মধ্যে আমরা শরিয়াহ ম্যানুয়াল, শরিয়াহ অডিট ম্যানুয়ালসহ বেশকিছু প্রডাক্ট প্রোগ্রাম গাইডলাইন প্রণয়ন করেছি, যার মাধ্যমে সব ধরনের রিটেইল করপোরেট গ্রাহকসেবা প্রদানে আমাদের শতভাগ প্রস্তুতি রয়েছে।

ডিপোজিট সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ইসলামিক, মুদারাবা নীতি অনুসরণে নানাবিধ প্রডাক্ট নিয়ে এসেছে; যার মধ্যে মুদারাবা টিডিআর, মুদারাবা প্রফিট আর্নারস স্কিম, মুদারাবা ক্যাশ ওয়াকফ স্কিম, মুদারাবা মাসিক ডিপিএস, মুদারাবা হজ স্কিম, মুদারাবা ওমরাহ স্কিম, মুদারাবা রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান অন্যতম। এরই মধ্যে আমাদের ইসলামিক পোর্টফোলিও দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ কোটি টাকায়। এত অল্প সময়ে পোর্টফলিও বলে দেয়, কতটা আস্থা এবং বিশ্বাসের পরিচায়ক ইসলামিক ফাইন্যান্সিং। সব প্যারামিটারে দেশের ব্যাংকিং পোর্টফোলিওর প্রায় ২৮ শতাংশ এখন ইসলামিক ব্যাংকিং ফাইন্যান্সের দখলে। প্রতিনিয়ত কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারার জনপ্রিয়তা গ্রহণযোগ্যতা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ইসলামিক ধারার গর্বিত অংশীদার হতে পেরে আনন্দিত।

শরিয়াহসম্মত বিনিয়োগ পদ্ধতির মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আমরা কৃষি, নারী উদ্যোক্তা, ব্যবসায়িক কার্যক্রম, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল, নির্মাণকাজ, অটো ফাইন্যান্স, হোম ফাইন্যান্স, পারসোনাল ফাইন্যান্স খাতে (রিটেইল করপোরেট সেক্টর) বিনিয়োগ করে আসছি। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাই মুরাবাহা, বাই মুয়াজ্জাল হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করছি। ইসলামের আলোকে নিত্যনতুন সব উদ্ভাবনী আগামীর সম্ভাবনাকে দৃঢ় করছে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার কৃষি খাত, নারী উদ্যোক্তা নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য রিফাইন্যান্স স্কিমের মাধ্যমে স্বল্প মুনাফায় বিনিয়োগের ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ইসলামিক সেই রিফাইন্যন্স স্কিমের মাধ্যমে স্বল্প মুনাফায় প্রান্তিক পর্যায়ে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, যা টেকসই ইসলামী অর্থ ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

 ফিনটেক ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রি একই সূত্রে গাঁথা। ফিনটেক ছাড়া ব্যাংকিং অপারেশন্স অকল্পনীয় হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। তাই বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ফিনটেকভিত্তিক ইনোভেটিভ সেবা প্রদানের লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। অ্যাপভিত্তিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকেই বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের সেবা গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে।

আমরা তৃণমূল পর্যায়ে আর্থিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। এরই অংশ হিসেবে রিটেইল ডিপোজিট গ্রাহক অন্তর্ভুক্তি ক্ষুদ্র বিনিয়োগগ্রহীতাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ইসলামিক। গ্রাহকের প্রচলিত আস্থা নির্ভরতা এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের ইসলামী আর্থিক ব্যবস্থা; সেবার মানদণ্ডকে দ্রুত অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

ব্যাংকের সুদহার কমে যাওয়ায় (যদিও এবারের মুদ্রানীতিতে ডিপোজিট সংগ্রহে সুদহারের ক্যাপ তুলে দেয়া হয়েছে) ভালো গ্রাহকেরা ব্যাংক ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স রোড টু সেফটি পদক্ষেপ নিয়েছে। গ্রাহকের প্রয়োজন বিবেচনায় এনে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স এনেছে সময়োপযোগী আর্থিক সেবা, যার মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণীর গ্রাহককে সংযুক্ত করা গেছে আর্থিক সেবা খাতে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের ২০১৯ সালে ৬৫ শতাংশ ব্যাংকঋণ ৩৫ শতাংশ গ্রাহক আমানত ছিল। যখন বুঝতে পেরেছি ব্যাংকের টাকা দিয়ে ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পারব না তখন সে অবস্থান থেকে সরে এসেছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি ছোট ছোট গ্রাহক থেকে আমানত সংগ্রহের। তাই গত দুই বছরে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করেছে। এখন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের গ্রাহক আমানত ৬৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং ব্যাংক থেকে নেয়া তহবিল ৩১ দশমিক ৬১ শতাংশ। আশা করছি চলতি বছরের মধ্যে ব্যাংক থেকে নেয়া তহবিল উল্লেখযোগ্য হারে নেমে আসবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ইচ্ছাকে আরো সহজ সহায়ক করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স তার আর্থিক সেবা খাতকে ডিজিটালাইজ করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন; যার সুবাদে মোবাইল ফাইন্যান্স সার্ভিস, ডিজিটাল ঋণ সুবিধা, -কেওয়াইসিসহ নানা ডিজিটাল খাতে বিনিয়োগ করছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স। এর সুবাদে দেশের একটি বৃহত্ জনগোষ্ঠী আর্থিক সেবা পাচ্ছে কোনো ঝামেলা ছাড়াই নিরাপদ এবং ঘরে বসে।

 

মো. কায়সার হামিদ: এমডি সিইও, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেড

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন