দেশের লবণে প্লাস্টিকের উদ্বেগজনক উপস্থিতি

মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে

লবণে ঢুকে পড়ছে প্লাস্টিক’—এমন খবর নিশ্চয়ই জনমনে ভীতির সঞ্চার করবে। বেশ কিছুকাল আগে থেকেই বলা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত প্লাস্টিকের বর্জ্য প্রতিনিয়ত নদ-নদী, জলাভূমিতে গিয়ে পড়ছে। সর্বশেষ এটি চলে যাচ্ছে সমুদ্রে। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানের এক গবেষণা বলছে, দেশে উৎপাদিত প্রতি কেজি লবণে হাজার ৬৭৬ মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি মিলেছে। আর গড়ে প্রতি বছর একজন মানুষ ১৩ হাজার ৮৮টি মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করছে শুধু লবণ পরিভোগের মাধ্যমে। বিষয়টি চরম উদ্বেগজনক এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। মাইক্রোপ্লাস্টিক দ্বারা দূষণকে বাস্তুসংস্থানীয় টাইম বোমা হিসেবে অভিহিত করছে বিশ্ব। মানুষের মধ্যে ক্যান্সার থেকে শুরু করে মারাত্মক সব রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে ওঠার পেছনে প্লাস্টিক কণাকে দায়ী করা হচ্ছে। লবণে উচ্চমাত্রায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতির পেছনে সমুদ্রে অতিমাত্রায় প্লাস্টিকের দূষণ এবং এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। লবণ নিত্যপ্রয়োজনীয় একটি পণ্য। এক্ষেত্রে তদারকি সহায়তার মাধ্যমে যেমন লবণে আয়োডিনের উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেছে, ঠিক একইভাবে লবণ থেকে প্লাস্টিকের উপস্থিতি শূন্যে নামিয়ে আনা হোক। প্রত্যাশা থাকবে সরকার জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।

মাইক্রোপ্লাস্টিক হচ্ছে প্লাস্টিকের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশ। যেসব প্লাস্টিকের আকার দুই মাইক্রোমিটার থেকে পাঁচ মিলিমিটারের মধ্যে সেসব প্লাস্টিককে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়। নিত্যব্যবহার্য প্লাস্টিক বর্জ্য, কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পদার্থে থাকা প্লাস্টিক প্রতিনিয়ত পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। তাপমাত্রা, ক্ষুদ্র অণুজীবসহ নানা কারণে এসব প্লাস্টিক ভেঙে যায় এবং পরিণত হচ্ছে ক্ষুদ্র বা মাইক্রোপ্লাস্টিকে। ২০১৪ সালে প্রথম জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলনে সামুদ্রিক প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণ শীর্ষক ১০ জরুরি পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা এবং মাইক্রোপ্লাস্টিকের ওপর বিশেষ মনোযোগ দেয়া হয়। ২০১৫ সালে দ্বিতীয় জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলনে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ পরিবেশ পরিবেশবিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈজ্ঞানিক সমস্যা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি মাইক্রোপ্লাস্টিক একটি বড় বৈশ্বিক পরিবেশগত সমস্যা হয়ে উঠেছে। আকারে ক্ষুদ্র হওয়ায় এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান, যেমন মাটি, পানি, বাতাসের সঙ্গে সহজেই মিশে যাচ্ছে। ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের বাস্তুসংস্থান। নদীর স্রোত, বৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি উপায়ে এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক পুকুর, নদী সমুদ্রে গিয়ে জমা হচ্ছে। শুধু লবণ নয়, মাছেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। খাদ্যশৃঙ্খলের পর্যায়ক্রমিক পরিক্রমায় মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবদেহে প্রবেশ করছে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক।

বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাংলাদেশের চেয়েও বেশি। কিন্তু সেখানে বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা উন্নত; প্রায় পুরোটাই পুনর্ব্যবহার করা হয়। ফলে পরিবেশগত ক্ষতি কম হয়। সমুদ্র উপকূলে প্লাস্টিক বর্জ্য অব্যবস্থাপনার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম সারিতে রয়েছে। প্লাস্টিকের কণার দূষণের পরিণতির ইতিহাস অতি ভয়ানক। ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রেলিয়ার পিভিসি কারখানার কর্মীদের মধ্যে একসময় ক্যান্সারের প্রকোপ দেখা গিয়েছিল। যার কারণ ছিল প্লাস্টিক কণার দূষণ। কর্মীদের পাশাপাশি ওইসব দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী প্লাস্টিকের দূষণের শিকার হয়েছিল। তারা এখন সচেতন হয়েছে। ফেলে দেয়া প্লাস্টিক ব্যবহার করে ভারত এরই মধ্যে রাস্তা তৈরি করছে। প্লাস্টিকের বর্জ্য ব্যবহার করে রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালে। শুধু তা- নয়, প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি তৈরিও করছে ভারত। যদিও জ্বালানি এখন পর্যন্ত গাড়িতে ব্যবহার করে দেখা হয়নি। বরং শিল্প-কারখানাগুলোর মেশিন চালাতে জ্বালানি ব্যবহার করা হয়।  প্লাস্টিককে বর্জ্য নয়, সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। লক্ষ্য নিয়েই মুম্বাই এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বোতল ফর চেঞ্জ নামে একটি উদ্যোগ নেয়া হয়। এর আওতায় বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক দেশ নির্দিষ্ট পণ্য তৈরি করার সময় মাইক্রোপ্লাস্টিককে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি বিবেচনা করছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে সাবান, টুথপেস্ট প্রসাধনী পণ্যগুলোয় প্লাস্টিকের মাইক্রোস্পিয়ারের ব্যবহার নিষিদ্ধ। যুক্তরাজ্যও উপাদানগুলোর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। ডেনমার্ক সুইডেনের মতো অন্যান্য দেশেও এটি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ২০০২ সালে প্লাস্টিকের তৈরি শপিং ব্যাগ (পলিথিন) নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি। প্লাস্টিকের দূষণ বন্ধ করতে হলে এর বেআইনি উৎপাদন নিশ্চিত বাজারজাত বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। প্লাস্টিক উৎপাদন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক সব অংশীজনের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কমিউনিটিভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। ২০১৮ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) একটি সমীক্ষা অনুযায়ী বারবার নীতি পরিবর্তন, বেছে বেছে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, উৎপাদনকারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকা এবং সাধারণ জনগণের স্বভাব পরিবর্তনের জন্য কোনো ধরনের প্রণোদনা না থাকার কারণেই মূলত উদ্যোগগুলো ব্যর্থ হয়েছে। তবে সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০২০-২৫) সমস্যার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং সমাধানের জন্য কিছু সামগ্রিক উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। প্লাস্টিকের দূষণ কমিয়ে আনতে হলে এর পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে সর্বাগ্রে। এজন্য সরকারকে আর্থিক প্রণোদনাসহ নানা সুবিধাও নিশ্চিত করতে হবে। দেশে পেট বোতল ব্যবহার করে ফ্লাস্ক, সুতা তৈরির কাজ চলছে। রফতানিও হচ্ছে পণ্য। এটি আরো জোরদার করতে সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ জোগানো শুল্ক-কর রেয়াতের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের উৎস নির্মূলে পণ্য মোড়কজাত আইনেও পরিবর্তন আনতে হবে। যেসব প্রসাধনীতে উপাদান ব্যবহার হচ্ছে তা বন্ধ করা প্রয়োজন।

গবেষণা থেকে যা উন্মোচন হয়েছে এবং যে বিষয়টি নিয়ে আমাদের গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়া দরকার তা হলো, কীভাবে ব্যবহারের পর যত্রতত্র ছুড়ে ফেলা প্লাস্টিক সময়ের সঙ্গে ক্ষয় হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তর হয় এবং পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে মানুষ বাস্তুতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য ঝুঁকির সৃষ্টি করে। প্রাকৃতিক পরিবেশে দিনের পর দিন থেকেও এর কোনো ক্ষয় হয় না এবং এটি মানুষের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়েছে। ফলে প্রকৃতির পুনরুজ্জীবিত হওয়ার প্রক্রিয়া গুরুতরভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ধরনের একটি পরিণতি দেশের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। প্লাস্টিক পণ্য, পলিথিন ব্যাগসহ সব অপচনশীল কঠিন বর্জ্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপদ অপসারণের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সমানভাবে অত্যাবশ্যক। অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ, পৃথকীকরণ প্রক্রিয়াজাতের জন্য আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রয়োজন। প্লাস্টিক বর্জ্যের রিসাইক্লিং বা পুনরাবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে দূষণের পরিমাণ সীমিত রাখা সম্ভব। এক্ষেত্রে পরিবেশ মন্ত্রণালয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে।

নানা প্রক্রিয়ায় প্রতিনিয়ত পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক, যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে মানুষসহ অন্যান্য পশুপাখির ওপর। এতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য। ক্যান্সার, হরমোনের তারতম্য, প্রজনন প্রক্রিয়ায় বাধা দেয়া ছাড়াও মারাত্মক সব ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। বাংলাদেশে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ একেবারেই নতুন একটি বিষয় এবং উৎপাদক ভোক্তা কেউই মাইক্রোপ্লাস্টিকের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন নন। তাই মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ লোকচক্ষুর অন্তরালে এক ভয়ংকর গতিতে এগিয়ে চলছে। আকারে ক্ষুদ্র হওয়ায় বিভিন্ন ট্রিটমেন্ট প্লান্ট পেরিয়ে সহজে চলে যাচ্ছে এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক। মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহ ক্ষতির হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে সরকারি বেসরকারিভাবে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়া উচিত। এছাড়া অতীতে উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্য যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। জোর দিতে হবে প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের ওপর। প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে জৈবিক প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়াতে হবে। তাছাড়া মাইক্রোপ্লাস্টিকের ওপর সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বৃদ্ধির পাশাপাশি এর ভয়াবহ দিক সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন