চীনের জিরো কভিড নীতি

নগদ অর্থপ্রবাহে প্রাচুর্যের শেনজেন কি পুরনো জৌলুস হারাচ্ছে

শিহাবুল ইসলাম

তিন দশক আগেও ছিল কৃষিপ্রধান একটি অঞ্চল। শূকর, শামুক লিচু চাষের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল শেনজেন। ১৯৮০ সালে নগরীটিকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করে চীন। এর পরই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। দ্রুতগতিতে সম্প্রসারিত হতে থাকে উৎপাদন খাত। নগদ অর্থপ্রবাহ নজরকাড়া প্রবৃদ্ধিতে বিশ্বজুড়েই পরিচিত হয়ে ওঠে একসময়ের বর্ষা মৌসুমে ডুবে যাওয়া কর্দমাক্ত গ্রামটি। তবে বর্তমানে প্রযুক্তি কেন্দ্রটিতে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে। চাহিদা কমে যাওয়ায় নগদ অর্থ মুনাফায় পতন ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে দক্ষিণের উৎপাদন কেন্দ্রটি। চীনের দীর্ঘস্থায়ী জিরো কভিড নীতির কারণে শেনজেন তার পুরনো জৌলুস হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা।

উন্নতির লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও চীনের অর্থনীতি এখনো দেশের কঠোর কভিডজনিত বিধিগুলোর প্রভাব অনুভব করছে। কারণে শেনজেনসহ পুরো অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হুমকির মুখে পড়েছে। এরই মধ্যে ৩০ জুন শেষ হওয়া প্রান্তিকে চীনা অর্থনীতি আগের প্রান্তিকের তুলনায় দশমিক শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। যদিও গত বছরের একই সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে সাম্প্রতিক ওঠানামা আড়াল হতে পারে। সময়ে দেশটির অর্থনীতি এক বছর আগের তুলনায় মাত্র দশমিক শতাংশ বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধে চীনের অর্থনীতি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দশমিক শতাংশ বেড়েছে। এটি গত তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল প্রবৃদ্ধি।

শেনজেনে শিক্ষাগত সফটওয়্যার বিকাশকারী একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন জেং ঝাও। গত মাসের শেষ দিক থেকে তিনি একজন নতুন সফটওয়্যার প্রকৌশলী নিয়োগের চেষ্টা করছেন। চীনের প্রযুক্তি কেন্দ্রে বিপুলসংখ্যক অভিজ্ঞ তবে বেকার প্রকৌশলীদের চাকরি খুঁজতে দেখে তিনি অবাক হয়েছেন। তিনি বলেন, আমার এইচআর একটি পদের জন্য মোট ১০ জন প্রকৌশলীর সাক্ষাত্কার নিয়েছে। তাদের মধ্যে আটজনই টেক জায়ান্টদের থেকে বরখাস্ত কিংবা ছোট মাঝারি আকারের প্রযুক্তি সংস্থাগুলো কয়েক মাস ধরে বেতন বিলম্ব করায় চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ার কথা জানিয়েছেন।

তাদের বেশির ভাগেরই বন্ধকি ঋণ রয়েছে এবং তারা চাকরি খোঁজার জন্য তাড়াহুড়ো করছিলেন। তিন থেকে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এখন প্রতি মাসে প্রায় ১০ হাজার ইউয়ান ( হাজার ৫০০ ডলার) থেকে ১৫ হাজার ইউয়ান বেতন চাইছেন। এটি গত বছরের তুলনায় কম। জেংয়ের মতে, নতুন অর্থ, দ্রুত প্রযুক্তির বিকাশ রিয়েল এস্টেট খাতে উন্মাদনার জন্য পরিচিত ছিল শেনজেন। তবে শহরটি এখন কর্মী ছাঁটাই, বেতন কমানো, নগদপ্রবাহে পতন এবং চাহিদা হ্রাসের মতো পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে।

বেইজিং নরমাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী ডিন সাইমন ঝাও বলেন, একদিকে শেনজেনের নেতৃস্থানীয় উদ্যোগের বিকাশ গত দুই বছরে বিভিন্ন কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ঋণগ্রস্ত রিয়েল এস্টেট জায়ান্ট এভারগ্রান্ড চীন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রযুক্তিযুদ্ধের কারণে বিপর্যয়ে পড়া হুয়াওয়ে ডিজেআই এবং চীনের নিয়ন্ত্রক সংস্থার কড়াকড়ি আরোপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত টেনসেন্ট উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব এবং -সম্পর্কিত কঠোর নিষেধাজ্ঞা সরবরাহ ব্যবস্থায় তীব্র প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। পরিস্থিতিতে বিদেশী অর্থায়নকৃত এবং স্থানীয় উদ্যোগগুলোকে শেনজেন ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে। এগুলো সবই শেনজেনের সমগ্র উৎপাদন খাত এবং আমদানি রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

শহরটির পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে অর্থের হিসাবে শেনজেনের মোট আমদানি রফতানি শতাংশ কমে প্রায় লাখ ৩১ হাজার কোটি ইউয়ানে (১৯ হাজার ৫০০ কোটি ডলার) পৌঁছেছে। সময়ে রফতানি দশমিক শতাংশ বেড়ে প্রায় ৭৪ হাজার কোটি ইউয়ান এবং আমদানি দশমিক শতাংশ কমে প্রায় ৫৬ হাজার ৯০০ কোটি ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে।

শহরের ব্যয় ক্ষমতাও ক্রমেই নিম্নমুখী হচ্ছে। জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ভোগ্যপণ্যের মোট খুচরা বিক্রি দশমিক শতাংশ কমেছে। কভিড প্রাদুর্ভাবের কারণে জানুয়ারি মার্চে শহরটি লকডাউনের মধ্যে ছিল। বড় কারখানা, বন্দর রেস্তোরাঁর কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জুনের শেষ দিকে আবারো হংকংয়ের সীমান্তবর্তী শহরটিতে এক ডজন সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পরে তিনদিনের জন্য পাইকারি বাজার, সিনেমা হল জিম বন্ধ করে দেয়া হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেনজেনের আইটি ইঞ্জিনিয়ার সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে শিক্ষক পর্যন্ত সবাই অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করছেন। ব্যাপক বেতন কাটা কর্মী ছাঁটাইয়ের কারণে সবাই আতঙ্কিত হয়ে উঠছেন। সে সঙ্গে দুর্বল রিয়েল এস্টেট বাজার এবং উচ্চ বন্ধকি ঋণের চাপ শহরের মধ্যবিত্তদের বিপর্যয়ের মুখোমুখি করেছে।

চায়না টাইমস সংবাদপত্র অনুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে শেনজেনে হাজার ৯৬৫টি পুরনো রিয়েল এস্টেট ইউনিট বিক্রি হয়েছে। সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ কম। এটি খাতে ২০০৭ সালের পরে সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স চিহ্নিত করেছে। এদিকে সময়ে শহরটিতে ১৬ হাজার ১২৬টি নতুন বাড়ি বিক্রি হয়েছে। সংখ্যাও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৮ দশমিক শতাংশ কম।

শেনজেনের হাই-টেক শিল্প বিকাশের মাপকাঠি তথ্যপ্রযুক্তি, জৈবপ্রযুক্তি  নতুন উপকরণের মতো কৌশলগত উদীয়মান শিল্প স্থানীয় জিডিপিতে ৪০ শতাংশেরও বেশি অবদান রেখেছে। এটিকে ৪২ শতাংশে উন্নীত করা লক্ষ্য নেয়া হয়েছিল। তবে সেই অবদান এখন কমছে। ২০২১ সালে খাতের অবদান ৩৯ দশমিক শতাংশ এবং চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৩৯ দশমিক শতাংশে নেমে এসেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন