ধূমপান
ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনে বলা আছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শতভাগ ধূমপানমুক্ত থাকবে। কিন্তু মাধ্যমিক, এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশপাশে যেসব দোকান রয়েছে সেগুলোয়ও খুচরা সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাকপণ্য মিলবেই। সঙ্গে বিভিন্ন তামাকপণ্যের রঙচঙে মোড়কের আকর্ষণীয় প্রদর্শনী। এতে আমরা দুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। প্রথমত, তামাক কোম্পানির এক ধরনের কৌশলগত বিজ্ঞাপনের শিকার হচ্ছি। দ্বিতীয়ত, পরোক্ষ ধূমপানের মাধ্যমে আমাদের সন্তানরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ ‘ধূমপায়ী’ হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তামাকের এই করাল গ্রাস থেকে বাঁচতে আমরা নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছি বটে কিন্তু খুচরা সিগারেট বিক্রি বন্ধের আলোচনা সম্ভবত তেমন জোর পাচ্ছে না। এ কথা না বললেই নয়, আগামী প্রজন্মকে ধূমপানের হাত থেকে বিরত রাখতে খুচরা সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। আর এটি তখনই সম্ভব যখন সবার সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে এটাকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
বিদ্যমান আইনের যেসব স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্য জায়গাগুলোকে ‘পাবলিক প্লেস’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে আরো রয়েছে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস; গ্রন্থাগার, লিফট, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, আদালত, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, নৌবন্দর, রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণিবিতান, রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্ক, মেলা বা পাবলিক পরিবহনে আরোহণের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারি, জনসাধারণের সম্মিলিত ব্যবহারের স্থান ইত্যাদি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। আর সেই ঘোষণা বাস্তবায়নে শুধু খুচরা সিগারেট বিক্রি বন্ধ নয়, আইন সংশোধনের মাধ্যমে বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা; তামাক কোম্পানির ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি’ বা সিএসআর কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা; ই-সিগারেট ও হিটেড টোব্যাকো প্রডাক্টসসহ (এইচটিপি) সব ইমার্জিং টোব্যাকো প্রডাক্ট আমদানি ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা এবং সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৯০ শতাংশ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশের ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কোনো না কোনো তামাক দ্রব্য সেবন করে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এ হার ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। এটি ২০১৭ সালের হিসাব। গত পাঁচ বছরে সংখ্যাটি বেড়েছে নাকি কমেছে তার জন্য গবেষণা প্রয়োজন। শুধু সরাসরি তামাক সেবন নয়, শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের দিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে। অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার ৯৫ শতাংশ শিশু কোনো না কোনোভাবে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। শুধু তা-ই নয়, বছরে বাংলাদেশের ৬১ হাজারেরও বেশি শিশু তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়।
অর্থনৈতিক দিক থেকে আমাদের দেশের বিশাল একটি অংশ এখনো দিন এনে দিন খাওয়ার মতো করে জীবন পরিচালনা করে। সেদিক থেকে ধূমপায়ীরা একবারে এক প্যাকেট সিগারেট না কিনে খুচরা সিগারেট ক্রয়ের দিকে বেশি আগ্রহী হয়। যেসব তরুণ নতুন ধূমপান করছে, তাদের পক্ষে পুরো এক প্যাকেট সিগারেট কেনা কঠিন। কিন্তু হাতের নাগালে খুব সহজেই খুচরা সিগারেট কেনার সুযোগ থাকায় তারা হয়ে উঠছে আগামী দিনের নতুন ধূমপায়ী। এমন পরিস্থিতি সামলাতে আইনের মাধ্যমে বিষয়টি প্রতিরোধ করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এরই মধ্যে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের ১১৮টি দেশ সিঙ্গেল স্টিক, অর্থাৎ খুচরা সিগারেটসহ সিগারেটের ছোট প্যাকেট বিক্রি বন্ধ করেছে। পার্শ্ববর্তী ভারতের অনেক জায়গায়ও তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। তামাক কোম্পানিগুলো সবসময়ই নতুন ক্রেতার কথা চিন্তা করে প্রচারণা চালিয়ে থাকে। আমাদেরও সেভাবে চিন্তা করা জরুরি। যারা এরই মধ্যে ধূমপায়ী হয়েছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করার চেয়ে যারা নতুন করে ধূমপায়ী হতে পারে তাদের দিকে বেশি নজর দেয়ার কথা ভাবতে হবে। আইনত তামাকপণ্যের প্রচারণা নিষিদ্ধ থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এলাকায় তামাকপণ্যের সুসজ্জিত প্যাকেটের প্রদর্শন এক রকম পরোক্ষ বিজ্ঞাপন, যা দেখে তরুণ শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হয়। স্টাইলিশ প্যাকেজিংও নতুন ধূমপায়ী তৈরির ক্ষেত্রে উপযোগ হিসেবে কাজ করে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে গৃহীত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) ধারা অনুযায়ী বিড়ি-সিগারেটের প্যাকেটের ৯০ শতাংশ জুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী থাকা বাঞ্ছনীয়। যেখানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যবার্তা ৫০ শতাংশ। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে সমন্বয় করে কাজ করা জরুরি।
অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে তামাকপণ্য বিক্রয় আইনত দণ্ডণীয় হলেও তার বাস্তবায়ন নামমাত্র। এক্ষেত্রে আমি মনে করি, বিক্রেতাদের মাঝে সচেতনতা ও কাউন্সেলিং জরুরি। পাশাপাশি টাস্কফোর্স কিংবা পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করেও এগুলো নিয়ন্ত্রণের সুযোগ রয়েছে।
তামাক নিয়ন্ত্রণে সাম্প্রতিক সময়ে সংসদ সদস্যদের উদ্যোগও চোখে পড়ার মতো। তাদের একজন হিসেবেই বলতে চাই, এ সময়ে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ব্যাপারে সংসদ সদস্যরা ঐক্যবদ্ধ। আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা। সেটিকে পাথেয় করে আমরা লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে চলেছি।
আমরা প্রত্যেকেই জানি, তামাক কোম্পানিগুলো যেমন শক্তিশালী তেমনি কৌশলী। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের এ আন্দোলন দেশের জন্য, সমাজের জন্য। আমরা একটি সুস্থ ও সুখী প্রজন্ম চাই। আমরা চাই তামাকের মতো ক্ষতিকর পণ্যের নেতিবাচক প্রভাবে আর একটি মানুষও মৃত্যুবরণ না করুক।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঠিক দিকনির্দেশনায় আমরা নিশ্চয় সে লক্ষ্য অর্জনে সফল হব।
আরমা দত্ত, এমপি: সদস্য, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি; কো-চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং