নগদ সহায়তাপ্রাপ্তদের ৩৯.৫ শতাংশই টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড পায়নি

সুফলভোগী চিহ্নিতকরণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হোক

সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির মাধ্যমে সরকার নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে ফ্যামিলি কার্ডের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে সাধুবাদযোগ্য। বস্তুত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে দরিদ্র মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে এমন পদক্ষেপ জরুরি ছিল। কিন্তু শুক্রবারের বণিক বার্তায় প্রকাশিত দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত এক গবেষণা জরিপে ফ্যামিলি কার্ড নিয়ে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। এতে বলা হয়েছে, হাজার ৫০০ টাকা করে নগদ সহায়তাপ্রাপ্ত ব্যক্তির মধ্যে ৩৯ দশমিক শতাংশ ফ্যামিলি কার্ড পায়নি। ফ্যামিলি কার্ড তৈরিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন; যাদের ৯০ শতাংশই ক্ষমতাসীন দলের। প্রকৃত গরিবদের কার্ড না দিয়ে যদি অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবার নিজেদের আত্মীয়-স্বজনকে কার্ড দেয়া হয়, সেটা দুর্ভাগ্যজনক। এক্ষেত্রে প্রতিটি প্রকৃত গরিব প্রান্তিক পরিবার যাতে স্বল্প দামে প্রয়োজনীয় পণ্য পায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে কার্ডের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ডিলারসহ কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

টিআইবির গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে ৩৫ জেলা থেকে হাজার ৪৭ উপকারভোগীর সাক্ষাত্কার গ্রহণের মাধ্যমে। উত্তরদাতাদের অধিকাংশই মনে করেন, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে তারা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি আর ১৪ শতাংশ তাদের বাদ পড়ার কারণই জানেন না। গবেষণা থেকে পাওয়া যায়, উপকারভোগীদের বাদ পড়ার পেছনে ফ্যামিলি কার্ড সম্পর্কে তথ্য না জানা, তালিকা তৈরিতে স্বচ্ছতার ঘাটতি, সচ্ছল ব্যক্তিকে কার্ড দেয়া, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আত্মীয়-স্বজনকে কার্ড দেয়া, তদ্বির না থাকা, রাজনৈতিক বিবেচনা ইত্যাদি কারণ হিসেবে কাজ করেছে। এদিকে ফ্যামিলি কার্ড পাওয়া উপকারভোগী ব্যক্তিদের শতাংশ শিকার হয়েছেন অনিয়ম-দুর্নীতির। ক্ষেত্রবিশেষে কার্ড পেতে ৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়েছে তাদের। আবার এমনও হয়েছে, উপকারভোগী বাছাই কমিটির সদস্য নন, এমন ব্যক্তিও কার্ড প্রদান করেছেন। এসব অনিয়ম বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত নেয়াই যে যথেষ্ট নয়, তার বাস্তবায়নই আসল কথাএর প্রমাণ পাওয়া গেছে বিপুলসংখ্যক উপকারভোগীর কার্ড না পাওয়ার মধ্য দিয়ে। এমনটা কেন হলো তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারণ সব উপকারভোগীই তালিকাভুক্ত। তালিকার নাম ধরে ধরে কার্ড বিতরণ করলেই সমস্যা থাকার কথা নয়। আসলে দুর্নীতি অনিয়ম যেখানে বাসা বাঁধে, সেখানে সহজ কাজটাও ঠিকমতো করা যায় না। এখন দরকার কারণগুলো চিহ্নিতপূর্বক সমাধানে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া।

ভারতে রেশনের মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহ প্রকল্পের পোশাকি নাম জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা মিশন কেন্দ্রের প্রকল্পের আওতায় রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের কোটি লাখ রেশনগ্রহীতা। প্রকল্পে ভর্তুকি দিয়ে টাকা কেজি দরে চাল টাকা কেজি দরে গম সরবরাহ করে কেন্দ্র। প্রায় প্রতিটি রাজ্যই প্রকল্প অনুসরণ করে রেশন ব্যবস্থা চালায়। কিন্তু দেশজুড়ে করোনার প্রবল দাপট শুরু হলে অর্থকষ্টে ভুগতে থাকা সাধারণ মানুষকে খানিক সুরাহা দিতে নতুন রেশন নীতি গ্রহণ করে পশ্চিমবঙ্গসহ ১২টি রাজ্য। ২০২০ সালের এপ্রিলে মমতা সরকার ঘোষণা করে রেশনের মাধ্যমে যে চাল-গম দেয় কেন্দ্র, তাতে অতিরিক্ত ভর্তুকি দিয়ে বিনামূল্যে তা সরবরাহ করবে রাজ্য খাদ্য দপ্তর। নতুন উদ্যোগকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় দুয়ারে রেশন প্রকল্প চালু করে। অর্থাৎ রেশনের চাল-গম শুধু বিনামূল্যেই নয়, তা গ্রাহককে দরজায় পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বও নেয় সরকার। দেশটিতে আধার কার্ড রয়েছে, যার মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য জনগণ পেয়ে থাকে। ভারত সরকার নাগরিকদের জন্য সুনির্দিষ্ট সরকারি সুবিধা ভর্তুকি বরাদ্দের প্রক্রিয়া অধিক যৌক্তিকীকরণ এবং এতে স্বচ্ছতা আনার জন্য আধার কার্ড প্রবর্তন করেছে। এখন এর সুবিধা ব্যবহার দায় পরিশোধ বা পেমেন্ট ব্যবস্থা, কর নিয়ন্ত্রক এবং আরো অনেক কিছু হিসেবে আবর্তিত হয়েছে। ফলে ভারতীয় সব নাগরিকের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিলে পরিণত হয়েছে। ফলে সুবিধাভোগী নির্বাচন ভুল ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির সমস্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা গিয়েছে বলে খবর মিলছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, ডিজিটাল অবকাঠামো সৃষ্টিতে আধার কার্ডের প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে আর্থিক সামাজিক বিনিময় ঘটছে।

অতীতের অনেক সরকারি ত্রাণ কর্মসূচিকে আমরা দুর্নীতির কবলে পড়তে দেখেছি। ফ্যামিলি কার্ড বিতরণের উদ্দেশ্য দুর্নীতি ঠেকানো। তবে এটি কেবল তখনই সুফল দিতে পারবে যখন ফ্যামিলি কার্ড দেয়ার জন্য পরিবার নির্বাচন বিতরণ প্রক্রিয়াকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক পক্ষপাত এড়াতে এবং সুবিধাভোগী তালিকা তৈরির প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কঠোর সরকারি তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা বারবার রাজনৈতিক নেতাদের জাতীয় কর্মসূচিগুলো নিয়ে সতর্ক করেছেন। কারণ এটি প্রায়ই দরিদ্রদের তাদের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছে। স্থানীয় প্রশাসনের উচিত কার্ড পাওয়ার যোগ্য সুবিধাবঞ্চিত পরিবারগুলো নিয়ে তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা। পূর্ববর্তী ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে আমরা প্রায়ই অব্যবস্থাপনা অন্যান্য সমস্যার কারণে দীর্ঘ লাইন বিশৃঙ্খলা দেখেছি। ধরনের সমস্যা এড়াতে সরকারের উচিত আগে থেকেই ব্যবস্থা নেয়া। সরকার যদি ব্যবস্থাগুলো সঠিকভাবে নিতে পারে তবে কর্মসূচি নিশ্চিতভাবেই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করবে। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রকৃত অনেক উপকারভোগী বাদ পড়েছেন। তালিকা প্রণয়ন কার্ড বিতরণে বেশি ঘাটতি ছিল। এক্ষেত্রে সুফলভোগী বাছাইয়ে আরো স্বচ্ছতা জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

ফ্যামিলি কার্ড চালুর শুরুতে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার কিছু অব্যবস্থাপনাগত হলেও অনিয়মের বিষয়গুলো দুর্ভাগ্যজনক। বিশেষ করে কার্ড বিতরণ ডিলার নিয়োগে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে তাতে ভালো উদ্যোগটি কেবল প্রশ্নের সম্মুখীনই হবে না; একই সঙ্গে এর সুফলও যাদের পাওয়া উচিত, তাদের কাছে পৌঁছবে না। আমরা জানি, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় অন্য যেসব ভাতা রয়েছে সেগুলোয়ও অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। এমনকি করোনা মহামারীর মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী ৫০ লাখ পরিবারকে যে প্রণোদনা দিয়েছেন, সেখানেও যাদের প্রয়োজন নেই এমন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোক ওই নগদ পেয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। বলাবাহুল্য, টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের বিষয়কে সেভাবে দেখার সুযোগ নেই। অসাধু কোনো ডিলার যেন এক্ষেত্রে নিয়োগ না পায়, তাও নিশ্চিত করা দরকার। একটি পরিবারে দুটি কার্ড পাওয়া কিংবা প্রকৃত দরিদ্র পরিবারের কেউই কার্ড পাবে নাউভয়ই অন্যায়। কার্ড নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রাকের জন্য দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়টিও কাম্য নয়।

প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সরকারের ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে সহায়তা পৌঁছে দিতে টিআইবি কয়েকটি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে জনপ্রতিনিধি কর্তৃক উপকারভোগীদের প্রাথমিক তালিকা তৈরির পর ওয়ার্ড সভার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের মতামতের ভিত্তিতে তালিকা চূড়ান্ত করা; নারী, প্রতিবন্ধী, দলিত, আদিবাসী প্রভৃতি প্রান্তিক দুর্গম এলাকার জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা; শুধু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ এবং বিতরণের সময়, তারিখ স্থান ইত্যাদি তথ্য সব পর্যায়ে প্রচারের ব্যবস্থা; বিনামূল্যে তালিকাভুক্তি কার্ড বিতরণে অর্থ লেনদেন না করার বিষয়ে উপকারভোগীদের সচেতন করতে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে স্বচ্ছতা জবাবদিহির জায়গাটিতে সরকারকে আরো নজর দিতে হবে। যেসব অঞ্চলে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে এসব কাজে সংযুক্ত করা যেতে পারে। অসাধু কোনো ডিলার যেন এক্ষেত্রে নিয়োগ না পায়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। যদিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে, ফ্যামিলি কার্ড তৈরি বা বিতরণে অনিয়ম হলে তা অবশ্যই খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে হবে। প্রতিটি প্রকৃত গরিব প্রান্তিক পরিবার যাতে স্বল্প দামে প্রয়োজনীয় পণ্য পায়, সে ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে কার্ডের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন