জাপান বাংলাদেশের বড় বন্ধু

ড. এ কে আব্দুল মোমেন

জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক দিনের। আমাদের স্বাধীনতার পর থেকেই জাপান আমাদের বড় বন্ধু। ১৯৭৩ সালে জাপানে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাপানের মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভিত রচিত হয়েছে, আমরা আজও তার সুফল ভোগ করছি। স্বাধীনতার পরপর আমার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়। তখন আমাদের দেশ ফরেন এক্সচেঞ্জে ছিল না, আমাদের টাকাপয়সাও ছিল না। কিন্তু আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের প্রয়োজন ছিল খুব বেশি। আমরা পিন থেকে শিপসবকিছুই আমদানি করতাম। কিন্তু আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা নেই, কীভাবে আনব? কিন্তু প্রয়োজনও। সময়ে অনেক দেশ আমাদের ওপর একটা বদনাম রটাল যে বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি। এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এটা শোনার পরে অনেক অনেক দেশ আমাদের কাছে আর জিনিস বিক্রি করে না, রফতানি করে না। বলে, তোমাদের কাছে রফতানি করলে আমরা আমাদের পয়সা ফেরত পাব না। কেউ কেউ দাবি করে, তৃতীয় দেশের একটা সার্টিফিকেশন লাগবে। তৃতীয় দেশ কে-ইবা আমাদের সার্টিফিকেট দেবে ভারত ছাড়া। রকম দুর্দিনের সময় জাপানি সরকার জাপানি কোম্পানিগুলো আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করে।

তৎকালীন সময়ে মেরুবানি, সিয়োটোজাপানি কোম্পানিগুলো অনেকেই আমাদের ডেফার্ড পেমেন্টে, মানে জিনিস সাপ্লাই করে দেয়। আমরা বিক্রি করার পরে তাদের টাকা দিই। ব্যবস্থায়ও তারা রাজি হয় এবং দুর্দিনের সময় তাদের সাহায্য আমাদের খুব বেশি দরকারি সহযোগিতা করেছে।

আরেকটি জিনিস আমি বলতে চাই যে জাপান শুরু থেকেই আমাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু তাদের সাহায্যে কখনো তারা কোনো শর্ত, রাজনৈতিক শর্ত জুড়ে দেয় না। আমাদের অনেক বিদেশী বন্ধুরাষ্ট্র আছে, তারা যখন কোনো সাহায্য করে, ঋণ দেয়, তখন তাদের কিছু রাজনৈতিক শর্ত জুড়ে দেয়। কিন্তু জাপান ধরনের কাজ কখনো করেনি। আর জাপান আমাদের মধ্যে আরেকটি সম্পর্ক আছে। আমাদের দেশের মানবসম্পদ আর পানি ছাড়া বড় রকমের কোনো সম্পদ নেই। জাপানেরও তেমন কোনো সম্পদ নেই। তারা মানবসম্পদকে ঠিকমতো ব্যবহার করেছে, মানুষের মধ্যে অদম্য আগ্রহ, আন্তরিকতা দেশের প্রতি মমত্ববোধের ফলেই তারা এরই মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ম্যানেজমেন্ট স্কিল তৈরি করেছে। কীভাবে সস্তায় জিনিস বানানো যায়, কীভাবে কোয়ালিটি বাড়ানো যায়এসব বিষয়ে তাদের খুব নজর এবং এর ফলেই তারা এখন বিশ্বের অর্থনীতিতে বড় শক্তি।

একসময় তারা সারা পৃথিবীর মধ্যেই এক নম্বরের পজিশনে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক সবসময় খুব ভালো। আমার সঙ্গে আবার আরেকটি বিশেষ সম্পর্ক আছে ২০১১-১২ থেকে। আমি তখন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি। সময়ে বাংলাদেশে আমাদের বড় প্রজেক্ট, আমাদের আশার প্রজেক্ট, সেই পদ্মা সেতু, হঠাৎ করে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক সেই পদ্মা সেতুর টাকাটা দেবে না বলে জানিয়ে দিল, একেবারে অহেতুক কারণে। একটা মিথ্যা ইস্যু তুলল যে সেখানে নাকি কন্সপিরেসি টু করাপশন হয়েছে। এক পয়সাও দেয়নি, কিন্তু ওরা বলল, পয়সা দিলে ওখানে দুর্নীতি হবে। সেই কারণে দুর্নীতি করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে, একটা অজুহাত তুলে তারা হঠাৎ করে টাকাটা বন্ধ করে দিল। তাদের টাকার পরিমাণ ছিল দশমিক বিলিয়ন ডলার। আমার পদ্মা সেতুর প্রজেক্ট তখন দশমিক বিলিয়ন ডলার। অন্য যারা সহযোগী টাকা দেবেন বলেছিল, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক মেজর ডোনার, সে টাকা না দেয়ায় বাকিরাও চলে গেল।

সময়ে আমাদের মধ্যে খুব ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। আমি তখন জাপানিদের কাছে গেলাম। জাপান পয়সাওয়ালা দেশ, তাদের অনেক রিজার্ভ, অনেক টাকা। আমি তাই তাদের দেশের রাষ্ট্রদূতকে বললাম, আমাদের রকম পদ্মা সেতুটা এভাবে হঠাৎ করে বানচাল করে দিল, তোমরা আমাকে সাহায্য করতে পারবে কিনা? তারা বলল, নিশ্চয়ই পারব। তবে পদ্মা সেতুতে পারব না। কারণ এর সঙ্গে আমরা জড়িত, জাইকা জড়িত, এটাতে পারব না। আমি বললাম, আমাদের আরো অনেক রাস্তাঘাট, অবকাঠামো তৈরির সুযোগ আছে। তোমরা কি আমাদের সাহায্য করতে পারবে? আমাদের হূদয়ে একটু সাহস দাও। তারা বলল, অবশ্যই পারব এবং তখন তাদের তো কিছু দিতে হবে। আমি বললাম, আমার তো টাকাপয়সা নেই, আমি তোমাদের একটা জিনিস দিতে পারি।

এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৭৯ সালে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হওয়ার জন্য আমরা চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু জাপান বিভিন্ন দেশকে অর্থের বিনিময়ে প্রভাবিত করছিল। তখন আমরা হিসাব করে দেখলাম, ওদের জেতার সম্ভাবনা আছে। তবে এখানে বলে রাখি, আমরা ১৯৭৯ সালে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হওয়ার জন্য জাপানের সঙ্গে লড়াই করি এবং তখন আমরা জয়লাভ করি। জাপান হারে। তখন এলডিসি, জি৭৭-এর সদস্যরা আমাদের একচেটিয়াভাবে ভোট দেয়। তার ফলে আমরা জয়লাভ করি। তখন জাপান হারার ফলে তাদের দেশে একটা বিরাট সমস্য দেখা দেয়। জাপান তখন উঠতি অর্থনীতির দেশ। তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরখাস্ত হন।

বর্তমান সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী আমাকে জাপানের সঙ্গে নেগোসিয়েশন চালিয়ে যেতে বললেন। আমি নেগোসিয়েশন চালালাম। তারা রাজি হলো যে তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় আসবেন, প্রধানমন্ত্রীকে দাওয়াত দেবেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের দেশে যাবেন, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে দাওয়াত দেবেন। তিনি এখানে আসবেন এবং তখন আমরা বলব, ‘তোমাদের আমরা সমর্থন দেব।

এর মধ্যে বলে রাখি, শিনজো আবের সঙ্গে যখন আমার দেখা হয় তখন তিনি বললেন, ৭৯ সালে যখন আমরা হারি তখন জাপানের সরকার ছিল কোয়ালিশন সরকার। খুব দুর্বল একটি সরকার ছিল। এখন আমরা শক্তিশালী সরকার। দুই পরিষদেই আমার সিঙ্গেল মেজরিটি আছে। এখন আমি খুব শক্তভাবে ক্যাম্পেইন করব যেন আমি জিততে পারি। একই সঙ্গে তখন দুঃখ করে বললেন, যখন তারা বাংলাদেশের কাছে হারে তখন শিনজো আবের বাবা বড় একজন মন্ত্রী ছিলেনমিনিস্ট্রি অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড ট্রেড। হারার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন। এরপর তাকে অনেক কঠিন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, যা জাপানিরা করে না। ফলে গ্লানিটা তার ছিল। শিনজো বলেন, কিন্তু আমি বর্তমানে অনেক শক্তিশালী।

ওনার সঙ্গে আলাপ করে আমার ভালো লাগে। সে সময় নিরাপত্তা পরিষদের নির্বাচনের বিষয়ে জাপানের সঙ্গে ভালো বোঝাপড়া হয়। জাপান বলল, আমাদের দেশের মেগা প্রজেক্টগুলোয় তারা সহায়তা দেবে এবং বিলিয়ন ডলার দেয়ার অঙ্গীকারও করে। তখন জাপানের সঙ্গে আমাদের খুব

ভালো সম্পর্ক হয়। প্রধানমন্ত্রী সে দেশে যাওয়ার পর এটাকে কম্প্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ হিসেবে গ্রহণ করে। এরপর জাপান আমাদের প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার দেয়ার অঙ্গীকার করেছে এবং ১৮ বিলিয়ন ডলার তারা আমাদের এরই মধ্যেই দিয়েছে।

জাপানে আমাদের রফতানির পরিমাণ দশমিক বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং জাপান থেকে আমদানির পরিমাণ দশমিক বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমরা আমাদের বিনিয়োগ, পণ্য রফতানি বাজারে বৈচিত্র্য চাই। আমরা সম্ভাব্য সর্বোত্তম উপায়ে শিল্প ভোক্তা উভয় বৈশ্বিক বাজারেই সেবা দিতে চাই। বাংলাদেশ জাপানের সঙ্গে জোরদার, বিস্তৃত গভীর সম্পর্ককে গভীরভাবে মূল্যায়ন করে।

ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) প্রকল্প, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব (যমুনা) রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ী বন্দর প্রকল্প, মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের পূর্ণ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পরিকাঠামোগত ল্যান্ডস্কেপ বদলে যাবে। এশিয়ার মধ্যে জাপান বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি গন্তব্য। জাপান বাংলাদেশের মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্ক এখন এক ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত এক দশকে জাপানে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে এবং গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ১৩৫ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। জাপান বাংলাদেশের জন্য পঞ্চম বৃহত্তম আমদানি উৎস দেশ। জাপান থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি বছরে ২০০ কোটি ডলারের বেশি। আর বাংলাদেশে ১২তম বৃহত্তম বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) উৎস দেশ জাপান। দেশটির এফডিআই স্টক প্রায় ৪৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেবল ব্যবসায়িক দিক দিয়েই নয়। এর সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্কও ভালো। সম্প্রতি জাপান আমাদের অনেক লোককে জাপানি ভাষা শেখাচ্ছে এবং তাদের দেশে কাজ দিচ্ছে। জাপানের বেশির ভাগই সিনিয়র সিটিজেন। ফলে তাদের মেডিকেল হেল্প খুব প্রয়োজন। আমরা যদি আমাদের দেশের মানুষকে জাপানি ভাষা শেখাতে পারি তাহলে সে দেশে তাদের কর্মসংস্থান হওয়া সম্ভব। একটা কথা বলা ভালো, জাপানে যারা চাকরি করে, সেখানে কেউ ঠকে না। যথাসময়ে বেতন দেয়া এবং উন্নত জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দেয়। সম্পর্ক এখনই ভালো এবং সম্পর্ক আমরা উত্তরোত্তর আরো ভালো করতে চাই। অনেকগুলো প্রজেক্ট হাতে আছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে একটি ইকোনমিক জোন তৈরি করছে জাপান। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারেও একই পরিকল্পনা রয়েছে। জাপানি রাষ্ট্রদূত বলেছেন, প্রায় ৪০টি জাপানি কোম্পানি এখানে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে আমাদের উৎপাদন কর্মসংস্থান বাড়বে। রফতানিও বাড়বে। আমরা আশা করি প্রজেক্টগুলো সফল হবে এবং আমরা সুদিনের অপেক্ষা করছি।

 

. কে আব্দুল মোমেন: সংসদ সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন