আরো দুটি স্যাটেলাইট শহরের পরিকল্পনা

রাজউকের চলমান আবাসন প্রকল্পগুলো শেষ করা হোক

ঢাকায় ক্রমবর্ধমান আবাসনের চাপ মোকাবেলায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে পরিকল্পিত শহর হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তোলার জন্য যেসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন না হলেও নতুন করে আরো দুটি স্যাটেলাইট শহরের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা কতটা বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত সেটি নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে।

বণিক বার্তায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, নগরবাসীর আবাসিক সমস্যা সমাধানে রাজউক বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা হাতে নেয়। তবে এখন পর্যন্ত সরকারের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান কোনো আবাসন প্রকল্পই শেষ করতে পারেনি। অথচ এরই মধ্যে তারা আরো দুটি স্যাটেলাইট শহর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। এর আগে গ্রহণ করা পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প ঢাকার কেরানীগঞ্জে ঝিলমিল আবাসন প্রকল্প এখনো শেষ না হলেও রাজউকের তথ্যমতে, প্রস্তাবিত তুরাগ নদের বন্যাপ্রবাহ এলাকা, জলাশয় সংরক্ষণ কম্প্যাক্ট টাউনশিপ উন্নয়ন প্রকল্প এবং কেরানীগঞ্জ ওয়াটারফ্রন্ট স্মার্ট সিটি প্রকল্প দুটির সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে।

উল্লেখ্য, রাজউক ১৯৯৫ সালে রাজধানীর অদূরে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পটি হাতে নেয়। ২০১৩ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে এর মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ গাজীপুরের কালীগঞ্জে হাজার ১৫০ একর জমি নিয়ে নতুন শহর গড়ে উঠছে। এখানে প্রকল্পের অধীনে ২৫ হাজার প্লট হবে। অধিগ্রহণ জটিলতায় আট বছর পর ২০০৩ সালে প্রকল্পের ভূমি উন্নয়নকাজ শুরু হয়। সব মিলিয়ে ২৭ বছরে প্রকল্পের ৭২ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। দীর্ঘসূত্রতায় প্রকল্পের ব্যয়ও দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। যখন প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়, তখন হাজার ৩১১ কোটি টাকার মতো ব্যয় ধরা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। বাড়তি ব্যয়ের পুরোটাই প্লটগ্রহীতাদের বহন করতে হচ্ছে।

এরপর রাজউক ১৯৯৭ সালে ঢাকার কেরানীগঞ্জে ঝিলমিল আবাসন প্রকল্পটি হাতে নেয়। ২০০১ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল। এরপর দুই দশক পেরিয়ে গেলেও সংস্থাটি প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনি। একাধিকবার সময় বৃদ্ধি করায় এক্ষেত্রে ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ১৩৬ কোটি টাকা থাকলেও এখন তা ৩৩৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পটির আওতায় হাজার ৭৪০টি প্লট এবং নিম্ন মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য হাজার ৫০০টি অ্যাপার্টমেন্ট করার কথা রয়েছে।

আগের দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় খুব স্বাভাবিকভাবেই নগর পরিকল্পনাবিদরা রাজউকের আরো দুটি নতুন স্যাটেলাইট সিটি প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ এভাবে প্রকল্প প্রণয়ন করে পরে সেটি বাস্তবায়ন না হলে অর্থের অপচয় হয় এবং প্রকল্পের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। অবশ্য এক্ষেত্রে নগর পরিকল্পনাবিদদেরও ভিন্ন মত রয়েছে। তারা বলছেন, রাজউকের কাজ শুধু পরিকল্পনা প্রণয়ন নিয়ন্ত্রণ করা, কিন্তু সেটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাজউকের নয়। আবার রাজউক যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারছে না, সে হিসেবে ধরনের উন্নয়ন যদি করতে হয় তাহলে সরকারের সংশ্লিষ্ট যেসব সংস্থা রয়েছে তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা উচিত বলে নগর পরিকল্পনাবিদরা মত দিয়েছেন।

রাজধানী ঢাকা এমনিতেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে, তার ওপর নগরায়নের ক্ষেত্রে রাজউকের সমন্বয়হীনতা দুর্বলতার ফলে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে সেটি নিরসনে কত সময় লাগবে তা বলা দুষ্কর। অবস্থায় একের পর এক প্রকল্প গ্রহণ করে সেগুলো বাস্তবায়ন না করে নতুন প্রকল্প নেয়া হলে শুধু অর্থের অপচয় সময়ক্ষেপণ হবে এবং কার্যত কোনো উন্নয়ন দৃশ্যমান হবে না। এছাড়া রাজধানী হওয়ায় ঢাকার ওপর এমনিতেই আবাসনের চাপ বাড়ছে, সেক্ষেত্রে নতুন করে স্যাটেলাইট সিটির পরিকল্পনা ঢাকামুখী জনস্রোত যে আরো বাড়িয়ে তুলবে সেটি তো অনুমান করাই যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের চিন্তা না করে রাজধানীকেন্দ্রিক যেকোনো পরিকল্পনা প্রণয়নের আগে ঢাকার বসবাসযোগ্যতার কথা বিবেচনা করা উচিত। এক্ষেত্রে রাজউকের কার্যকর ভূমিকা পালনের কোনো বিকল্প নেই। মূলত রাজউক যে বিবেচনায় নতুন প্রকল্প গ্রহণ করছে, ঠিক একই বিবেচনা আগের প্রকল্পগুলোর বিষয়েও ছিল। সেক্ষেত্রে আগের প্রকল্প শেষ না করে কেন নতুন প্রকল্প শুরু করা হয়েছে সেটির কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা রাজউক থেকে পাওয়া যায়নি। নতুন প্রকল্পের ক্ষেত্রে যেসব সম্ভাব্যতার বিষয় বলা হয়েছে, বাস্তবতাগুলো পুরনো প্রকল্প গ্রহণ করার সময়েও ছিল। তাহলে কেন আগের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। এর সঠিক উত্তর না মিললে কয়েক বছর পর দেখা যাবে আদতে কোনো প্রকল্পই বাস্তবায়ন হয়নি। আবার বাস্তবায়ন না করেই নতুন প্রকল্প প্রণয়নের সংস্কৃতি চলতে থাকলে একের পর এক প্রকল্পই প্রণয়ন হবে, উন্নতি আর হবে না। বস্তুত বাংলাদেশে রকম অপরিকল্পিত উন্নয়নের নিদর্শন আমরা অতীতেও দেখেছি।

ঢাকা শহর এখন অত্যধিক জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত। বসবাসের অযোগ্য শহর হিসেবে প্রতি বছরই শহরের নাম উঠে আসছে। বস্তুত কাঙ্ক্ষিত কোনো উন্নতি এক্ষেত্রে দৃশ্যমান হচ্ছে না। সে হিসেবে জনগণের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য রাজউকের তত্পরতা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। মূলত সে কারণেই কেরানীগঞ্জে ঝিলমিল প্রজেক্ট থাকার পরও অদূরে ওয়াটারফ্রন্ট স্মার্ট সিটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প চলমান অবস্থায় তুরাগ নদের বন্যাপ্রবাহ এলাকা, জলাশয় সংরক্ষণ এবং কমপ্যাক্ট টাউনশিপ উন্নয়ন প্রকল্প একই কারণে নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ নাগরিকদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে রাজউক নতুন প্রকল্প গ্রহণ করতেই পারে, কিন্তু প্রকল্প যেন শুধু প্লট বরাদ্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে নাগরিকদের আবাসন সংকট দূর পরিকল্পিত নগরায়নে ভূমিকা রাখে আমরা সে প্রত্যাশাই করি। না হলে এসব প্রকল্পের পেছনে যে ব্যয়গুলো হবে সেটা শুধু অর্থের অপচয় হিসেবেই গণ্য হবে। প্রকৃত কোনো উপকারিতা জনগণের সম্মুখে দৃশ্যমান হবে না। আমরা আবাসন খাতে সংকট নিরসনে রাজউককে কার্যকর ভূমিকায় দেখতে চাই। প্রকল্পগুলোয় প্লট বরাদ্দের মাধ্যমেই দায়িত্ব পালন শেষ না করে রাজউক প্রকল্পগুলো শেষ করার ক্ষেত্রেও তদারক করবে সেটিই আমাদের কাম্য।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন