জনতা ব্যাংকের টাকায় কৃষক লীগ নেতার পাঁচ তারকা হোটেল

৫৫০ কোটি টাকা এখন খেলাপি ঋণ

হাছান আদনান

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অবস্থিত পাঁচ তারকা হোটেল হলিডে ইন ছবি: হলিডে ইন ওয়েবসাইট

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, যেটি হলিডে ইন নামেই বেশি পরিচিত। বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা আলম আহমেদ পাঁচ তারকা হোটেলের মালিক। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের অর্থে এটি গড়ে তুললেও তিনি পরিশোধ করেননি ঋণ। সব মিলিয়ে হোটেলটির কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৫৫০ কোটি টাকা। কয়েক দফা মেয়াদ বাড়িয়েও ঋণ আদায় করতে পারেনি ব্যাংকটি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে খেলাপির খাতায় উঠেছে পুরো ঋণ।

জানা গেছে, শুরুতে হাবিব হোটেলের ঋণ জনতা ব্যাংকের ছিল না। বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ অধিগ্রহণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি। যদিও অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছিল জনতা ব্যাংকের ক্রেডিট কমিটি। ওই ঋণের ব্যাপারে কোনো সুপারিশও ছিল না সংশ্লিষ্ট শাখার। তার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের রীতিনীতি ভঙ্গ করে ঋণ অধিগ্রহণ করে জনতা ব্যাংক। ২০১৭ সালে অধিগ্রহণের সময় ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪৩ কোটি টাকা। অনিয়মের মাধ্যমে অধিগ্রহণের পর হাবিব হোটেলকে আরো ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। শেষ পর্যন্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৫০ কোটি টাকা।

অনিয়ম-দুর্নীতি বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে এক দশক ধরে সমালোচনার শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক। বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিপর্যয় শুরু। এরপর এননটেক্স, ক্রিসেন্টের মতো হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে ব্যাংকে। নতুন করে তালিকায় যুক্ত হলো হাবিব হোটেলের নাম।

জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, হাবিব হোটেলের ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকের কোনো আইন রীতিনীতিই মানা হয়নি। ঋণ অধিগ্রহণের পর গ্রাহককে নতুন ঋণ দেয়া হয়েছে। জনতা ভবন করপোরেট শাখার মাধ্যমে ঋণ অধিগ্রহণ করা হয়। হাবিব হোটেলের ঋণসহ অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিতরণ করা কোনো ঋণই এখন আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না।

হাবিব হোটেলের ঋণের ক্ষেত্রে জনতা ব্যাংক নিজেদের নীতিমালার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাও লঙ্ঘন করেছে। বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, শাখার সুপারিশ ছাড়াই ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান শাখার ঋণটি জনতা ব্যাংক অধিগ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে জনতা ব্যাংকের ক্রেডিট কমিটিও নেতিবাচক মন্তব্য দিয়েছিল। কিন্তু অধিগ্রহণ-সংক্রান্ত সব নীতিমালা লঙ্ঘন করে ২০১৭ সালে ঋণটি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০২০ সালেই হাবিব হোটেলের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪০৬ কোটি টাকা।

যেকোনো ঋণ বিতরণ বা অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রকল্পের ফিজিবিলিটি রিপোর্ট (সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন) পর্যালোচনা করা হয়। হাবিব হোটেলের ঋণ অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যাংকের নীতিরও লঙ্ঘন ঘটিয়েছে জনতা ব্যাংক। বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, হাবিব হোটেলের ফিজিবিলিটি রিপোর্টটি ২০০৮ সালের। আর জনতা ব্যাংক ঋণ অধিগ্রহণ করেছে ২০১৭ সালে। ১০ বছর আগের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ঋণ অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ধরনের ঋণ অধিগ্রহণকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছে নিরীক্ষক দল।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, জনতা ব্যাংকের ঋণ নীতিমালার () বিধির নির্দেশনা অনুযায়ী হাবিব হোটেলের ঋণ প্রস্তাবটি রিলেশনশিপ ম্যানেজারের সুপারিশ মূল্যায়ন করে শিল্পঋণ বিভাগে পাঠানোর কথা। কিন্তু রিলেশনশিপ ম্যানেজার সুপারিশ মূল্যায়ন না করেই পাঠিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকিং নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণটি অনুমোদন দেয়।

জনতা ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান . এসএম মাহফুজুর রহমানও স্বীকার করেছেন হাবিব হোটেলের ঋণ অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যাংকের রীতিনীতি ভঙ্গ করার বিষয়টি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, হাবিব হোটেলের ঋণটি যখন অধিগ্রহণ করা হয়, তখন আরো অনেক বড় বড় ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল। ওইসব ঋণ বিতরণ অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে নীতি পরিপালনে ঘাটতি ছিল। কারণে বড় সেসব ঋণ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। আমি জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব নিয়েছি ২০২০ সালের জুলাইয়ে। দায়িত্ব নেয়ার পর ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনালের অবস্থান রাজধানীর তেজগাঁওয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সরণিতে। হাতিরঝিলের পশ্চিম প্রান্তে হোটেলটি নির্মাণের সময় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২-এর /১২ ধারা ভঙ্গ করা হয়েছে বলে বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালের ১২ জুলাই হাবিব হোটেলের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত মামলা করেছিলেন। ওই মামলায় বলা হয়, নকশাবহির্ভূতভাবে ১৭ তলা হোটেলটি নির্মাণ করা হয়। হোটেলটির সামনে-পেছনে, ডানে-বামে অতিরিক্ত নির্মাণের অভিযোগ তোলা হয়েছিল ভ্রাম্যমাণ আদালতের পক্ষ থেকে। ওই মামলার শুনানির পর আদালত হাবিব হোটেলকে কোটি টাকা জরিমানাও করেছিলেন। জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ অধিগ্রহণের সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মামলা জরিমানা আদায়ের বিষয়টি আমলে নেয়া হয়নি। কৃষক লীগ নেতার মালিকানায় থাকা হাবিব হোটেলের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে অনিশ্চয়তার বিষয়টিও নিরীক্ষা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের আপত্তির জবাবে জনতা ব্যাংক থেকে বলা হয়, জনতা ব্যাংক ভবন করপোরেট শাখার কোনো আর্থিক বিশ্লেষক বা প্রকৌশলী না থাকায় আর্থিক কারিগরি দিক মূল্যয়ন না করে প্রকল্প ঋণ প্রস্তাবটির সুপারিশ প্রধান কার্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট বিভাগে পাঠানো হয়। প্রধান কার্যালয়ের ওই বিভাগের আর্থিক বিশ্লেষক দ্বারা আর্থিক কারিগরি দিক মূল্যায়ন করে প্রকল্প ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। যদিও মূল্যায়নের পরও হাবিব হোটেলের কাছ থেকে কোনো অর্থ আদায় করতে না পারার কোনো ব্যাখ্যা জনতা ব্যাংক কর্মকর্তারা দিতে পারেননি।

এক্ষেত্রে নিরীক্ষা প্রতিবেদনের মন্তব্য, জনতা ব্যাংকের জবাব আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক নয়। কারণ ঋণ মঞ্জুরি নীতিমালার আলোকে ৩১ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা সমমূলধন ঘাটতি রেখে এবং ইকুইটি বিনিয়োগ কম থাকা সত্ত্বেও হাবিব হোটেলের অনুকূলে ঋণ প্রদান করায় ঋণ হিসাবটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ঋণ অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে আপত্তিকৃত সমুদয় টাকা আদায় করার সুপারিশও করা হয়েছে।

জনতা ব্যাংক ভবন করপোরেট শাখার একাধিক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, রাজনৈতিক বিবেচনায় হাবিব হোটেলের ঋণটি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। ঋণ অধিগ্রহণের পর গ্রাহককে নতুন ঋণও দেয়া হয়। ঋণ দেয়া নেয়া উভয় ক্ষেত্রেই জনতা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। আবার গ্রাহকও ঋণের অর্থ যথাযথভাবে কাজে না লাগিয়ে অন্য খাতে ব্যয় করেছেন। কারণেই ঋণটি পুনঃতফসিল করে দেয়ার পরও আদায় হয়নি। শেষ পর্যন্ত গত বছরের সেপ্টেম্বরে পুরো ঋণ খেলাপি করে দেয়া হয়েছে।

বিষয়ে বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুছ ছালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। একাধিকবার তার সেলফোনে কল করে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো সাড়া দেননি। আব্দুছ ছালাম আজাদ ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে জনতা ব্যাংকের এমডি পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

যদিও হাবিব হোটেলের মালিক আলম আহমেদের বক্তব্য হলো, জনতা ব্যাংকে তার ঋণটি এখনো খেলাপি হয়নি। বিষয়ে তার কাছে নথি রয়েছে। গতকাল তিনি সেলফোনে বণিক বার্তাকে কথা বলেন।

আলম আহমেদের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দক্ষিণগাঁওয়ে। মরিয়ম ভিলেজ নামে গ্রামে তার বিলাসবহুল একটি বাড়ি রয়েছে। আলম আহমেদ মরিয়ম এনপিএম গ্রুপ নামে একটি ব্যবসায়িক গ্রুপের চেয়ারম্যান। গ্রুপটির ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, মরিয়ম কনস্ট্রাকশন নামে গ্রুপটির ঠিকাদারি নির্মাণ খাতের একটি কোম্পানি রয়েছে। আর এনপিএম অ্যাপারেলস লিমিটেড নামে কাপাসিয়ায় একটি গার্মেন্টসও রয়েছে। হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনালকে নিজেদের সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করেছে মরিয়ম গ্রুপ।

বাংলাদেশ কৃষক লীগে আলম আহমেদের সাংগঠনিক পরিচয় নিশ্চিত করেছেন কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি কৃষিবিদ সমীর চন্দ। অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আলম সাহেব আমাদের কৃষক লীগের গত কমিটিতে উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় এবারো তিনি উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হিসেবে আছেন। উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হোক, আর কৃষক লীগের একজন কর্মী হোক, কেউ যদি দেশের প্রচলিত আইনের বাইরে গিয়ে কোনো কর্মকাণ্ড করে, দেশের আইনই সেটার বিহিত করবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন