বান্দরবানে অবাধে পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি চলছে

বণিক বার্তা প্রতিনিধি, বান্দরবান

বান্দরবান সদর উপজেলায় ন্যাচারাল পার্কের কাটা পাহাড় ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

বান্দরবান সদর উপজেলায় রাতের অন্ধকারে অবৈধভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি পার্কের পাহাড় কাটার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাহাড় কাটা মাটি চট্টগ্রামের সাতকানিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রিও করা হচ্ছে। যে পার্কের পাহাড় কাটা হচ্ছে তার মালিক বান্দরবান জেলা বিএনপির একাংশের নেতা অধ্যাপক ওসমান গণি। আর পাহাড়টি কেটে মাটি বিক্রির অভিযোগ উঠেছে সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়া ইউনিয়নের নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো. আব্দুছ ছফুরের নেতৃত্বাধীন চক্রের বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে বিশাল পাহাড়টির পাদদেশ অংশে সড়ক নির্মাণের আদলে আনুমানিক ৭০০ ফুট দৈর্ঘ্য পর্যন্ত কাটা হয়ে গেছে। যদিও বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো ধরনের পাহাড় কাটাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক সপ্তাহ ধরে রাতের অন্ধকারে ট্রাকে করে এক্সক্যাভেটর এনে ওসমান গণির মালিকানাধীন ন্যাচারাল পার্কের একটি বিশাল পাহাড় কাটা হচ্ছে। রাতভর এক্সক্যাভেটর দিয়ে পাহাড় কাটার পর সে মাটি ডাম্পার ট্রাকে করে কাছের বাজালিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতি রাতে ১০টি ডাম্পার ট্রাকে করে মাটি নেয়া হয়। মূলত রাত ১০টায় শুরু করে ভোর সাড়ে -৬টা পর্যন্ত চলে পাহাড় কাটার কাজ। এর আগে আব্দুছ ছফুরের বিরুদ্ধে মধ্যম কাইচতলী পাড়ার ইউসুফ মৌলভীর পাশের পাহাড়টিও কাটার অভিযোগ ওঠে। সে সময়ও রাতের অন্ধকারেই পাহাড় কাটা হতো এবং মাটি নেয়া হতো বাজালিয়ার দিকে। প্রায় ১৫ দিন আগে পাহাড়টি কাটা বন্ধ করে ন্যাচারাল পার্কের পাহাড় কাটতে শুরু করে চক্রটি।

মো. আব্দুছ ছফুরের সঙ্গে পাহাড় কাটা মাটি বিক্রির কাজে জড়িত হিসেবে স্থানীয় রাসেল নুরুর নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে নুরুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন যানবাহন থেকে চাঁদা আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে। অভিযুক্তরা সবাই প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিষয়ে মুখ খুলতে ভয় পান বলে জানিয়েছেন কয়েকজন স্থানীয়। এরা কেউই নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

ন্যারাচাল পার্কের শুরুতেই রয়েছে বিশাল একটি পাহাড়, যেখানে বাঁশঝাড় চা বাগান রয়েছে। সেটির পাদদেশে আঁকাবাঁকা করে আনুমানিক ৭০০ ফুট পর্যন্ত মাটি কেটে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কেটে ফেলা অংশের প্রস্থ প্রায় ২০ ফুট। দেখে মনে হয় পাহাড় কেটে পথ তৈরি করা হয়েছে। অনেকটা পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণের মতো দেখায়।

জানা গেছে, ন্যাচারাল পার্কের পাহাড় কাটা মাটি দিয়ে কেরানীহাট-বান্দরবান সড়ক হয়ে বাজালিয়া যাওয়ার পথে ফরেস্ট অফিস বড়দুয়ারা এলাকায় দুটি স্থানে কৃষিজমি ভরাট করা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সাতকানিয়ার বড়দুয়ারা গ্রামের কৃষি ব্লকের ব্রিধান-৯২ জাতের একটি প্রদর্শনী প্লট ঘেঁষে। যেখানে মাটি ভরাট করা হচ্ছে সেটি সাতকানিয়ার শামসু নামের এক ব্যক্তির জমি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। পাশাপাশি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পেছনে মাহালিয়া এলাকায়ও বিশাল প্রান্তরজুড়ে মাটি ভরাট করা হচ্ছে। এখানেও মাটি আসছে বান্দরবানের ন্যাচারাল পার্ক থেকে।

রাতে মাটি বহনকারী এক ডাম্পার ট্রাকচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ন্যাচারাল পার্ক থেকে বড়দুয়ারা পর্যন্ত প্রতি গাড়ি মাটির দাম হাজার টাকা। আর মাহালিয়ায় হাজার ২০০ টাকা। এক রাতে একটি গাড়ি ৪২-৪৭ বার মাটি সরবরাহ করি। প্রতি রাতে ১০-১২টি ডাম্পার ট্রাক কাজ করে।

বিষয়ে অধ্যাপক ওসমান গণির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাটি বিক্রির জন্য নয়, বরং মসজিদের জন্য ইমাম সাহেব কিছু মাটি চেয়েছিলেন। সেজন্য তিনি পাহাড় কেটে মাটি নেয়ার অনুমতি দিয়েছেন। তবে আর কেউ যেন মাটি নিতে না পারে সেজন্য গত রোববার ওই অংশে বেড়া দেয়া হয়েছে। যদিও সরেজমিনে সেখানে কোনো বেড়া দেখতে পাওয়া যায়নি।

পাহাড় কাটার বিষয় স্বীকার করেছেন বাজালিয়া ইউনিয়নের ওয়ার্ড মেম্বার মো. আব্দুছ ছফুর। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, পাহাড় কাটা মাটি সরবরাহের বিষয় তদারক করেন ভাগ্যকূল এলাকার সাবেক মেম্বার আলী আকবরের ছেলে রাসেল মো. নুরুল আলম নুরু নামে একজন। পুরো বিষয়টির সমন্বয় করেন রাসেল। যদিও বারবার চেষ্টা করেও রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

তবে পাহাড়ের মাটি বাজালিয়া ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানে বিক্রির বিষয় স্বীকার করেছেন মো. নুরুল আলম। তিনি বলেন, ওসমান গণির কথা অনুযায়ী, তার দেখানো স্থান থেকেই তারা মাটি কেটে নিয়েছেন। সেখানে কোনো বেড়া দেয়া হয়নি।

বান্দরবান সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা আফরিন মুস্তাফা বণিক বার্তাকে বলেন, সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে জেলা আইন-শৃঙ্খলা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জেলায় পাহাড় কাটার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তিনি জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের অবহিত করবেন। সে পরিপ্রেক্ষিতে সভায় সিদ্ধান্ত হয়, পাহাড় কাটাসংক্রান্ত বিষয়গুলো বান্দরবানের পরিবেশ অধিদপ্তর দেখভাল করবে।

বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবানের সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) শ্রীরূপ মজুমদার বলেন, ন্যাচারাল পার্কের পাহাড়সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে নির্দেশ পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন