ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাতিরঘেরী ও হরিহারপুর গ্রাম আবারো প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন দুই গ্রামের অন্তত ২০০ পরিবার। স্থানীয়দের অভিযোগ, ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে এ বাঁধ ভেঙেছে। এদিকে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে সুন্দরবনের চারটি চরে অন্তত ২ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়েছেন শুঁটকি ব্যবসায়ীরা।
কয়রা উপজেলার গাতিরঘেরী গ্রামের গণেশ গাইন বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর প্রায় পাঁচ মাস পানিবন্দি ছিলাম। মাসখানেক আগে নির্মিত হওয়ায় মনে করেছিলাম হয়তো বাঁধ নিয়ে আর দুশ্চিন্তা থাকবে না। কিন্তু ঠিকাদারের গাফিলতিতে আবারো বাঁধ ভেঙে আমরা পানিবন্দি হয়ে পড়েছি।
কয়রার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে জানান, জাওয়াদের প্রভাবে শাকবাড়িয়া নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানি বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে শনিবার রাতে হরিহারপুর লঞ্চঘাটের পূর্বপাশ থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ পুনরায় ভেঙে যায়।
নুরুল বলেন, চলতি বছরের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে একই স্থানে ভেঙে গেলে স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে ভেঙে যাওয়া পয়েন্টটি মেরামত করে। তিনি অভিযোগ করেন, ওই স্থানে বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু ঠিকাদার যথাসময়ে সঠিকভাবে বাঁধ নির্মাণ না করায় সেটি টেকসই হয়নি। এজন্য তিনি মূল ঠিকাদার নিজে না করে এক শ্রমিককে সাব কন্ট্রাক্টে কাজ দেয়ার অভিযোগ করেন।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিভাগ-২) উপসহকারী প্রকৌশল মশিউল আবেদিন বলেন, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে শাকবাড়িয়া নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪ থেকে ৫ ফুট পানি বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় হরিহারপুর লঞ্চঘাটের পূর্বপাশে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ৪১০ মিটার পর্যন্ত টিউব দিয়ে রিং বাঁধ ও মাটি দিয়ে স্লোব নির্মাণকাজের জন্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে মেসার্স জিয়াউল ট্রেডার্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দ্রুত ওই এলাকার মানুষকে পানিবন্দি থাকার দুর্ভোগ মুক্ত করা যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে বেড়িবাঁধ ভেঙে গাতিরঘেরী ও হরিহারপুর গ্রাম দুটি প্লাবিত হয়েছে। তাদের জন্য খাদ্য সহায়তা ও কম্বল দেয়া হয়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে টানা বৃষ্টির সঙ্গে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলে। এতে সুন্দরবনের চারটি চরের প্রায় ২ কোটি টাকার শুঁটকি নষ্ট হয়ে গেছে। মৌসুমের শুরুতে ক্ষতির মুখে পড়ে দিশেহারা জেলে ও শুঁটকি ব্যবসায়ীরা। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে বলে জানিয়েছেন সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন।
সুন্দরবনের আলোরকোল, মাঝের চর, নারকেলবাড়িয়া ও শেওলার চর এলাকায় কমপক্ষে প্রায় ১৫ হাজার জেলে শুঁটকি আহরণ করছেন। বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ায় পাঁচদিন ধরে সাগর উত্তাল থাকায় জেলেরা মাছ ধরতে পারছেন না। পাশাপাশি টানা বৃষ্টির ফলে শুঁটকি পল্লীতে জেলে ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
সুন্দরবনের আলোরকোল শুঁটকিপল্লী থেকে মুঠোফোনে ব্যবসায়ী আবু তাহের বলেন, গেল পাঁচদিন ধরে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় শুঁটকির মাচা ছুঁই ছুঁই পানি হয়েছে। এছাড়া অবিরাম বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে চরের অসংখ্য মাচার শুঁটকি। তিনি দাবি করেন, তার নিজেরই প্রায় ৭ লাখ টাকার শুঁটকি নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া সাতদিন ধরে তার ২৬ জন জেলে ট্রলার নিয়ে সাগরে যেতে পারছেন না। ফলে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তারা। গেল বছর করোনার কারণেও প্রায় ২৫ লাখ টাকার লোকসান গুনতে হয়েছে।
শুঁটকি পল্লীর জেলে বিকাশ বিশ্বাস বলেন, শুঁটকি আহরণের জন্য বছরের প্রায় পাঁচ মাস সাগরে অবস্থান করি। এ সময়ের আয়ে আমাদের সারা বছর চলে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, বৃষ্টিতে সুন্দরবনের বিভিন্ন চরে রোববার থেকে তিন ফুট পানি বেড়েছে। বন্য প্রাণী ও গাছগাছালির ক্ষতি না হলেও শুঁটকিপল্লীর বেশ ক্ষতি হয়েছে। জেলেদের তথ্য অনুযায়ী টানা বর্ষণে প্রায় ২ কোটি টাকার শুঁটকির ক্ষতি হয়েছে চরগুলোতে। ফলে রাজস্বও কমে আসবে শুঁটকিপল্লী থেকে। তবে মৌসুমের বাকি সময়গুলো আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবেন জেলেরা। এদিকে উপকূলীয় জেলা ভোলায় জাওয়াদের প্রভাবে দিনভর বৃষ্টি হয়েছে। মাছ ধরা ট্রলারগুলোকে সমুদ্রে না গিয়ে উপকূলের কাছাকাছি থাকতে বলা হয়েছে। এছাড়া জাওয়াদের প্রভাব পড়েছে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটেও। ফেরি ও লঞ্চগুলো সাবধানে পারাপারের কারণে উভয় পাশে তৈরি হয়েছে যানবাহনের দীর্ঘ সারি।