দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে জ্বালানি তেল কিনে রাখলে আজ সংকটে পড়তে হতো না

. এম শামসুল আলম জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল অনুষদের অধ্যাপক ডিন। কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা। এর আগে গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বিজ্ঞান প্রকৌশল অনুষদের অধ্যাপক ডিন ছিলেন। অধ্যাপনা করেছেন চুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগেও। প্রকাশ হয়েছে তার অনেক গবেষণা নিবন্ধ। সম্প্রতি বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের নানা দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

বাজেটে জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। পরিপ্রেক্ষিতে সার্বিক খাতটির জন্য নেয়া উদ্যোগের ব্যাপারে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দকৃত ভর্তুকির মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে ভর্তুকি ছিল হাজার কোটি টাকা। অথচ ২০২০ সালে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আদেশে ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এরপর গ্যাস খাত। চলতি বছর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির আদেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি ব্যয় নির্বাহে ভর্তুকি বরাদ্দ রয়েছে ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ৮৫০ এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি ধরে ২০১৯ সালে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির আদেশে ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এলএনজি আমদানির পরিমাণ কম হওয়ায় ২০২২ সালে রাজস্ব উদ্বৃত্ত থাকে হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। এসব তথ্যদিতে প্রকাশ পায়, বরাদ্দ অপেক্ষা ভর্তুকি বেশিও দেয়া হয়। আবার ব্যয় কম হওয়ায় রাজস্ব উদ্বৃত্তও থাকে। তাই ভর্তুকি কম বা বেশি বরাদ্দে কোনো কিছু যায় আসে না।

বলা হচ্ছে, জনগণকে স্বস্তি দেয়ার জন্য ভর্তুকি দেয়া বা বাড়ানো হয়। সেখানেই শুভঙ্করের ফাঁকি। তাই প্রথমে ভর্তুকি বাড়ানোর যে প্রসঙ্গটি এসেছে এর অন্তর্নিহিত তাত্পর্য বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। আমরা দেখেছি, ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে মূলত এলএনজি আমদানি ব্যয় নির্বাহের জন্য। অথচ এলএনজি আমদানি পর্যায়ে ভর্তুকি সমন্বয় না করে পেট্রোবাংলা পর্যায়ে সমন্বয় করে ঘাটতি তথা ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। জনগণকে স্বস্তি দেয়ার জন্য হলে ভর্তুকি সমন্বয় হতো এলএনজি আমদানি পর্যায়ে, পেট্রোবাংলা পর্যায়ে নয়। আবার বিদ্যুতে প্রায় কম-বেশি ৫৮ শতাংশ ঘাটতি মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে সমন্বয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। ১৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধি করে যদি বলা হয় ভোক্তাকে স্বস্তি দেয়া হলো, তাহলে সে বক্তব্য হবে বিভ্রান্তিকর। যদি তা- হতো, তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহূত ফার্নেস অয়েল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পরিবর্তে ব্যক্তি খাতের মাধ্যমে আমদানি করে প্রায় হাজার কোটি টাকা এবং শুল্ক-করাদি অব্যাহতি সুবিধা রহিত করে প্রায় হাজার কোটি টাকা ঘাটতি/ভর্তুকি বৃদ্ধি করতে হতো না।

দেখা যাচ্ছে, ঘাটতি বাড়ছে। সমন্বয়ে একদিকে আকাশচুম্বী মূল্যহার বৃদ্ধি ঘটছে, অন্যদিকে ভর্তুকি বৃদ্ধিও নিয়ন্ত্রণহীন। অথচ ঘাটতি কমানোর ব্যাপারে কারো কোনো গরজ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধিতে এখানকার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির রাজস্ব চাহিদা বা ব্যয় বাড়ে। তাদের মুনাফা বাড়ে। সরকারের রাজস্ব তথা কর-ভ্যাটও বাড়ে। মুনাফা শুল্ক-কর-ভ্যাট মূল্যহারভিত্তিক হলে একটি নির্দিষ্ট মূল্যহারের অধিক মূল্যহারে কর-ভ্যাট বাড়ত না। এমন বিধান না করে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুনাফা শুল্ক-কর-ভ্যাট বৃদ্ধির সুযোগ রেখে ঘাটতি বৃদ্ধি করে ভর্তুকি বাড়ানো কি গরু মেরে জুতা দান নয়? এখানে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে, অব্যাহত ভর্তুকি বৃদ্ধিতে ভোক্তার স্বস্তি প্রদান নয়, বরং অব্যাহত লুণ্ঠনমূলক ঘাটতি বৃদ্ধির বৈধতা দেয়া। আমাদের আপত্তি এখানেই। আমরা বলেছি, অন্যায়, অযৌক্তিক লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ঘাটতি বেড়েছে। সেই বিবেচনায় সবার আগে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় থেকে বিদ্যুৎ বা জ্বালানিকে মুক্ত করতে হবে। তাতে ঘাটতি অবশ্যই কমবে। ভর্তুকি মূল্যবৃদ্ধি উভয়ই কমে আসবে।

আমরা প্রস্তাব করেছি, ছয় মাস মুনাফা শুল্ক-কর-ভ্যাট স্থগিত করে মূল্যবৃদ্ধি ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণ করা হোক। অথচ জ্বালানি পণ্যের আমদানি ব্যয়বৃদ্ধির কারণে বাড়তি মুনাফা শুল্ক-কর-ভ্যাট সমন্বয় করে ঘাটতি বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে। আর সেই ঘাটতি সমন্বয়ে গ্যাসে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকিসহ ভোক্তা পর্যায়ে প্রায় ২৩ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি করা হলো। একই সঙ্গে অনুরূপ ঘাটতি সমন্বয়ে বিদ্যুতেও ভর্তুকি মূল্যহার বৃদ্ধি হবে। তবে এখানে মূল্য ভর্তুকি বৃদ্ধি কোনো মৌলিক বিষয় নয়। মৌলিক বিষয় হলো অন্যায়, অযৌক্তিক লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বা ঘাটতিটাকে বৈধতা দেয়া। অবস্থায় বাজেটে কত ভর্তুকি বাড়ানো হলো সেটি ভোক্তার আগ্রহের বিষয় নয়।

দেশে বিদ্যুৎ খাতে রাষ্ট্রীয় দেনা ক্রমেই বাড়ছে। আসলে আমরা কোনদিকে যাচ্ছি?

বিদ্যুতের দায়-দেনা, প্রাথমিক জ্বালানির দায়-দেনা কিংবা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দায়-দেনার উত্পত্তি অসম শর্তে লুণ্ঠনমূলক মুনাফায় বিনিয়োগ এবং ঋণচুক্তি থেকে।

সার্বিক দিক থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির কথা যদি ভাবেন, তাহলে দেখবেন পিডিবি ব্যতীত রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ১২ শতাংশ, যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি ১৬ শতাংশ এবং বেসরকারি কোম্পানি কম-বেশি ১৮ শতাংশ মুনাফা পায়। বিইআরসির স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী বর্তমানে নির্ধারিত সুদ/মুনাফা দশমিক ১৮ শতাংশ। কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই যদি এমন বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয় এবং উচ্চ হারে মুনাফা দেয়া হয়, তাতে ঋণের বোঝা বৃদ্ধি অবধারিত।

এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে ভারতে যে অর্থ লাগে, আমাদের দেশে তার থেকে দেড়-দ্বিগুণ বেশি অর্থ লাগে। এই যে, ৫০-১০০ শতাংশ বেশি ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বাড়ালাম, বাড়তি ব্যয় অন্যায়, অযৌক্তিক লুণ্ঠনমূলক। প্রক্রিয়ায় যদি চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীনভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বাড়তে থাকে এবং সে-উৎপাদনক্ষমতা স্বল্প ব্যবহারের কারণেও যদি লোকসান হয় তাহলে তো হাজার হাজার কোটি টাকার দায়ভার সৃষ্টি এবং তা জনগণের ঘাড়ে পড়ার জন্য আর অন্য কারণ লাগে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি এমনটা হয়, তাহলে তা বড়ই বিপজ্জনক। গণশুনানিতেও বলেছি, খুলনা পায়রা বিদ্যুৎ প্লান্টের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়বৃদ্ধি অস্বাভাবিক এবং তাতে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় সম্পৃক্ত। বিশেষ করে এই দুই প্লান্টের টেকনিক্যাল অডিট করানোর কথা বলেছি। কিন্তু -কথা কেউই আমলে নেয়নি। বরং লুণ্ঠনমূলক ব্যয়জনিত ঘাটতির বৈধতা দেয়া হয়েছে। সেই ঘাটতি সমন্বয়েই ভর্তুকি মূল্যবৃদ্ধি। আরো বেশি ঘাটতি সমন্বয়ে বাজেটে গতবারের তুলনায় এবার আরো বেশি ভর্তুকি বরাদ্দ রয়েছে। ফলে রাষ্ট্র বেশি বেশি দেনা দায়গ্রস্ত তথা দিশেহারা হতে বাধ্য।

গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোরও তোড়জোড় চলছে...

বিদ্যুৎ জ্বালানির দাম বাড়ানোই হলো মূলত সরকারের কৌশলগত বা নীতিগত অবস্থান। কারণ দাম বাড়ালেই কোম্পানিগুলোর মুনাফা এবং সরকারের রাজস্ব আরো বাড়ে। সবচেয়ে বড় কথা, গ্যাসের মূল্যহার একসঙ্গে ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি এক নজিরবিহীন ঘটনা। স্বীয় সক্ষমতায় নিজস্ব গ্যাস উৎপাদনে মনোযোগী না হয়ে টাকা মূল্যহারের গ্যাস ৮৩ টাকায় স্পট মার্কেট থেকে আমদানিতে আমরা মনোযোগী। এই হলো জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় গৃহীত কৌশল। বিদ্যুৎ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির জন্য এর থেকে উত্তম কৌশল আর কী হতে পারে! আমরা যদি উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি গ্যাসের মজুদ বাড়াতে পারতাম তাহলে আজকের সংকট তৈরি হতো না। ভর্তুকি মূল্যবৃদ্ধি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে থাকত। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ভর্তুকি মোটেও সহায়ক নয়, বরং লুণ্ঠনমূলক ব্যয়বৃদ্ধির সুরক্ষা কবচ।

আমাদের বিদ্যুৎ খাতে উদ্বৃত্ত উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। চাহিদা কম। কারণে ব্যয়টাও বেশি হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের পরিকল্পনায় ভুলও ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এটা কি ম্যানেজ করার আর সুযোগ নেই?

ম্যানেজ করার সুযোগ অবশ্যই আছে। কেবল উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি নয়, উৎপাদনকারীর সক্ষমতা পরিকল্পনায় জাতীয় দক্ষতা বৃদ্ধি হতে হবে। আমরা যদি ভোক্তা অধিকারকে আমলে নেই, উত্তম বিদ্যুৎ সেবা প্রদানের নিমিত্তে মূল্যহার নির্ধারণে ন্যায্য যৌক্তিক ঘাটতি সমন্ব্বয় করি এবং অসমন্বয়কৃত ঘাটতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিয়োজিত কোম্পানি/লাইসেন্সিদের পুঞ্জীভূত মুনাফা সরকারি অনুদানে সমন্বয় করি তাহলে জাতীয় সক্ষমতা দক্ষতা উন্নয়ন হয় এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন লুণ্ঠনমূলক ব্যয়মুক্ত হয়। ফলে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে থাকে, ভোক্তাও মানসম্মত সেবা পায়। এমনটি আইনেও বলা আছে। ভোক্তাকে স্বল্পমেয়াদে, মধ্যমেয়াদে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সেবা দেয়ার লক্ষ্যে উৎপাদনক্ষমতা অব্যাহত বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি অব্যাহত আছে, অথচ তার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তার অর্থ, বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতার উল্লেখযোগ্য অংশ অব্যবহূত থেকে যাচ্ছে। এটি একটা দিক। দ্বিতীয়ত, যে চাহিদা প্রক্ষেপণের ভিত্তিতে উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি হয়েছে, সে প্রক্ষেপণ ত্রুটিপূর্ণ থাকায় যে বাড়তি উৎপাদন ব্যয়, তার দায়ভার ভোক্তার ওপর বর্তাবে না। বিবেচনায় আনুপাতিক হারে অবচয় ব্যয়/ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় লাইসেন্সি অথবা সরকারের ওপর যদি বর্তায়, তাহলে সঠিক উৎপাদন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং ওই পরিকল্পনা লুণ্ঠনমূলক ব্যয়মুক্তির কৌশল গ্রহণ বাস্তবায়নে লাইসেন্সি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। ফলে তাদের উভয়েরই দক্ষতা সক্ষমতা উন্নয়ন নিশ্চিত হবে এবং জবাবদিহি বাড়বে। তবে তা হতে হলে বিদ্যুৎ জ্বালানি উভয় বিভাগকে স্বার্থসংঘাত মুক্ত হতে হবে।

সরকার বলছে, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে। সেখানে শিল্পায়ন হবে, বিদেশী বিনিয়োগ আসবে। সেখানে বাড়তি বিদ্যুতের দরকার হবে। তখন ওই বিদ্যুৎ কাজে লাগবে। সেটা আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখছি, যাতে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হয়?

খুব ভালো কথা। তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। অর্থনৈতিক অঞ্চলের কর্মকাণ্ড শুরু না হওয়া পর্যন্ত ওই বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ব্যবহার হচ্ছে না। তার জন্য আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার কেন ভোক্তা সাধারণকে বহন করতে হবে? যখন অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভোক্তা আসবেন, তারা যখন বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, তখন উৎপাদনক্ষমতা কাজে আসবে। তারা বিদ্যুৎ বিল দেবেন। বাড়তি উৎপাদনক্ষমতা তাদের জন্য তৈরি হয়েছে, তাহলে আমাদের কেন ওই বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতার জন্য বাড়তি ব্যয় বহন করতে হবে? লুণ্ঠনের -এক অভিনব কৌশল!

বলা হয়েছিল, বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র এলে কুইক রেন্টাল বা রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা হবে। এখন তো বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে, অথচ সেগুলো এখনো বন্ধ করা হয়নি?

কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র এসেছে। এখন তাদের বসিয়ে রেখে ছোট কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ নেয়ার জন্য নানা অজুহাত দেখানো হচ্ছে। সেসব কোনো অজুহাত কারিগরি বিবেচনায় ন্যায্য যৌক্তিক নয়। রেন্টাল বিদ্যুৎ কেনা-বেচা অবৈধ এবং অসাধু ব্যবসা ছাড়া অন্য কিছু নয়। ব্যবসায় গোড়া থেকে যারা লাভবান হয়েছেন, তাদের মধ্যে কারো কারো লাভবান করা অব্যাহত রাখতেই কিছু কুইক রেন্টাল বা রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা হয়নি। বিদ্যুতের ট্যারিফ নির্ধারণের এখতিয়ার বিইআরসির। বিদ্যুৎ বিভাগ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসির কাছে পাঠিয়েছিল ব্যাপারে অনাপত্তি দেয়ার জন্য। তবে বিইআরসি বলেছে, গণশুনানি ছাড়া তাদের পক্ষে অনাপত্তি দেয়া সম্ভব নয়। তাছাড়াও গণশুনানির ভিত্তিতে এর আগের আদেশে বিইআরসির সিদ্ধান্ত রয়েছে, মেয়াদ শেষে তরল জ্বালানিভিত্তিক রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ আর বৃদ্ধি করা যাবে না। অথচ মেয়াদ বৃদ্ধি হয়েছে এবং বিইআরসির অনাপত্তি ছাড়াই ওই বিদ্যুৎ কেনা-বেচাও হচ্ছে। আবার এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ব্যয় মূল্যহারে সমন্বয় করে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এখন প্রক্রিয়াধীন। যে বিদ্যুৎ ক্রয়ে বিইআরসির আপত্তি রয়েছে, সেই বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ব্যয় মূল্যহারে সমন্বয় করা বিইআরসির এখতিয়ার বহির্ভূত।

কুইক রেন্টালের মাধ্যমে কয়েকজন ব্যবসায়ী সুবিধা নিচ্ছেন। কিন্তু বিদ্যুতের দাম বাড়ালে সব ব্যবসায়ীর ওপরই প্রভাব পড়ে। তাদের উৎপাদনের ওপর প্রভাব পড়ে। ব্যবসায়ীরাও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিপক্ষে কথা বলছেন। আপনার বিশ্লেষণ কী বলে?

তারা একসময় বলেছে, আমরা বিদ্যুৎ চাই, দাম যত বেশি হোক দেব। কিন্তু গত শুনানিতে এফবিসিসিআই বলেছে, বিদ্যমান সংকটে মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাত মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। যদি মূল্যবৃদ্ধি করতেই হয়, তাহলে তাদের একটা গ্রেস পিরিয়ড দিতে হবে। করোনাকালে তাদের খারাপ সময় গেছে। সেটা পুষিয়ে নিতে তাদের একটু সময় দরকার। এদিকে গ্যাসের মূল্য নজিরবিহীন ২৩ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বের কোথাও একবারে এত বেশি মূল্য বাড়ে না। কিন্তু সেই মূল্যবৃদ্ধির পরে তারা কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেয়নি। বরং স্বাগত জানিয়েছে বলা যায়। অন্যভাবে বলতে পারি, ব্যয় বাড়লে পণ্যের দামও বাড়ে। সুতরাং তাদেরও ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ে। তবে বাজারে প্রতিযোগিতা থাকলে ঝুঁকি আরো বাড়ে। কিন্তু এফবিসিসিআইয়ের বক্তব্যে মনে হয়, তারা এত বেশি মুনাফা করে যে গ্যাসে ২৩ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি তাদের জন্য কোনো সমস্যা নয়। তবে তাদের ধরনের প্রতিক্রিয়া আসলেই বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন করে কিনা আমার পক্ষে তা বলা কঠিন।

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি হলে রফতানি পণ্যের মূল্যও বাড়বে। সেক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় কতটা প্রভাব পড়বে?

রফতানিকারকরা তখন আর্থিক সুবিধা পান, যখন মূল্যস্ফীতি হয়, যখন ডলারের দাম বাড়ে। ফলে টাকার মান কমে। এতে রফতানিকারকদের আয় বেড়ে যায়। কিন্তু ভোক্তার আয় কমে যায়। দুদিক থেকে ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হন। একদিকে ভোক্তার আয় কমে। অন্যদিকে বাড়তি দামে তাকে পণ্য সেবা কিনতে হয়। তার ক্রয়ক্ষমতা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। আমরা সাধারণভাবে মনে করি, উপযোগের মূল্য বাড়লে ব্যবসায়ীরা ঝুঁকিতে পড়েন। বাস্তবে তারা ঝুঁকির মধ্যে পড়েন না। কারণ অভ্যন্তরীণ বাজার প্রতিযোগিতামূলক নয়। কাজেই এসব বিষয় মোকাবেলা করতে তারা নিজেদের মতো করে সব ক্ষেত্রে আয় বেশি বাড়িয়ে নেয়। তবে এমন অবস্থা সাময়িক। টেকসই নয়। অবশেষে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার অনিশ্চয়তা বাড়বেই।

বিদ্যুৎ খাতের প্রাথমিক জ্বালানিতে পুরোটাই আমরা আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছি। আমদানিনির্ভরতার কারণে পাকিস্তানে দেখা যাচ্ছে জ্বালানি জোগান দিতে না পারায় উৎপাদনক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ভুগতে হচ্ছে। আমাদেরও কি রকম পরিস্থিতি তৈরি হবে না?

আমরা সে রকম পরিস্থিতির মধ্যেই আছি। আমরা আসলে তথ্য বিভ্রাটের মধ্যে আছি। পাকিস্তানের তথ্য আমরা পাই। কতবার বিদ্যুৎ যায়, কতক্ষণের জন্য যায় আসে আমাদের বেলায় এমন সব তথ্য অজানা। সাভার পিবিএস হলো সমৃদ্ধ পিবিএসগুলোর একটি। একাধিক উৎস থেকে বিদ্যুৎ ইমপোর্ট হয়। সেই সাভার পিবিএসে দিনে কতক্ষণ বিদ্যুৎ থাকে, সেখানে কতবার বিদ্যুৎ যায়-আসে, সে ব্যাপারে সমীক্ষা চালানো হলে জানা বোঝা যাবে আমরা পাকিস্তানের চেয়ে কতটা ভালো অবস্থায় আছি। মফস্বলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি একবারেই ভিন্ন। প্রাথমিক জ্বালানিতে আমরা এখনো পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হইনি। তবে অচিরেই হব। তখন কি বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নতি হবেএমন প্রত্যাশার কোনো সুযোগ নেই।

ইউক্রেন সংকটে জ্বালানি বাজারে দোদুল্যমানতা তৈরি হয়েছে। দাম বেড়ে গেল। জ্বালানি তেল বা এলএনজি পাওয়া যায় না রকম সংকট দেখা দিল। কারণে চীন ভারত রাশিয়া সস্তা তেলের বিপুল মজুদ গড়ে তুলেছে। আমরা কি এটা পারি না?

আমরা প্রশ্ন তুলেছিলাম। একটা চাপও তৈরি হয়েছিল। করোনাকালে জ্বালানি তেল এলএনজির দাম পড়ে যায়। আমরা বলেছিলাম, সরকারি-বেসরকারিভাবে আমাদের যতটুকু মজুদ করার ক্ষমতা আছে, ততটুকু আমরা মজুদ করতে পারি। সরকারের হাতে তখন ৪৩ হাজার কোটি টাকা ছিল। আমদানি পর্যায়ের দরপতন জ্বালানি তেলের মূল্যহারে সমম্বয় না করায় ওই টাকা কয়েক বছর ধরে জমা হয়। সেই টাকায় জ্বালানি মজুদ করলে কিংবা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় বিদেশে কিনে রাখা হলে আমরা আজ সহজেই জ্বালানি সংকট মোকাবেলা করতে পারতাম। অথচ আমাদের সে প্রস্তাব কেউই আমলে নেয়নি।

২০২৬ সালে আমরা উন্নয়নশীল দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে পদার্পণ করব। সেক্ষেত্রে আমাদের জ্বালানির মজুদ কাঠামো তৈরি করা দরকার ছিল। আমরা কি সেটা করেছি?

আমরা তো তা করছি না। উত্তরোত্তর আমরা অনেক বেশি আমদানিনির্ভর হচ্ছি। তাতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ঝুঁকি বাড়ছে। টাকার গ্যাস ৮৩ টাকা দিয়ে কিনেছি। নিজের গ্যাস নিজে উৎপাদন করলে প্রতি ঘনমিটারে ব্যয় হয় টাকা পয়সা। তা না করে ৮৩ টাকা দিয়ে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করে ব্যবহার করি। আগামীতে আমরা টাকা পকেটে নিয়ে দেশে দেশে জ্বালানি কেনার জন্য ঘুরব, কিন্তু পাব না। আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের লোকজন কি সে ব্যাপারে কোনো ভাবনা-চিন্তা করেন? মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলে বিদ্যুৎ জ্বালানিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা কি সম্ভব হবে? সেসব বিষয় আমাদের আদৌ বিবেচনায় আছে বলে মনে হয় না।

সরকার বলে যে, ভারত কিংবা নেপালের চেয়ে আমাদের দেশে বিদ্যুতের দাম কম। এটা কি সত্য?

এখনো বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস কম-বেশি ৬০ শতাংশ ব্যবহার হয়। জ্বালানি ব্যয় ধরেই বলা হয়, বিদ্যুতের মূল্য কম। জ্বালানি ব্যয় ব্যতীত প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিচালন ব্যয়, বিনিয়োগ ব্যয়, ক্যাপাসিটি চার্জ বা অবচয় ব্যয় বাংলাদেশের তুলনায় কোন কোন দেশে বেশি, সেটি বিবেচনায় নিন। তারপর বলুন বাংলাদেশে বিদ্যুতের দাম কম। তাছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় ভারিত গড়ে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অপেক্ষা অনেক কম। ভারত থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অপেক্ষা অনেক কম। অতএব আমাদের বিদ্যুতের দাম কম, এমন বক্তব্য সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছু নয়।

অবস্থা থেকে কীভাবে পরিত্রাণ মিলবে?

অবশ্যই মিলবে। ক্যাব ভোক্তা পক্ষ থেকে জ্বালানি রূপান্তর নীতি ২০২২ প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবিত নীতি বাস্তবায়নে গৃহীত কর্মপরিকল্পনায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে বিদ্যুৎ খাত সংস্কারে ১১ দফা এবং গ্যাস খাত সংস্কারে ২৫ দফা প্রস্তাব করেছে। সরকার সেসব প্রস্তাব আমলে নিলে এবং বাস্তবায়ন করলে অবশ্যই এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন