ভালো ও গ্রহণযোগ্য রিটার্ন দেয় এমন প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখতে হবে

মমিনুল ইসলাম

যেকোনো আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সেই প্রতিষ্ঠানের কী ধরনের ঝুঁকি রয়েছে সেটি জানাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অনেক সময় দেখা যায় যে একটি ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বেশি রিটার্ন দিচ্ছে, তখন কিন্তু সবাই সেখানে টাকা রাখতে চায়। কিন্তু রিটার্নের সঙ্গে ঝুঁকিরও একটি সম্পর্ক রয়েছে। যত বেশি ঝুঁকি তত বেশি রিটার্ন আসা উচিত। আবার রিটার্ন বেশি থাকলে ঝুঁকিও বেশি থাকে। প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে বেশকিছু নির্দেশক রয়েছে, যেগুলো আমানতকারীরা পর্যালোচনা করে দেখতে পারেন। প্রথমেই বলতে হয় ঋণ মানের কথা। এক্ষেত্রে দুটি প্রতিষ্ঠানের ঋণমান একই হলে তখন দেখতে হবে কে বেশি রিটার্ন দিচ্ছে। আমাদের দেশের ঋণমানের গুণগতমান শতভাগ বিশ্বাসযোগ্য সেটি বলছি না। এক্ষেত্রে ঋণমাণের সঙ্গে সঙ্গে আরো বেশকিছু বিষয় দেখা উচিত। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কেমন সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। এটি সব প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট কিংবা বার্ষিক প্রতিবেদনে থাকে। খেলাপি ঋণ কম হলে ভালো, বেশি হলে ঝুঁকি আছে। প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষক কে সেটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে কোন নিরীক্ষক ভালো সেটি বোঝার উপায় কী? এক্ষেত্রে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যেসব নিরীক্ষককে দিয়ে নিরীক্ষা করিয়ে থাকে তাদের ওপর আস্থা রাখা যায়। সেসব নিরীক্ষককে দিয়ে যদি ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিরীক্ষা করে থাকে তাহলে সেসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা আছে। প্রতিষ্ঠানের আর্থিক পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা রয়েছে কিনা সেটিও দেখতে হবে। এক বছর দেখা গেল ভালো মুনাফা করেছে, আবার আরেক বছর খারাপ করেছে, তাহলে তার ধারাবাহিকতা নেই। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতেও ঝুঁকি থাকে। অন্যদিকে কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে আর্থিক পারফরম্যান্স স্থিতিশীল, সেগুলোর সঙ্গে আর্থিক লেনদেন বা বিনিয়োগ করা তুলনামূলক ভালো। আমাদের দেশের যেসব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা পরিচালকরা ভালো, পর্ষদে বিদেশী পরিচালক কিংবা স্থানীয় ভালো করপোরেট প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোতে করপোরেট সুশাসনও ভালো। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে গ্রাহকের ঝুঁকিও কম থাকে। আরেকটি প্রশ্ন গ্রাহকের মনে ঘুরপাক খায় যে ব্যাংক ভালো, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বেশি ঝুঁকি রয়েছে কিনা। ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুটোই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকের মধ্যেও সবল ব্যাংক আছে আবার দুর্বল ব্যাংক আছে। একইভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবল দুর্বল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাই আমাদের ব্যাংক নাকি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এভাবে চিন্তা না করে যে প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখব সেটির শক্তিমত্তা যাচাই করা উচিত। মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত (সিএআর) সঞ্চিতি ঘাটতি এই দুটি বিষয়ও দেখা যেতে পারে। সিএআর যত বেশি হবে সেই প্রতিষ্ঠানের শক্তিমত্তাও তত বেশি। সার্বিকভাবে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে যদি কোনো গ্রাহক আমানত রাখেন তাহলে মেয়াদ শেষে টাকা ফেরত দিতে পারছে না কিংবা সুদ দিতে পারছে না ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে না। ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই ঘটা উচিত না। কিন্তু একটা বিষয় কখনই মনে করা উচিত নয় যে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখা শতভাগ নিরাপদ। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক মডেলে নিজের টাকার সুরক্ষা নিজেকেই করতে হবে। ঝুঁকি থাকবেই তবে সেটিকে কীভাবে কমিয়ে গচ্ছিত অর্থের নিরাপত্তা বাড়ানো যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। তবে যেসব নির্দেশকের কথা বলা হয়েছে সেগুলো পর্যলোচনা করে যদি ভালো প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা যায় সেক্ষেত্রে আগামী দুই-চার কিংবা পাঁচ বছরে এসব প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। কিন্তু একেবারেই ঝুঁকি নেই সেটি বলা সম্ভব নয়। বিশ্বের কোথাও ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গচ্ছিত অর্থের শতভাগ নিরাপত্তা কেউ দিতে পারবে না। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময় যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে কিংবা একীভূত হয়েছে। এসব নির্দেশকের তথ্য বর্তমানে পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া যাবে। প্রয়োজনবোধে যে প্রতিষ্ঠানের কাছে আমানত রাখবেন সেই প্রতিষ্ঠানের কাছে এসব তথ্য চেয়ে নিতে হবে। সব তথ্য পর্যালোচনা করে ভালো গ্রহণযোগ্য রিটার্ন দেয় এমন প্রতিষ্ঠান বাছাই করতে হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে বিভিন্ন নির্দেশকে ভালো কিন্তু রিটার্ন খুব কম দেয়। সেসব প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখলে গ্রাহক তেমন কিছুই পাবেন না। আবার অনেক ভালো প্রতিষ্ঠান আছে যারা বেশি না হলেও একটি গ্রহণযোগ্যহারে রিটার্ন দিয়ে থাকে। তাদের বেছে নিতে হবে।

 

মমিনুল ইসলাম: ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেড

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন