আক্রান্তদের অর্ধেকেই জানে না তাদের ডায়াবেটিস আছে

ফখরুল ইসলাম

বিশ্বে প্রায় ৪৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে ৭৯ শতাংশেরই নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে বসবাস। রোগে বছরে মারা যাচ্ছে ১৫ লাখ মানুষ। কয়েক দশক ধরে ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে মোট মৃত্যুর নবম কারণ ডায়াবেটিস। বিশ্বজুড়ে অসংক্রামক রোগের মধ্যে এটি অন্যতম।

বাংলাদেশ জনমিতি স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ তথ্য অনুযায়ী, দেশে কোটি ১০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ১৮-৩৪ বছর বয়সীদের মধ্যে সংখ্যা ২৬ লাখ। আর ৩৫ বছর তার চেয়ে বেশি বয়সীদের মধ্যে ৮৪ লাখ মানুষ রোগে আক্রান্ত। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়, এসব আক্রান্ত ব্যক্তির অর্ধেকেই জানে না তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। যখন শরীরের অন্যান্য জটিলতা দেখা দেয় তখনই কেবল চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন রোগীরা। এর পরই ডায়াবেটিসের উপস্থিতির বিষয়টি ধরা পড়ে।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ডা. কে আজাদ খান বণিক বার্তাকে বলেন, রোগ নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে ডায়াবেটিস সম্পর্কে তাকে শিক্ষিত হতে হবে। যেমন একটা লোকের ইনসুলিন নিতে হচ্ছে, এখন সে করে কী যখন খায় তখন ইনসুলিন নেয় না, আবার যখন খায় না তখন ইনসুলিন নিয়ে নেয়, তাহলে এটি সাংঘর্ষিক হয়ে গেল না? কারণ যদি ইনসুলিন বাইরের থেকে দিই সে তো কাজ করবেই! সে মুহূর্তে না খেলে হাইপো হয়ে যাবে তার। কারণ একজন সুস্থ লোকের যতখানি ইনসুলিন দরকার শরীরে ঠিক ততখানি ইনসুলিন তৈরি করে। যেটা ডায়াবেটিসের রোগীরা কখনো পারে না।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ডায়াবেটিসের চারটি প্রকার রয়েছে। এগুলো হলো টাইপ-, টাইপ-, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস অন্যান্য নির্দিষ্ট কারণভিত্তিক ডায়াবেটিস।

সাধারণত ৩০ বছরের কম বয়সীদের টাইপ- ডায়াবেটিস দেখা যায়। ধরনের রোগীদের শরীরে ইনসুলিন একেবারেই তৈরি হয় না। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য এসব রোগীকে ইনসুলিন ইনজেকশন নিতেই হয়। অন্যথায় রক্তের শর্করা অতি দ্রুত বেড়ে গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই রক্তে অম্লজাতীয় বিষক্রিয়ায় অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ডায়াবেটিসে রোগীদের থেকে ১০ ভাগ টাইপ- আক্রান্ত।

টাইপ- ডায়াবেটিস হলো ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বা দেহে উত্পন্ন ইনসুলিন ব্যবহারে ব্যর্থতা। শারীরিক কার্যকলাপ খাদ্যবিধির সাহায্যে একে প্রথমে মোকাবেলা করা হয়। তবে অনেক সময় প্রয়োজনে মুখে খাওয়ার ওষুধ ইনসুলিন ইনজেকশন দিতে হয়। ৪০ বছর বয়সের পর সাধারণত ধরনের ডায়াবেটিস দেখা দেয়। সাধারণত প্রধান কয়েকটি কারণ রয়েছে রোগটি হওয়ার। যেমন অতিরিক্ত ওজন, পরিবারের কোনো সদস্যের (বাবা, মা, ভাই বা বোন) টাইপ ডায়াবেটিস থাকা। শারীরিক পরিশ্রম না করাও টাইপ- ডায়াবেটিসের অন্যতম একটা কারণ। টাইপ- ডায়াবেটিসে শরীরের বেশকিছু জটিলতা বা সম্ভাব্য উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যেমন হার্টের সমস্যা ব্রেইন স্ট্রোক, স্পর্শ ব্যথার অনুভূতি কমে যাওয়া, পায়ে ঘা, ক্ষত ইনফেকশন, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া অন্ধত্ব, গর্ভের শিশু নষ্ট হওয়া মৃত সন্তান প্রসব করা, কিডনির সমস্যা, যৌন সমস্যা ইত্যাদি।

আমাদের দেশে সাধারণত রোগে আক্রান্ত কিনা তা জানার জন্য পরীক্ষা করে না। অনেকে নিজের অজান্তেই টাইপ- ডায়াবেটিসে ভোগে। প্রায়ই দেখা যায়, দেহের অন্য কোনো রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় এটি ধরা পড়ে। বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস রোগীর ৯০ শতাংশের বেশি টাইপ- তে আক্রান্ত।

গর্ভাবস্থার যেকোনো ধাপে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হতে পারে। সময়ে বাড়তি চাহিদা অনুযায়ী ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, তখন সমস্যাটি দেখা দেয়। সাধারণত নারীরা গর্ভধারণের ২০ বা ২৪ সপ্তাহের পর গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি কারণ বের করেছেন গর্ভকালে ডায়াবেটিস হওয়ার। যেমন অতিরিক্ত ওজন, অতীতে কোনো সন্তান দশমিক কেজির বেশি ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা, আগের গর্ভকালে ডায়াবেটিস হওয়া এবং বংশে অন্য কারো ডায়াবেটিস থাকা। দক্ষিণ এশীয়, কৃষ্ণাঙ্গ, আফ্রিকান-ক্যারিবিয়ান বা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের লোকজনের মধ্যে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

আগে থেকে ডায়াবেটিস রয়েছে এমন নারীদের গর্ভধারণের সময় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে উচ্চ রক্তচাপ থেকে তাদের খিঁচুনি হতে পারে। এছাড়া সময়ের আগে প্রসববেদনা শুরু অথবা অপরিপক্ব সন্তান প্রসবের ঝুঁকি থাকে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি জানিয়েছে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রতি ১০০ নারীর মধ্যে ১০ জন গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। যাদের ৬৫ শতাংশ পরবর্তী সময়ে টাইপ- ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।

অন্যান্য নির্দিষ্ট কারণভিত্তিক ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। যেমন বংশগত কারণে ইনসুলিন তৈরি কম হওয়া, বংশগত কারণে ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে যাওয়া, অগ্ন্যাশয়ের বিভিন্ন রোগ, অন্যান্য হরমোনের আধিক্য এবং ওষুধ রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শ।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডায়াবেটিস এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ডায়াবেটিস রোগীদের বাঁচাতে হলে প্রথমেই তাদের ডায়াবেটিসের লেভেল কতটুকু থাকা উচিত সেটি জানা দরকার। পাশাপাশি শরীরের অন্যান্য রোগ নিয়ন্ত্রণ করলে ডায়াবেটিসের দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা ৭০ ভাগ কমানো যায়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের অন্যতম শর্ত চারটি ডি মেনে চলা। সেগুলো হলো ড্রাগ, ডিসিপ্লিন, ডায়েট ড্রিম। অর্থাৎ ওষুধ, শারীরিক পরিশ্রম, খাদ্যাভ্যাস ঘুমানো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন