৬৭ দিনে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার ১ শতাংশেরও কম

ধান-চাল সংগ্রহে ব্যর্থতা খাদ্যনিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে

প্রায় শতভাগ আমন ধান কাটা হয়ে গেলেও সরকারের ধান-চাল সংগ্রহে কোনো গতি নেই। ৬৭ দিনে মাত্র ২ হাজার ২২১ টন ধান-চাল সংগ্রহ করেছে সরকার, লক্ষ্য তিন লাখ টন। বলা হচ্ছে, অনুকূল আবহাওয়ায় এবার ফলন হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি। সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের স্থবিরতার পেছনে রয়েছে সংগ্রহ অভিযানের প্রক্রিয়াগত ত্রুটি আর বাজারের দামজনিত অভিঘাত। তাছাড়া প্রচলিত অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহ পদ্ধতিতে সরকার মিল ও চালকল মালিকদের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বাংলাদেশে কৃষি খাতে যতখানি উন্নতি হয়েছে, ততখানি উন্নতি কৃষকের হয়নি। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের অবস্থা নাজুক হচ্ছে। ধানের বাড়তি দাম যেন উৎপাদকের কাছে পৌঁছতে পারে, তা যেমন নিশ্চিত করতে হবে, পাশাপাশি চালের দাম যেন নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি না করে তা খেয়াল রাখতে হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারি মজুদ বাড়িয়ে বাজার স্থিতিশীল রাখা জরুরি। ডলার সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশ্যস্যের দাম বেশির পাশাপাশি সংকট থাকায় বাংলাদেশের জন্য খাদ্য আমদানি কঠিন হয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য অনুসারে ধান-চাল সংগ্রহে বারবার ব্যর্থতা ঝুঁকিতে ফেলছে দেশের খাদ্যনিরাপত্তাকেও।

সরকারের আমন ও বোরো মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে-এক. ধান কাটা ও ঘরে তোলার মৌসুমে বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখা। দেশে ধানচাষীদের বেশির ভাগই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক। তারা ধারদেনা করে ফসল ফলান। এছাড়া তাদের সংসারে নানা অভাব-অনটন লেগেই থাকে। ফলে ধান কাটার পর পরই বহুকষ্টে ফলানো ফসল বিক্রি করতে বাজারে নিতে হয়। মৌসুমের শুরুতে ধানচাষীরা যাতে ধানের ন্যায্য দাম পান, তা যতটা সম্ভব নিশ্চিত করতে সরকার মাঠ পর্যায়ে চাষীর কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনে। দুই. সরকারি গুদামে চালের নিরাপত্তা মজুদ গড়ে তোলা। সরকারি খাদ্যগুদামে যথেষ্ট পরিমাণে ধান-চাল মজুদ থাকলে তা চালকল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের চালের দাম বাড়াতে নিরুৎসাহিত করে। তিন. বাজারে চালের দাম বাড়লে সরকারি মজুদ থেকে খোলাবাজারে ও ন্যায্যমূল্যের দোকানে চাল বিক্রির মাধ্যমে সরকার চালের দাম স্থিতিশীল রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ডিজেল ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ যেমন সার, কীটনাশক, বীজ ইত্যাদির দাম বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরের শুরুতেই কৃষি উৎপাদনের সবচেয়ে মৌলিক দুটি উপকরণ ডিজেল ও সারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে। বেড়েছে কৃষি মজুরদের দাম। সব মিলিয়ে কৃষক পর্যায়ে বেড়ে চলেছে ধানের উৎপাদন ব্যয়। ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং যেকোনো দুর্যোগের প্রস্তুতি হিসেবে মজুদ নিশ্চিত করতেই সরকারকে চাল আমদানি করতে হয়। সরকারের সুরক্ষা কর্মসূচি ওএমএস ও বিভিন্ন সহায়তা কর্মসূচির জন্যও সরকারের কাছে চালের মজুদ থাকতে হয়। কিন্তু যখন ধান-চাল লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সংগ্রহ না হয় তখন মজুদের ওপর তার প্রভাব পড়ে।

কৃষকরা তাদের কষ্টের অর্জিত ফসল ঘরে তোলার পরই নগদ অর্থের প্রয়োজনে একটা অংশ বাজারে বিক্রি করে অর্থের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি পরবর্তী কৃষি মৌসুমে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ক্রয় করে থাকে। কিছু কৃষক অবশ্য সামান্য অংশ ঘরে মজুদ করে রাখেন। কৃষকরা ধান বিক্রি করেন ফড়িয়া, বেপারি, পাইকার ও আড়তদারের কাছে। অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী বাজারে সরবরাহ বেশি থাকার কারণে দাম কমে যায়, তাতে কৃষকরা লাভবান হন না বললেই চলে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে আউশ ও বোরো ধানের ক্ষেত্রে আয়-ব্যয়ের অনুপাত একের নিচে। অর্থাৎ কৃষকদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। তার পরও কৃষকরা উৎপাদন চালিয়ে যান। তার কারণগুলো হলো বিকল্প উপার্জনের সুযোগ না থাকা, উত্তরাধিকার কৃষি, অভ্যাস, নিজের পারিবারিক খাদ্যনিরাপত্তা ইত্যাদি।

ধান-চাল ক্রয় কর্মসূচির অন্যতম উদ্দেশ্য কৃষকদের আয় সহায়তা প্রদান করা, যা মূলত দাম সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। বাজার দাম ও উৎপাদন খরচ বিবেচনায় নিয়ে সরকার সংগ্রহ দাম নির্ধারণ করে থাকে। বাজারের চেয়ে কম মূল্য নির্ধারণের কারণেও কৃষকরা সরকারকে ধান দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বাস্তবতার নিরিখে খাদ্য বিভাগের পক্ষে অসংখ্য কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান কেনা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে কৃষককে পরিবহন খরচ ও সময় ব্যয় করে সংগ্রহ কেন্দ্রে এসে ধান বিক্রি করতে হয়। তবে বিক্রি করতে না পারার অনেক উদাহরণও আছে। এক্ষেত্রে কৃষক ধানের ১৪ শতাংশ আর্দ্রতা বজায় রাখতে না পারার বিষয়টি অন্যতম একটি কারণ। এ অবস্থায় কৃষক দুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। একটি হলো ধান বিক্রি করতে না পারা এবং অন্যটি পরিবহন ব্যয় ও সময়। বিষয়টি কীভাবে সমাধান করা যায় তা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। সংগ্রহ কেন্দ্রে ধান কেনার জন্য ন্যূনতম ১৪ শতাংশ আর্দ্রতার বিষয়টি কৃষককে জানানোর পাশাপাশি আর্দ্রতা পরিমাপের জন্য নিকটবর্তী খাদ্য অফিস বা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সহযোগিতা করতে পারে। যে অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয় অথবা পরিবহন খরচ বেশি (যেমন হাওর এলাকা, চর এলাকা) সেক্ষেত্রে বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সব দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে খাদ্যশস্য সংগ্রহ কর্মসূচি রয়েছে। কিছু দেশে কার্যকর সরকারি খাদ্যশস্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া বিদ্যমান। যেমন আমাদের পাশের দেশ ভারত। দেশটির কৃষকরা একটি মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসে (এমএসপি) সরকারের কাছে নিজেদের পণ্য, প্রধানত ধান ও গম বিক্রি করতে পারেন, যা পর্যায়ক্রমিকভাবে প্রতি বছর নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এমএসপির আওতায় ভারতের কৃষক রাজ্যের নির্ধারিত কেন্দ্রগুলোয় ধান, চাল, গম সরবরাহ করে থাকেন। ন্যায্য দাম পাওয়ার কারণে কৃষক আগ্রহের সঙ্গে সরকারের কাছে খাদ্যশস্য বিক্রি করেন। ফলে বরাবরই দেশটিতে মৌসুমভিত্তিক সংগ্রহ অভিযান সফল হয়। পদ্ধতিটি আমলে নিয়ে আমাদের মতো করে দেশে এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেতে পারে। জাপান সরকারও কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ধান-চাল কিনে থাকে। কৃষকদের সহায়তা দেয়াই মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ সরকার জাপান ও ভারতের মডেলটি অনুসরণ করতে পারে।

সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রথমেই গুদামগুলোকে উন্নত করতে হবে। খাদ্যশস্য মজুদের জন্য সরকারের তরফ থেকে খাদ্যগুদামের সংকটের কথাও বলা হয়; যা স্বল্পমেয়াদি নয়, দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। সরকারি গুদামে ছোট কৃষকদের ফসল সংরক্ষণ করার সুযোগ করে দিতে হবে যেন ফসলের সঙ্গে সঙ্গে কৃষককে অল্প দামে ফসল বিক্রি না করতে হয়। সরকারের ধান-চাল মজুদ করার সক্ষমতা কম হওয়ায় কারণে বেশির ভাগ সময়ই সরকারের পক্ষে বাজার প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে না। এছাড়া তুলনামূলক ছোট কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহে জোর দিতে হবে। কারণ ছোট ও মাঝারি কৃষকের টিকে থাকার সক্ষমতা কম।

বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা বিদ্যমান। চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সংকটকে বাড়িয়ে তুলেছে। নিত্যপণ্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে আমাদের জনজীবনে হিমশিম অবস্থা। জলবায়ু পরিবর্তনসহ আগামীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা বাড়তি উদ্বিগ্নতা নিয়ে হাজির হয়েছে। সুতরাং ধান-চালের মজুদ না বাড়ালে আপৎকালীন পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হতে পারে। এমনটি হলে খাদ্য সংকটের শঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থতায় সরকারি মজুদে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। খাদ্য মজুদ নজিরবিহীনভাবে কমেছে, বেড়েছে চালের দাম। কাজেই সংগ্রহ অভিযানে প্রাধান্য দিতে হবে মিলার নয়, প্রকৃত কৃষককে। ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ এড়াতে সরকারকে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে চলতি আমন মৌসুমে অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা কমপক্ষে ২০১৯-২০ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার (১০ লাখ টন) সমপরিমাণ করা যেতে পারে। ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান সফল করতে ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। ১০ লাখ টন আমন ধান-চাল সংগ্রহ সম্ভব হলে চাল আমদানিতে দুষ্প্রাপ্য বৈদেশিক মুদ্রার কিছুটা সাশ্রয় হবে। দুই. সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে চাল ও গম আমদানি নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। তিন. আসন্ন বোরো মৌসুমে সর্বোচ্চ পরিমাণ ফলন পাওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত ও রাষ্ট্রীয় সংগ্রহ পরিকল্পনা সফল করতে জোর পদক্ষেপ নিতে হবে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়কে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন