বাংলাদেশ সীমান্তে অস্ত্র ব্যবহারের নীতি ভারতকে পরিহার করতে হবে

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়, অটোয়া এবং অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি জাপানের ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং টেরোরিজম ইন সাউথ এশিয়া: বিয়ন্ড স্ট্যাটিস্টিক ডিসকোর্সেস অন্যতম। সম্প্রতি তিনি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের পাঁচ দশক প্রসঙ্গে বণিক বার্তার সঙ্গে বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের পাঁচ দশকের বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

একটি দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক সাধারণত বিভিন্ন ধাপে তৈরি হয়। সাধারণ জনগণের মধ্যে এক ধরনের সম্পর্ক, আবার সরকার বা রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক। ১৯৭১ সালে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের পাশাপাশি দেশ দুটির জনগণের সঙ্গেও সম্পর্ক তৈরি হয়। এর একটি বড় কারণ বাংলাদেশে যখন গণহত্যা শুরু হয়, তখন ১০ মিলিয়ন শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। আবার যারা মুক্তিযোদ্ধা তারাও প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান এবং সেখানে অস্ত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাই ১৯৭১ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক তৈরি হয়, তা এখনো বিভিন্নভাবে বিদ্যমান। তবে দেশের মধ্যকার সম্পর্কগুলো বিভিন্নভাবে ওঠানামা করে, পরিবর্তন হয়। গত ৫০ বছরে কখনো বাংলাদেশের, না হয় ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে দেশ দুটির সম্পর্কও ওঠানামা করেছে। ১৯৭১ সালে ভারতে কংগ্রেস দল ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। এখন যেহেতু ভারতে বিজিপি সরকার ক্ষমতায়, সে হিসেবে বলা চলে ওই সম্পর্ক এখন সেভাবে নেই। বিজিপি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি সামনে নিয়ে এসেছে। কংগ্রেস সেকুলার রাজনীতির চর্চা করে, যা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে যায়। সে জায়গায় বলতে গেলে দুটি দেশের সম্পর্ক ওঠানামা করেছে। এর বাইরেও কিছু বিষয় থাকে যা সরকার সমাধান করতে চেষ্টা করে। আবার সরকারের মধ্যেও কিছু সম্পর্ক থাকে যা জনগণের মধ্যে প্রভাব ফেলে। যেমনবর্ডার কিলিং, তিস্তাসহ অন্যান্য নদী সমস্যা। এটা নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যেও এক ধরনের নেতিবাচক রাজনীতি চলে। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যখন কোনো সংখ্যালঘু আঘাত পায়, তখন এর প্রভাব ভারতে পড়ে। আবার ভারতের সংখ্যালঘুদের মধ্যে যখন আঘাত আসে তখন তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ে। তার পরও আমি বলব, ৫০ বছরে বাংলাদেশ-ভারত রাজনৈতিক সম্পর্ক ওঠানামা করেছে কিন্তু কখনো খুব সাংঘাতিকভাবে খারাপ হয়নি। উপমহাদেশে সম্পর্ক রাখার মধ্যে নতুনত্ব আছে। দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের সঙ্গে কখনই ভারতের সম্পর্ক ভালো হয়নি। শ্রীলংকার সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো না কিংবা নেপালের সঙ্গেও তার সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। এসব বিবেচনায় বলতে পারি, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুব একটা খারাপ হয়নি, তবে ওঠানামা করেছে। 

একটি দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল কি কোনো ভূমিকা রাখে?

যদি কংগ্রেস আর বিজেপির তুলনা করা হয়, তাহলে কংগ্রেসের কোনো নেতার মুখে আমরা যা শুনিনি যা বিজেপি নেতার মুখে শুনি যেমনউইপোকা বা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য। কংগ্রেস কখনো এনআরআই নাগরিকত্ব সনদের মতো কিছু সামনে নিয়ে আসেনি। অন্যদিকে বাংলাদেশে যখন বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় ছিল তখন আমরা ১০ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনা দেখি। কংগ্রেস এবং আওয়ামী লীগ যতখানি চেষ্টা করেছে দুটি দেশের সম্পর্ক নিয়ে আরো বড় আকারে কাজ করার বিএনপি বা বিজেপির সময় তেমন দেখি না। অবশ্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্পর্ক যে খুব একটা খারাপ হয়েছে, তা নয়। আবার সোনিয়া গান্ধী কিংবা মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে যতদিন কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল, ততদিন সম্পর্ক ভালো হয়েছে। তার মধ্যেও যে সবকিছু করা সম্ভব হয়েছে, তা নয়। আমরা তিস্তা চুক্তি সই করেছি, কিন্তু ভারত এটিকে অনুমোদন করতে পারেনি কারণ তাদের নিজেদের মধ্যে সমঝোতা হয়নি। ঠিক একইভাবে আমরা দেখেছি সীমান্তে হত্যা কমলেও শূন্যতে নামছে না। কংগ্রেস আমলেও সীমান্ত হত্যা শূন্য হয়নি কখনো, বিজেপি আমলেও না। আবার নন ট্র্যাডিশনাল ব্যারিয়ারগুলোও ঘুরেফিরে একই থাকছে। তবে দুদেশেই যখন সেক্যুলার সরকার ক্ষমতায় ছিল তখন তারা সম্পর্কের ভিত্তিটা আরো শক্তিশালী করতে পেরেছে। যার ওপর দাঁড়িয়ে এখনো সেই সম্পর্কটাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি যেটাকে বলি, ’পলিটিকস অব সিঙ্গুলারিটিএকে কেউ হয়তোফান্ডামেন্টালিজমবলবে। এটা যখন সামনে চলে আসে তখন স্বাভাবিকভাবে দুদেশই অস্বস্তি বোধ করে। বিজেপি হিন্দুত্ব নিয়ে রাজনীতি করে, যা বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট অস্বস্তিকর। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেও কুমিল্লা ঘটনার পরে বলেছেন যে, দিল্লিরও অনেক কিছু করণীয় রয়েছে। কারণ ধরনের ঘটনার প্রভাব দুই দেশের ওপরেই পড়ে। তবে গত ১০-১৫ বছরের বিষয়গুলো যদি আমরা দেখি, তাহলে সম্পর্কের গাঁথুনিটা গাঢ় হয়েছে। কংগ্রেস আর আওয়ামী লীগের যে ধরনের সম্পর্ক ছিল, বিজেপি আসার পর তা খানিকটা হোঁচট খেয়েছে। এখন যদি ভারতে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকত তাহলে সম্পর্কটা আরো বেশি বড় আকারে হতে পারত। কারণ যখন নাগরিকত্ব সনদের বিষয়টি আসে তখন এর প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের ওপর পড়ে।

কিন্তু আমরা দেখি যে সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি, গঙ্গা চুক্তি বা বাণিজ্য বৃদ্ধি চুক্তির বিষয়গুলো কংগ্রেসের নয়, অন্য দল যখন ক্ষমতায় ছিল তখন হয়েছে। এর মানে কি কংগ্রেসের আমলে সম্পর্ক বৃদ্ধির প্রভাব অন্য সময় পড়েছে?

কংগ্রেস ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে নাতবে তাদের নিয়েও বেশকিছু সমালোচনা রয়েছে, যা আমাদের স্বীকার করতে হবে। আবার বিজেপি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে। বিজেপির নেতারা মাঝেমধ্যে ধর্ম নিয়ে এমন কথা বলে তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়ে। দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নেতারা যদি ধর্ম নিয়ে উস্কানিমূলক কথা বলে তখন তার প্রভাবটা আরো বেশি পড়ে। তা তখন রাষ্ট্রের কথা হিসেবে প্রকাশ পায়। সে জায়গায় আমি মনে করি বিজেপির অনেক মন্ত্রী বা নেতা এমনসব কথা বলেছেন, যা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্যও বিব্রতকর। একইভাবে বিদ্যমান সমস্যাগুলো যখন সমাধান হয় না, তখন বাংলাদেশ নিজেও কিছুটা ক্লান্ত হয়ে যায়। তখন বাংলাদেশ নিজ উদ্যোগে এর সমাধান করতে চেষ্টা করে। যেমনট পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে আমরা দেখি। যদিও এটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তবে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছি। বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে রাজি না হওয়ায় সরকার নিজ উদ্যোগে সেতুটি নির্মাণ করছে। আবার সেতুতে রেললাইন বসানোর জন্য চীনের কাছ থেকে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নিচ্ছে। বিশ্বব্যাংক যদি ভেবে থাকে যে তারা সহযোগিতা না করলে বাংলাদেশ চুপ করে বসে থাকবে, তাহলে তা তাদের বোঝার বোকামি। তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ একমত হতে পারছে না। কেননা, ভারতীয় সংবিধানে পানিকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার চুক্তিতে রাজি হচ্ছে না। কারণ সিকিমে একাধিক ড্যাম নির্মাণের জন্য পানিটা কমে আসছে। তাই পশ্চিমবঙ্গে যে পানিটা আসছে তার অর্ধেক বাংলাদেশকে দিয়ে দিলে সেখানে আর তেমন কিছুই থাকে না। ড্যাম নির্মাণের সঙ্গে আবার দিল্লির সম্পর্ক রয়েছে। তাই চুক্তিটি পূর্ণতা পাচ্ছে না। সব মিলে রাজনীতির কারণে শীতের মৌসুমে বাংলাদেশ ঝামেলায় পড়ছে। তাই বাংলাদেশ কিন্তু বসে থাকবে না। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে। বাঁধ নির্মাণ বা বৃষ্টির পানি ধরে রাখার বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা হচ্ছে। বাঁধ নির্মাণের ব্যয় রয়েছে, আর চীন এখানে উৎসাহ দেখিয়েছে। ভারত যদি কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করত, যেখানে দুই দেশই লাভবান হবেতখন চীন আর এখানে আসত না। কেউ যদি মনে করে বাংলাদেশ সত্তরের দশকের মতো বসে থাকবেতা এখন আর হবে না। কারণ বাংলাদেশে উন্নয়ন কাঠামো তৈরি হয়েছে। বড় ধরনের এনজিও পার্টনারশিপ হয়েছে। তৈরি পোশাকে বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে দেশটি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানকে পশ্চিমা বিশ্ব কিংবা বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাগুলো স্বীকার করতে হবে। জ্বালানির ব্যাপারেও যেমনবাংলাদেশের নিউক্লিয়ার এনার্জি দরকার, রাশিয়া থেকে নেয়া হচ্ছে। তেমনি গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য জাপানের সঙ্গে কাজ করছে। মোদ্দাকথা, বাংলাদেশ কোনো কিছুর জন্য এখন আর বসে থাকবে না। সেই জায়গায় আমার মনে হয়, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কটা আরো বেশি হতে পারত। এখনো সুযোগ আছে। শুধু ভারতেরই বাণিজ্য বাড়বে, তারাই লাভবান হবেএমনটা বিবেচনা করলে হবে না।

সীমান্তে হত্যার বিষয়টি ভারত কেন থামাতে পারছে না?

এটা রীতিমতো অন্যায়। কারণ হত্যাগুলো সব এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং। এর সমাধানও রয়েছে। ১৯৯৬ সালে চীন-ভারত চুক্তি করেছে যে সীমান্তের কিলোমিটারের মধ্যে তারা কোনো অস্ত্র বহন করবে না। দুদেশ এটা মেনে নিচ্ছে। গালওয়ান ভ্যালিতে যে সংঘর্ষ হয়েছে সেখানে কিন্তু কোনো অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। চীনের সঙ্গে ভারত চুক্তিটি করেছে কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তকে তারা হয়তো এখনো পাকিস্তানের সীমান্ত হিসেবে দেখে। এর মানে তাদের মানসিকতার পরিবর্তনও হয়নি। আমাদের টিভি চ্যানেল সেখানে সম্প্রচার করা হয় না। চীনের মতো বাংলাদেশের সীমান্তেও ভারত চুক্তিটি করতে পারে। দুই কিলোমিটারের মধ্যে যদি কেউ ধরা পড়ে তাহলে তাকে ধরে নিয়ে জেলজরিমানা করুক, কিন্তু জিরো লাইনে কাউকে পেলে গুলি করে হত্যা করবে কেন? ফেলানি তো মারা গেছে জিরো লাইনে। ফেলানির কাছে তো অস্ত্র ছিল না, সে এপাশে আসছিল। এর মানে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের মানসিকতাই হলো এরা সব শত্রু। ভারতের গবেষণা থেকেই জানা যায়, পাকিস্তান সীমান্তে পাহারা দেয়া সৈন্যদেরই কোনো পুনঃপ্রশিক্ষণ ছাড়া বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে আসা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ-ভারতের জনগণের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, কেউ কেউ তা ভাঙার চেষ্টা করছে। এপাশে যেমন লোক আছে, ওপাশেও আছে। ভারতের বোঝা উচিতবর্ডার কিলিং ইজ কিলিং ইওর সেলফ 

দুদেশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ-ভারত এখন সম্পর্কের সুবর্ণ সময় পার করছে। কিন্তু সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হয়েছে। ভারত আবার জাতিসংঘের কাছে অভিযোগ করেছে। সম্পর্ক ভালো হলে কেন দুদেশ আলাপ করে সমস্যাগুলো নিষ্পত্তি করছে না?

সুবর্ণ সময়বা গোল্ডেন এজএগুলো রাজনীতির ভাষা। ঘাটতিগুলোকে ঢেকে রাখতে শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়। ভারতের বেশির ভাগ জনগণ বাংলাদেশীদের সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা ভালো করেই জানেন, বাংলাদেশে একটা সেক্যুলার আইডেনটিটি রয়েছে। তাছাড়া বাংলা ভাষার কেন্দ্র এখন আর কলকাতা নয়। বাংলা ভাষার কেন্দ্র এখন বাংলাদেশ। একুশে ফেব্রুয়ারি যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেল, তখন কলকাতার বাঙালিরাই উৎসাহিত হয়েছে। কিন্তু ভারত অনেক বড় দেশ। আমি মনে করি, দুটি দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য বিদ্যমান সমস্যাগুলো যদি খুব তাড়াতাড়ি সমাধান সম্ভব হয়, তাহলে সম্পর্কটি সামনে অগ্রসর হবে। বিশেষ করে সীমান্ত হত্যার বিষয়টির সমাধান জরুরি।

আপনি যেমনটা বললেন, ভারতের অসহযোগিতার কারণে বাংলাদেশে চীনের উপস্থিতি বেড়ে যাচ্ছে। ভারত আবার বিষয়টি পছন্দ করছে না। তারা বাংলাদেশে চীনের উপস্থিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে।

এখানে কয়েকটি ব্যাপার আছে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, চীনের সঙ্গে ভারতের বিশাল একটি সম্পর্ক রয়েছে। ভারত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সদস্য। পাকিস্তানও কিন্তু এর সদস্য। মজার ব্যাপার, ভারত এসসিওতে পাকিস্তানের সঙ্গে বসতে রাজি কিন্তু সার্কে একসঙ্গে বসবে না। বিষয়গুলো আমরা বুঝতে পারি না। ভারত যদি বিংশ শতাব্দীর কাঠামো অনুযায়ী মনে করে, ভারতের আনুগত্য এশিয়ার সব দেশ মেনে নেবে, তা ভুল। শতাব্দীতে ছোট রাষ্ট্র বড় রাষ্ট্র বলে কিছু নেই। ভারতের সঙ্গে চীনের বড় ধরনের বাণিজ্য সম্পর্ক আছে। কিন্তু ভারত সবসময় চীনের বিপরীতে প্রচার করে বেড়াচ্ছে। গালওয়ান ভ্যালির সংঘর্ষে চীন-ভারত কোনো অস্ত্র ব্যবহার করেনি। দুঃখজনক সৈন্যরা হতাহত হয়েছে। তার পরও ভারত কিন্তু এসব বিষয়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে আচরণ করছে। আমার মনে হয়, ভারতের নীতিনির্ধারকরা নির্বাচনে জেতার জন্য বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে। তারা এরই মধ্যেএন্টি পাকিস্তানইস্যুটা বেশি ব্যবহার করে ফেলেছে, তাছাড়া পাকিস্তান যেহেতু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল তাই আর একটা বড় শক্তিকে সামনে আনতে পারলে নির্বাচনে এগিয়ে থাকা যায় কিংবা হতে পারে চীনের বিপরীতে হইচই করে আমেরিকার প্রযুক্তিগত সাহায্য পেতে চাচ্ছে তারা। এটা মনে রাখতে হবে, ভারতের উচ্চবৃত্ত শ্রেণীর সন্তানরা বেশির ভাগই আমেরিকা ইউরোপে পড়াশোনা করে। তাই চীনের সঙ্গে ধরনের দেখানো লড়াইয়ে ভারত অনেক ধরনের সুবিধাও পায়। এদিকে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে তার সম্পর্কটা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যেই রেখেছে। তোমার শত্রু বা বন্ধু তোমার শত্রু বন্ধু। আমার না। বাংলাদেশ সবসময় বার্তাই দিতে চেয়েছে। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের ভালো সম্পর্ক রয়েছে, আবার ইসরাইলের সঙ্গে ভারতের ভালো সম্পর্ক। বাংলাদেশ সবসময় ফিলিস্তিনকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের কিন্তু কোনো শত্রু নেই। বলা যায় অনেকটা শত্রুবিহীন উন্নয়ন বাংলাদেশের হয়েছে আর বিশ্বের ধরনের রাষ্ট্র খুব কমই আছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। কারণ বাংলাদেশ মনে করে রোহিঙ্গা সমস্যা হচ্ছে মিয়ানমার রাষ্ট্রের সঙ্গে মিয়ানমানের জনগণের সমস্যা। বাংলাদেশ আজ বিভিন্ন সূচকে ভারতের চেয়ে এগিয়ে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে কিন্তু ভারতেরও লাভ রয়েছে। কারণ বাংলাদেশ যদি এখনো অনুন্নত দেশ থাকত তাহলে হাজার হাজার বাংলাদেশী তো ভারতে প্রবেশ করতে চাইতো। যেমনটা আমরা মেক্সিকো আমেরিকার বর্ডারে দেখছি। বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনেক রেমিট্যান্সও যায়। বাংলাদেশ যদি আমেরিকা, চীন বা জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে অর্থনীতিকে আরো বড় করতে পারে তাহলে তাতে ভারতেরও লাভ রয়েছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক উন্নয়নকে ভারত হুমকি মনে করছে কেন?

কারণ ভারত দুই ধরনের রাষ্ট্র চিহ্নিত করতে অভ্যস্ত। একটা হলো পাকিস্তান, যে তাদের পুরোপুরি শক্র। অন্য ধরনটা হলো নেপাল, শ্রীলংকা বা ভুটান। ভারতের সঙ্গে নেপালের সম্পর্ক খারাপ হচ্ছিল। যে সম্মানটা নেপাল চাচ্ছিল তা ভারত তাদের দিচ্ছিল না। নেপাল তো বসে থাকবে না। তাছাড়া চীনের যেখানে অর্থ নিয়ে বসে আছে। একইভাবে ভুটানও চীনের দিকে প্রায় চলে যাচ্ছিল, ভারত কোনোভাবে থামিয়েছে। ভবিষ্যতে থামাতে পারবে কিনা জানি না। শ্রীলংকা মনে করে, তামিল টাইগারদের সঙ্গে ৩০ বছর যে যুদ্ধ হয়েছিল এর সঙ্গে ভারত জড়িত ছিল। শ্রীলংকা কখনো তা ক্ষমা করবে না। অবস্থায় বাংলাদেশ একটি নতুন মডেল তৈরির চেষ্টা করছে, সবার সঙ্গেই একটা সমমর্যাদার সম্পর্ক থাকবে। এখানে বঙ্গবন্ধুর বিরাট অবদান রয়েছে। একাত্তর সালে ঢাকা ফিরে বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতায় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন তখন তিনি স্পস্ট করে বলেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সব রাষ্ট্র যেন একসঙ্গে কাজ করে। সার্কের কাঠামো কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর সামনে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণের মধ্যেই রয়েছে। তিনি কখনই বলেননি, পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে করো। বাংলাদেশের অবস্থান কিন্তু খুব পরিষ্কার। ভারতের নীতি-নির্ধারকরা কেন এটি বুঝতে পারছে না কিংবা আমরা হয়তো বুঝতে পারছি না, সেটা হতে পারে। বাংলাদেশের নীতিগুলো কিন্তু একাত্তরের আগেই করা। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের ইশতেহার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তৈরি করা, সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ‘ফ্রেন্ডশিপ টুওয়ার্ডস ফর অল, ম্যালিস টুওয়ার্ডস নানএবং তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে আমি কখনো সেনটো সিয়াটোর সদস্য হব না। এর কারণে কিন্তু নিক্সন কিসিঞ্জার আমাদের ওপর ক্ষেপে ছিল। যদি নিরাপত্তার বিষয় না থাকে, উন্নয়নের বিষয় থাকে তাহলে চীন, রাশিয়া, জাপান কিংবা কোরিয়ার সঙ্গে আমরা সম্পর্ক তৈরি করব। বাংলাদেশ বর্তমানে ওই সম্পর্কটাই তৈরি করছে। বাংলাদেশ এখন কিন্তু চীন-ভারত ব্যালান্স করছে না, এখানে ব্যালান্সের কিছু নেই। এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গেও আমরা খারাপ সম্পর্ক চাইনি। এর জন্য তারাই দায়ী। তারা আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে বলতে শুরু করেছিল, বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া যখন শুরু হলো। এখন পাকিস্তানই চাচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে। আমরা বারবার বলছি, তোমাদের আগে একাত্তরকে স্বীকার করতে হবে। এরপর আমরা ব্যাপারে পদক্ষেপ নেব। তাই বলব বাংলাদেশের নীতি যেহেতুফ্রেন্ডশিপ টুওয়ার্ডস ফর অল, ম্যালিস টুওয়ার্ডস নান’— এখানে ভারতের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা আশা করেছিলাম ভারত আমাদের পাশে থাকবে, কিন্তু তারা চীনের সঙ্গে মিলে মিয়ানমারের পক্ষ নিল ধরনের দ্বৈততা কেন?

এটা একটা বড় ধরনের দ্বন্দ্ব। বিজেপি থাকার জন্য হয়েছে, কংগ্রেস থাকলে হয়তো হতো না। বিজেপি হয়তো আরাকান মুসলিমদের ইতিবাচকভাবে দেখছে না। এক্ষেত্রে ভারতের রাজনীতির মধ্যে ঘাটতি তো আছেই। যার জন্য আমরাও চিন্তিত হয়ে যাই মাঝে মাঝে। কারণ ভারত একদিকে চীনের সঙ্গে লড়াকু মনোভাব তুলে ধরছে, অপরদিকে মিয়ানমার ইস্যুতে চীনের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের জাতীয় স্বার্থ রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে দমনে মিয়ানমারের সমর্থন দরকার। আবার বঙ্গোপসাগরেও চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়া তার একটি রুট দরকার। চীন-জাপানও যেমন দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে রীতিমতো মারামারি করছে আবার মিয়ানমার ইস্যুতে তারা একমত। বিষয়গুলো আমরা বুঝি। তবে জাতিসংঘে এই প্রথমবার জাপান রোহিঙ্গা রেজল্যুশন সমর্থন করেছে। আমরা আশা করি, ভারতও এটা করবে। চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও উন্নয়ন হবে নিজ গতিতে। তবে ভারত হয়তো তাদের ১৯৬২ সালের যুদ্ধটা ভুলতে পারছে না। আবার আমেরিকা থেকে তাদের প্রযুক্তি সুবিধা দরকার। ভারতের অভিজাত শ্রেণী পশ্চিমাঘেঁষা। তবে ২০১৮ সালে ইউরোপ-আমেরিকান তুলনায় ভারতের ছাত্ররা চীনে বেশি পড়তে গেছে। এটা পরিবর্তন হতে ১০ থেকে ২০ বছর লেগে যাবে। হয়তো ২০২৮ সালের দিকে প্রভাবটা পড়তে শুরু করবে। কারণ চীন থেকে পড়াশোনা করে যে ছাত্ররা ভারতে আসবে, রাজনীতিসহ অন্য ক্ষেত্রগুলোতে বিচরণ করবে, তাদের কাছে চীনের অবস্থান ভিন্ন। আমার মনে হয়, তখন ক্রমশ দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত হবে।

বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য বাড়ছে। কিন্তু আমরা দেখি বাংলাদেশে যখন কোনো সংকট দেখা দেয়, যেমন চাল বা পেঁয়াজ, ভারত তখন শুল্ক বাড়িয়ে দেয় কিংবা সীমান্ত বন্ধ করে দেয়

বাংলাদেশ কিন্তু বসে থাকছে না, আমরা কিন্তু ঘুরেফিরে ভালো সমাধান পেয়ে যাচ্ছি। যেমনগরুর ব্যবসার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি। ঈদের সময় গরু সরবরাহের ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই স্ব-নির্ভর হয়ে উঠেছি। বিশ্বায়নের যুগে ভারতেরও চিন্তা করা দরকার, বিভিন্ন সময় বাধা দিয়ে তারা বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবেএমনটা ঠিক নয়। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের ব্যবসায়ীরা জড়িত কিনা সেটাও খেয়াল রাখা দরকার।

কভিডের টিকার ক্ষেত্রেও ভারতকে অসহযোগিতা করতে দেখা গেল....

অ্যাস্ট্রাজেনেকার কাঁচামালটা আসে আমেরিকা থেকে। ভারত মূলত কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন নিয়ে এক ধরনের কূটনীতি করতে চেয়েছিল। তবে ফাইজারসহ অন্যান্য কোম্পানি তা চাইছিল না। আর কাঁচামাল আমেরিকার, তা দিয়ে ভারত কূটনীতিতে এগিয়ে যাবে তা তারা চায়নি। আমার মনে হয়, এখানে আমাদের হোমওয়ার্কটা কম ছিল। অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে চুক্তি করার আগে আমাদেরও জানা দরকার ছিল, তাদের কাঁচামালটা কোথা থেকে আসে ইত্যাদি। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম ভারতই এটা উৎপাদন করছে।

ভারত বাংলাদেশকে থেকে বিলিয়ন ডলারের মতো ঋণ প্রদান করেছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া অন্যান্য প্রকল্পে তেমন অগ্রগতি নেই কেন?

প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সময় দেখা যায় ভারত তাদের পণ্য ব্যবহারসহ বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। এতে বাংলাদেশের খরচ বেশি পড়ে এবং তেমন কোনো লাভ হয় নাবাংলাদেশ বারবার হোমওয়ার্কটা করে দেখেছে। এখন কিন্তু পৃথিবীতে একাধিক পার্টনার তৈরি হয়েছে যারা ঋণ দিতে সক্ষম। এদিকে বাংলাদেশও কিন্তু ঋণ দেয়া শুরু করেছে। শ্রীলংকাকে আমরা ঋণ দিয়েছি। মালদ্বীপকেও ঋণ দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। ভারতকে মনে রাখতে হবে, চীনের সঙ্গে লড়াই করে তাদের জেতার সম্ভাবনা কম। কোনো দেশকে ঋণ দিয়ে তা ফেরত পাওয়ার জন্য চীন ৩০ থেকে ৪০ বছর অপেক্ষা করতে পারে। তাই ভারতের সঙ্গে চীনের উন্নয়নের কাঠামোতে অনেক ফাঁরাক রয়েছে। তবে ভারত যেহেতু একটা বড় রাষ্ট্র এবং তার সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক একটা সম্পর্ক রয়েছে। সবমিলিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুব একটা খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা আমি দেখি না। তবে যে সমস্যাগুলোর সমাধান দরকার তা যদি ভারত না করে তবে বাংলাদেশের জনগণ উৎসাহটা হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা হলো বাংলাদেশ তো এখন আর বসে থাকবে না।

শ্রুতলিখন: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন