ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে কতজন নিখোঁজ রয়েছে তার সঠিক হিসাব দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। দুর্ঘটনার পর শুক্রবার সকাল থেকে সুগন্ধা তীরের দিয়াকুল গ্রাম, ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল ও বরিশাল শেরেবাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে আসতে থাকেন নিখোঁজদের স্বজনরা। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে সুগন্ধা তীর ও হাসপাতালের পরিবেশ।
ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও নৌ-মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটির সদস্য, জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রধান মো. নাজমুল আলম জানান, ৩৭ জনের মরদেহ এরই মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত চারজনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ৩৩ জনের জন্য স্বজনদের সন্ধান চলছে। অগ্নিদগ্ধে মরদেহগুলোর চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। তাদের স্বজনরাও এসে খুঁজছেন। নদীতে একাধিক দলের উদ্ধার অভিযান অব্যাহত আছে।
এদিকে লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিখোঁজের বিষয়ে জেলা পুলিশ ৩৭ জন ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ঝালকাঠি ইউনিটের পক্ষ থেকে ৫১ জনের তালিকা করা হয়েছে। স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এ তালিকা করা হয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় স্বজনদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী এ তালিকা করা হয়েছে।
স্বজনদের খোঁজে আসা বাবুল জানান, তার ভাইয়ের মেয়ে সোনিয়া (২৫), সোনিয়ার দুই ছেলে জুবায়ের (৬) ও জুনায়েদ (২) এবং তার মা রেখা বেগম দুর্ঘটনাকবলিত অভিযান-১০ লঞ্চে করে বরগুনার তালতলী উপজেলার ছোটবগি গ্রামে যাচ্ছিলেন। লঞ্চে আগুন লাগার পর পরই সোনিয়া তার ছয় বছরের শিশু জুবায়েরকে নিয়ে সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হলেও দুই বছরের জুনায়েদ ও রেখা বেগমকে এখনো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বরগুনার বামনা উপজেলার বুকাবুনিয়া গ্রামের উত্তম হালদার (৩৫) খুঁজছিলেন ভাইয়ের ছেলে কৃষ্ণ হালদারকে (১৪)। নিখোঁজ কৃষ্ণ ঢাকার উত্তরার একটি স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। কৃষ্ণ হালদার মা গীতা রানী ও ছোট ভাই প্রত্যয়কে নিয়ে বামনার গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিল। উত্তম হালদার বলেন, দুর্ঘটনার পর গীতা রানী প্রত্যয়কে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেন। তারা তীরে উঠতে সক্ষম হলেও কৃষ্ণ নিখোঁজ।
পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার দেউলী গ্রামের বাসিন্দা মো. রনি (১৫) খুঁজছিল মা রীনা বেগম ও বোন লিমাকে। বারবার আহতদের শয্যার কাছে গিয়ে মা আর বোনকে না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে রনি। রনি নিজেও এ ঘটনায় আহত হয়েছে।
এদিকে সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চ অভিযান-১০-এ প্রাণঘাতী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঝালকাঠি থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নের দিয়াকুল গ্রামের গ্রাম পুলিশ (চৌকিদার) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মামলাটি করেন। স্থানীয় পুলিশ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
ঝালকাঠি থানার ওসি মো. খলিলুর রহমান জানিয়েছেন, মামলাটি তদন্তের জন্য ঝালকাঠি থানার এসআই মো. নজরুল ইসলামকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
দুর্ঘটনাস্থল জেলার দিয়াকুল গ্রাম থেকে পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি বর্তমানে ঝালকাঠি লঞ্চ টার্মিনালে এনে রাখা হয়েছে। গতকাল সকালে লঞ্চটি পরিদর্শনে আসেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান এবং বরিশাল বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক কামাল উদ্দিন।
দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত নিখোঁজের সংখ্যা নিশ্চিত করে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তবে স্বজনদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে স্থানীয় জেলা পুলিশ ৩৭ জন ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ঝালকাঠি ইউনিট নিখোঁজ হিসেবে ৫১ জনের তালিকা দিয়েছে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত নিখোঁজদের স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এ তালিকা করা হয়েছে।
গতকাল সকাল ৮টায় দুর্ঘটনাস্থলে ঝালকাঠি ও বরিশালের ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল ও কোস্টগার্ডের একটি টিম লঞ্চঘাট এলাকা থেকে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে। নিখোঁজদের উদ্ধারে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ চালিয়েছেন ডুবুরিরা।
বরিশাল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক বেলাল উদ্দিন বলেন, গতকাল সকালে আমরা উদ্ধার অভিযান শুরু করেছি। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।
এ ঘটনায় দগ্ধের সংখ্যা শতাধিক। তাদের মধ্যে ৭০ জনকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল সরেজমিনে দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, নিখোঁজদের খোঁজে নদীতীরে ভিড় জমিয়েছেন স্বজনরা। কেউ কেউ ট্রলার নিয়ে নদীর বিভিন্ন প্রান্তে নিখোঁজদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
এ বিষয়ে ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী বলেন, যেহেতু কতজন মানুষ নিখোঁজ রয়েছে আমরা তা সঠিকভাবে জানি না, সেহেতু নিখোঁজদের উদ্ধারে আরো দু-তিনদিন অভিযান চলবে। ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ডের পাশাপাশি প্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় মানুষজনও নদীতে অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তোফায়েল হোসেন বলেন, যারা প্রথম উদ্ধারকাজে এগিয়ে এসেছে, তাদের অনেকের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। আমরা প্রাথমিক একটা ধারণা পেয়েছি। তদন্ত কমিটির সবাই মিলে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। তবে লঞ্চ কর্তৃপক্ষের কাউকে এখনো পাওয়া যায়নি। এমনকি লঞ্চের মালিকের সেলফোনও বন্ধ।
এছাড়া এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটিও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. নাজমুল আলম, সদস্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রশান্ত কুমার দে, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাবেকুন্নাহার, ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মো. কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া ও বিআইডব্লিউটিএ প্রতিনিধি।