সত্তরের পরাক্রমশালী ডাচরা চার বছরের ব্যবধানে দু-দুটি বিশ্বকাপ ফাইনালে হেরেছে। ১৯৭৪, ১৯৭৮ সালে হারের যন্ত্রণা লাঘবের সুযোগ এসেছিল ২০১০ সালে। স্পেনের সোনালি প্রজন্মের কাছে হেরে সেবারও হয়নি। ফাইনালে হারের দুঃখ সঙ্গী করে আরেকটি বিশ্বকাপ মিশনে আসা ডাচরা আজ কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হবে আর্জেন্টিনার। বিশ্ব ফুটবলের মহাতারকা লিওনেল মেসির প্রথম শিরোপা স্বপ্নের সামনে ডাচদের দুঃখ লাঘবের মিশন। তাই ডাচদের প্রথম শিরোপা জয়ের স্বপ্ন টিকে থাকলে শূন্য হাতে ফিরতে হবে মেসিকে।
বিশ্বের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার ভার্জিল ফন ডাইক বনাম সুপারস্টার লিওনেল মেসি, বিশ্বকাপের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কোচ লুই ফন গাল বনাম কনিষ্ঠ কোচ লিওনেল স্ক্যালোনি ও ইউরোপ বনাম লাতিন। লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে আজ ধ্রুপদি লড়াইয়ের সব রসদই তৈরি। অরেঞ্জ আর্মিদের সঙ্গে মেসিদের এ হাইভোল্টেজ লড়াই শুরু হবে বাংলাদেশ সময় রাত ১টায়।
আট বছর পর মুখোমুখি হচ্ছে আর্জেন্টিনা ও নেদারল্যান্ডস। বিশ্বকাপে দুই দলের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল লড়াইয়ের ইতিহাস। বৈশ্বিক মঞ্চে এখন পর্যন্ত পাঁচবার লড়াই হয় লাতিন ও ইউরোপের দুই ফুটবল জায়ান্টের। দুই দল সমান দুটি করে জয় পেয়েছে, আরেকটি লড়াই ড্র হয়।
১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডে নেদারল্যান্ডস ৪-০ গোলে, ১৯৭৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে ও ১৯৯৮ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডস ২-১ গোলে জয় পায়। এছাড়া ২০০৬ সালে গ্রুপ পর্বে ও ২০১৪ সালে সেমিফাইনালে দুই দলের লড়াই গোলশূন্য ড্র হয়। যদিও ব্রাজিল আসরে টাইব্রেকারে জয় পায় আর্জেন্টিনা।
বিশ্বকাপ জেতেনি এমন দলগুলোর মধ্যে সম্ভবত সেরা নেদারল্যান্ডস। তিনবার ফাইনালে পরাজিত হওয়া ছাড়াও তারা দুবার (১৯৯৮ ও ২০১৪) সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছে।
১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে প্রথমবার দেখা হয় নেদারল্যান্ডস ও আর্জেন্টিনার। সেবার আর্জেন্টিনাকে ৪-০ গোলে গুঁড়িয়ে দেয় ডাচরা। হল্যান্ড নামে খেলা ডাচরা সেবার ফাইনালে উঠলেও শিরোপা লড়াইয়ে জার্মানির কাছে হার মানে। চার বছর পর বুয়েন্স আয়ার্স ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ের খেলায় ডাচদের ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রতিশোধ নেয় আর্জেন্টিনা।
২০ বছর পর ফ্রান্স আসরের কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে বিদায় করে ডাচরা। সেবার সেমিফাইনালে অরেঞ্জ আর্মিরা পরাজিত হয় ব্রাজিলের কাছে। এরপর ২০০৬ ও ২০১৪ বিশ্বকাপে দুটি লড়াই ড্র হয়। ব্রাজিল আসরে টাইব্রেকারে আলাদা করা হয় দুই দলকে। তাতে ডাচদের হারিয়ে ফাইনালে ওঠে মেসির আর্জেন্টিনা।
মেসির স্বপ্নপূরণের পথে ডাচরা এখন বড় বাধা, তেমনি ডাচদের জন্যও দুঃখ বয়ে আনতে পারেন মেসি। ডাচ গোলকিপার আন্দ্রিস নোপার্ট অবশ্য মেসিকে মোকাবেলা করতে আত্মবিশ্বাসী। ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার এ গোলকিপার বলেছেন, সে তো আমাদের মতোই। সেও মানুষ।
ডাচদের শিরোপা ক্ষুধা নিয়ে অধিনায়ক ভার্জিল ফন ডাইক বলেন, ‘আমাদের সবার মধ্যেই শিরোপা ক্ষুধা প্রকট। সবার মধ্যে স্বপ্ন। বিশ্বকাপে অংশ নিলেই এ স্বপ্ন আপনার মধ্যে উঁকি দেবে। গৌরব থেকে আপনি তো মাত্র তিন ম্যাচ দূরে।’
আর্জেন্টিনা কোচ লিওনেল স্ক্যালোনি দারুণ এক ম্যাচের আশা করছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা উপভোগ্য একটি ম্যাচ হবে। কেননা আমরা এমন দুটি দল নিয়ে কথা বলছি, যারা আক্রমণে যায়, তেমনি রক্ষণও করে।’
ডাচদের এবার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ফন গাল। কাতার বিশ্বকাপের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কোচ ৭১ বছর বয়সী ফন গাল আয়াক্স, বার্সেলোনা, এজেড আল্কমার, বায়ার্ন মিউনিখ ও ম্যানইউর হয়ে মোট সাতটি লিগ শিরোপা জিতেছেন। যদিও জাতীয় দলের হয়ে বড় কোনো শিরোপা নেই।
ডাচ ডিফেন্ডার ডেনজেল ডামফ্রাইস সংবাদ সম্মেলনে কোচকে নিয়ে বলেন, ‘তিনি আমাদের মধ্যে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস এনে দেন। দলের প্রত্যেকেই জানে, তাকে কী করতে হবে। তিনি সর্বদা আমাদের ওপর নজর রাখেন এবং কোথায় উন্নতির প্রয়োজন তা দেখিয়ে দেন।’
২০২১ সালের আগস্টে ফ্রাংক ডি বোয়েরের জায়গায় দায়িত্ব দেয়া হয় ফন গালকে। তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি ডাচদের চিরায়ত বিশ্বকাপ দুঃখ ঘুচিয়ে ট্রফিটা দেশে নিতে পারবেন?
তিনবার ফাইনাল খেলেও শিরোপা ছোঁয়া হয়নি ডাচদের। এত বেশি ফাইনাল খেলেও শিরোপা না জেতার নজির আর কারো নেই। কমলা জার্সিধারীদের মতোই তাদের সমর্থকদের হূদয়ে তাই বড় ক্ষত। ফন গাল এ নিয়ে অল্প কথায় বলেন, ‘আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পারি।’
কাতার থেকে শিরোপা জিতে নেয়ার মতো রসদ আছে ফন গালের ভাণ্ডারে। লিওনেল মেসির মতো তারকা খেলোয়াড় দলে না থাকলেও ডাচদের ডিফেন্স কিন্তু সমীহ জাগানো। নিখুঁত ডিফেন্স নিয়ে এখন পর্যন্ত টুর্নামেন্টে মাত্র দুটি গোল হজম করেছে দলটি। আবার আক্রমণভাগে মেম্ফিস ডিপাই ও কডি গাকপো দলকে টানছেন।
তবে ব্যবধান গড়ে দিতে পারেন মেসি। বিশ্বকাপ জয়ের শেষ মিশনে নামা ৩৫ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড চলতি আসরে চার ম্যাচে তিন গোল করে আলবিসেলেস্তেদের কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে গেছেন। এ পথে আর্জেন্টিনার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন। ১৬৯ ম্যাচে তার গোল সংখ্যা ৯৪। মেসির ‘এক্স ফ্যাক্টর’ হয়ে ওঠার ওপরই নির্ভর করছে আর্জেন্টিনার সেমিফাইনাল ভাগ্য এবং পরিশেষে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের ভাগ্য।
২০১৪ সালে আর্জেন্টিনার কাছে শুটআউটে হেরেছে নেদারল্যান্ডস। এ নিয়ে ডাচ ফরোয়ার্ড ডিপাই বলেন, ‘২০১৪ সালে আমিও সেখানে ছিলাম, কিন্তু শট নিইনি। শট না নিলেও প্রচণ্ড চাপ ও উদ্বেগ ছিল। এর পরও বলব, পেশাদার ফুটবলার হিসেবে এসবের সঙ্গে আমাদের খাপ খাইয়ে নিতে হয়। আমরা এজন্য প্রস্তুতি নেয়ার চেষ্টা করছি। আমরা ৯০ মিনিটের মধ্যেই জয় তুলে নেয়ার চেষ্টা করব, কিন্তু কী ঘটবে তা আপনি জানেন না।’
১৯৯৮ সালে ডেনিস বার্গক্যাম্পের গোলে আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছিল ডাচরা। সেই স্মৃতিচারণ করে ডিপাই বলেন, ‘সেটা ছিল দেশের জন্য অবিস্মরণীয় এক মুহূর্ত। কী অসাধারণ গোল। মুহূর্তেই ম্যাচের ভাগ্য গড়া হলো। আমাদের বিশ্বাস, তেমনই এক মুহূর্তের ঝলকে আমরাও জিতে যাব। তবে অবশ্যই আমরা ভালো ফুটবল খেলব এবং আমাদের অবশ্যই ট্যাকটিক্যাল হতে হবে।’