ভৌগোলিক সুবিধাকে কমোডিটি এক্সচেঞ্জের উন্নয়নে কাজে লাগাতে চায় সিএসই

আসিফ ইব্রাহীম, মো. গোলাম ফারুক

দেশে প্রথমবারের মতো পণ্য বেচাকেনার জন্য কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) এজন্য সম্প্রতি অভিজ্ঞতা বিনিময় পরামর্শ সেবা নিতে ভারতের মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জের (এমসিএক্স) সঙ্গে চুক্তি করেছে সিএসই। কমোডিটি এক্সচেঞ্জের বিষয়ে সিএসইর চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম ফারুক বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মেহেদী হাসান রাহাত

আসিফ ইব্রাহীম: সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে বাংলাদেশে কমোডিটি ইকোসিস্টেম নেই। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপালসহ আসিয়ানভুক্ত বিভিন্ন দেশ উন্নত বিশ্বে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ অনেকদিন ধরেই রয়েছে এবং সেগুলো ভালোভাবেই পারফর্ম করছে। আমরা দেশে একটি পরিপূর্ণ কমোডিটি কাঠামো গড়ে তুলতে চাই যেখানে ফিউচার কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে কৃষি, শিল্প কিংবা ভোগ্যপণ্যভিত্তিক কমোডিটি পণ্য বেচাকেনা করার সুবিধা থাকবে। এটি স্টক এক্সচেঞ্জেরই একটি ভিন্ন রূপ হবে যেখানে পণ্য লেনদেন হবে। আমাদের অর্থনীতি বর্তমানে একটি ভালো আকারে এসে দাঁড়িয়েছে। বছরে দেশে ১৪৪ বিলিয়ন ডলারের কমোডিটি লেনদেন হয়। ফলে আমাদের এখানে কমোডিটি এক্সচেঞ্জের উপযোগিতা রয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বর্তমান শীর্ষ কর্তারা দায়িত্ব নেয়ার পর কার্যক্রম আরো গতি পায়। গত বছরের অক্টোবরে কমিশন থেকে বিষয়ে আমরা প্রাথমিক অনুমোদন পাই। এর পর থেকেই আমরা কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর বিষয়ে বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করেছি। সর্বশেষ আমরা ভারতের এমসিএক্সের সঙ্গে পরামর্শক সেবা গ্রহণের জন্য চুক্তি করেছি। রমজান কিংবা কোনো বিশেষ উৎসবকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে অস্থিরতা দেখা যায়। দেশে এসব পণ্যের চাহিদা, সরবরাহ উৎপাদনসংক্রান্ত পরিপূর্ণ তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। কারণেও কমোডিটি এক্সচেঞ্জের প্রয়োজনীয়তা অনেক।

দেশে আরো আগেই কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু করা উচিত ছিল। কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু করতে চেয়েছিল, যদিও সে উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। দেশে বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির যে অবকাঠামোগত সুবিধা রয়েছে সেটিকে কমোডিটি এক্সচেঞ্জের প্রসারে কাজে লাগাতে চাই। এক্ষেত্রে আমরা কৃষকদের সমবায় সমিতিকেও কাজে লাগাব। এর মাধ্যমে কৃষকরা আগে থেকেই নিশ্চিত হতে পারবেন যে তাদের উৎপাদিত পণ্যের একজন ক্রেতা রয়েছে। এক্ষেত্রে দামও নির্দিষ্ট করা থাকবে।

কমোডিটি এক্সচেঞ্জের সঙ্গে কৃষক, ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান, কমোডিটি ট্রেডার্স সবাইকে সংযুক্ত করতে হবে। পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বীমার প্রয়োজন। দেশে এটি একেবারেই নতুন হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বিষয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণাও চালাতে হবে। আমাদের একার পক্ষে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সবার সহযোগিতা নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

প্রথমে আমরা দুই-তিনটি পণ্য দিয়ে বছরের মধ্যে এক্সচেঞ্জটি চালু করতে চাই। অবশ্য একটি পরিপূর্ণ কমোডিটি ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে বছর পাঁচেকের মতো সময় লাগবে। এখানে বিভিন্ন ধরনের বিধি প্রবিধান তৈরি করতে হবে। পণ্য শনাক্তকরণ, ব্যবসায়িক পরিকল্পনার উন্নয়ন, পণ্য লেনদেনের ক্ষেত্রে বাজার নজরদারি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। বেশকিছু আর্থিক বিষয়াদি রয়েছে। লেনদেন নিষ্পত্তির জন্য ক্লিয়ারিং অ্যান্ড সেটেলমেন্ট চালু করতে হবে। তাই সেন্ট্রাল কাউন্টারপার্টি বাংলাদেশ লিমিটেডকে (সিসিবিএল) যদি এক বছরের মধ্যে চালু করা সম্ভব হয় তাহলে সেটি আমাদের জন্য সুবিধাজনক হবে। কমোডিটি এক্সচেঞ্জের জন্য গুদামজাত পণ্য সরবরাহ অবকাঠামোর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে এটি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষ করে থাকে। স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে দেশে কোল্ড চেইন স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি আমাদের জন্য সহায়ক হবে। তাছাড়া চট্টগ্রামের বেশকিছু কনগ্লোমারেট তাদের নিজস্ব জায়গায় গুদাম স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সরকার, বিএসইসি, ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন, গুদামজাতকারী, কৃষকদের সংগঠন, সিসিবিএল, ব্রোকার, বীমা কোম্পানি, বিনিয়োগকারী, ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পাইকারি ব্যবসায়ী, আমদানিকারক, রফতানিকারক, প্রক্রিয়াজাতকারীরাই কমোডিটি এক্সচেঞ্জের মূল অংশগ্রহণকারী হবেন।

কমোডিটি এক্সচেঞ্জ স্থাপনে প্রাথমিকভাবে ট্রেডিং প্লাটফর্ম, হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, কনসালটেন্সির জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। প্রথমে এটি গড়ে তুলতে বিনিয়োগ করতে হবে। পরবর্তী সময়ে এক্সচেঞ্জটিকে পরিপূর্ণ করে তুলতে ধারাবাহিক বিনিয়োগ করতে হবে। এটি অবশ্য শুধু আমাদেরই করতে হবে তা নয়। বরং অন্যান্য অংশগ্রহণকারী যারা রয়েছেন তারাও এখানে বিনিয়োগ করবেন। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জকেন্দ্রিক দেশের সবচেয়ে বড় ভোগ্যপণ্য বাজার রয়েছে। ভৌগোলিক সুবিধাকে আমরা কমোডিটি এক্সচেঞ্জের উন্নয়নে কাজে লাগাতে চাই।

প্রাথমিকভাবে দেশে তুলা, ভোজ্যতেল, গম স্বর্ণের মতো কমোডিটিই বেশি সম্ভাবনাময়। তবে এটি পরিবর্তনও হতে পারে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কী সুপারিশ করবে সেটির দিকে আমরা তাকিয়ে আছি। যেসব পণ্য নিয়ে শুরু করলে সহজে এক্সচেঞ্জটি চালু করা সম্ভব হবে প্রথমে আমরা সেটিই প্রাধান্য দিব। পরবর্তী সময়ে ধারাবাহিকভাবে অবকাঠামো তৈরির মাধ্যমে অন্যান্য পণ্যও চালু করব।

কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর ক্ষেত্রে বেশকিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এখানে বেশকিছু নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সংযুক্ত সমন্বয় করতে হবে। একাধিক তৃতীয় পক্ষকে সংযুক্ত করতে হবে। দেশে কাঠামোগত স্পট এক্সচেঞ্জ না থাকার কারণে রেফারেন্স মূল্য ওঠানোর প্রক্রিয়ায় জটিলতা হতে পারে। আর্থিক ডেরিভেটিভস লেনদেনের সুযোগ থাকলেও ধরনের কাঠামো বাজার পরিচিতি নেই। ফিউচারস ট্রেডিংয়ের জন্য গুদাম অন্যান্য বাজার কাঠামো নেই। সমন্বিত সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিতে তৃতীয় পক্ষের সেবা প্রদানকারীর অনুপস্থিতি বিষয়গুলো আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ।

মো. গোলাম ফারুক: বর্তমানে পণ্যের  কেনাবেচা সংগঠিতভাবে হচ্ছে না। কিন্তু এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে লেনদেন হলে এটি একটি কাঠামোর আওতায় চলে আসবে। এতে সিএসইর ভালো আয় হবে। পাশাপাশি সরকারও এখান থেকে উল্লেখযোগ্য হারে রাজস্ব পাবে। আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে বছরের মধ্যেই কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু করা। তবে এমসিএক্সের সঙ্গে আমাদের চুক্তির মেয়াদ দুই বছর। ফলে চুক্তি অনুসারে সময় পর্যন্ত তারা আমাদের সেবা দেবে। প্রথমে আমরা নন-ডেলিভারি ক্যাশ সেটেলমেন্ট পদ্ধতিতে শুরু করতে চাচ্ছি। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু হলে আমাদের কৃষকদের জন্য সুবিধা হবে। আগে থেকেই যদি তারা পণ্যের দাম সম্পর্কে জানতে পারে তাহলে তারা ন্যায্যমূল্য পাবেন বলে আশা করি। এরই মধ্যে আমরা নিজেদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আমরা নতুন হার্ডওয়্যার স্থাপন করতে যাচ্ছি। আমাদের বিদ্যমান সফটওয়্যার মাল্টিপ্রডাক্ট সাপোর্ট করে। কমোডিটি এক্সচেঞ্জের জন্য এক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা পরিবর্তন করতে হতে পারে। পরামর্শকের সুপারিশ অনুসারে আমরা করণীয় কী হবে সেটি নির্ধারণ করব। আমাদের স্টেকহোল্ডার কারা হবে, তাদের প্রকৃতি কী হবে, তাদের কীভাবে প্রশিক্ষিত করতে হবে সে বিষয়েও পরামর্শক দিকনির্দেশনা দেবে। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কীভাবে করা হবে সেটি আমাদের পর্যালোচনা করতে হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন